‘ধন্য সেই পুরুষ, যাঁর নামের ওপর রৌদ্র ঝরে/ চিরকাল, গান হয়ে/ নেমে আসে শ্রাবণের বৃষ্টিধারা; যাঁর নামের ওপর/ কখনো ধুলো জমতে দেয় না হাওয়া,/ ধন্য সেই পুরুষ, যাঁর নামের উপর পাখা মেলে দেয় জ্যোৎস্নার সারস,/ ধন্য সেই পুরুষ, যাঁর নামের উপর পতাকার মতো/ দুলতে থাকে স্বাধীনতা,/ ধন্য সেই পুরুষ, যাঁর নামের ওপর ঝরে/ মুক্তিযোদ্ধাদের জয়ধ্বনি’।
১৯২০ সালের এই দিনে (১৭ মার্চ) টুঙ্গিপাড়ায় পিতা শেখ লুৎফর রহমান এবং মাতা সায়েরা খাতুনের ঘর আলোকিত করে জন্মগ্রহণ করেন মুজিব। চার বোন ও দুই ভাইয়ের মধ্যে তিনি ছিলেন তৃতীয়।
পরাধীনতার নিকষ অন্ধকারে নিমজ্জিত বাঙালি জাতির ভাগ্যাকাশে মুক্তির প্রভাকররূপে জন্ম নেন ‘খোকা’ নামের সেই শিশুটি। শিক্ষাদীক্ষা, মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি, মহত্তম জীবনবোধ, সততা, সাহস, দক্ষতা ও দূরদর্শী নেতৃত্বে হয়ে ওঠেন বিশ্বনেতা। একটি জাতিকে এনে দেন স্বাধীনতা।
যিনি আজীবন বাংলার মানুষ ও দেশকে নিয়েই ভেবেছেন। বাংলার মানুষ তিনবেলা পেট পুরে ভাত খাবে, হাসবে, খেলবে, মুক্ত হাওয়ায় বসবাস করবে-এই ছিল তার জীবনের ব্রত। এই হলো বঙ্গবন্ধুর দর্শন। মানুষ, সমাজ, রাষ্ট্র নিয়ে মৃত্যু অবধি শুধু সেই কথাই ভেবেছেন তিনি। সব সময় থেকেছেন সেই চিন্তায় মগ্ন। স্বপ্ন দেখতেন সোনার বাংলার।
বাঙালির আদর্শ পুরুষ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বর্তমান প্রজন্মের মন-মননে, চিন্তাচেতনায়, আদর্শ-অনুপ্রেরণায়, চেতনায়-জাগরণে প্রদীপ্ত শিখারূপে প্রবহমান। বাঙালির হৃদয় আকাশে বঙ্গবন্ধু আজও জ্বলজ্বলে উজ্জ্বল ধ্রুবতারা।
ক্ষণজন্মা এ মহামানবের স্বপ্নের উন্নত-সমৃদ্ধ সোনার বাংলা বিনির্মাণে তারই নির্দেশিত পথ ধরেই এগিয়ে চলেছে বাংলাদেশ। ১০৫তম জন্মদিনে বাঙালি জাতি শ্রদ্ধায়, ভালোবাসায়, কৃতজ্ঞচিত্তে আজ স্মরণ করবে জাতির পিতাকে। আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন নানা কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনটি জাতীয় শিশু দিবসও।
দিবসটি উপলক্ষ্যে আজ সরকারি ছুটি। এ উপলক্ষ্যে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণী দিয়েছেন।
রাষ্ট্রপতি তার বাণীতে বলেন, বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতির চিরন্তন প্রেরণার উৎস। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আর জাতির পিতার আদর্শকে ধারণ করে জাতি এগিয়ে যাক ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার পথে, নোঙর ফেলুক বঙ্গবন্ধুর ‘সোনার বাংলায়’।
প্রধানমন্ত্রী তার বাণীতে বলেন, বঙ্গবন্ধুর জীবন ও আদর্শ অনুসরণে এদেশের শিশুদের যথাযোগ্য সুনাগরিক হিসাবে গড়ে তুলতে সরকার কাজ করে যাচ্ছে। আজকের শিশুই হবে ২০৪১ সালের স্মার্ট বাংলাদেশের স্মার্ট জনগোষ্ঠী। ভবিষ্যৎ বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দেবে আজকের শিশুরাই।
আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য তোফায়েল আহমেদ বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন উপলক্ষ্যে তার এক লেখায় বলেছেন, বঙ্গবন্ধু জীবনের প্রতিটি ধাপেই বাঙালির সার্বিক মুক্তির জয়গান গেয়েছেন। যে স্বাধীন বাংলার স্বপ্ন তিনি দেখেছিলেন, যে বাংলার জন্য তিনি যৌবনের অধিকাংশ সময় কারাগারে কাটিয়েছেন, ফাঁসির মঞ্চে গেয়েছেন বাঙালির জয়গান, সেই বাংলা ও বাঙালির জন্য তার ভালোবাসা ছিল অপরিসীম। সমুদ্র বা মহাসমুদ্রের গভীরতা পরিমাপ করা সম্ভব; কিন্তু বাংলা ও বাঙালির জন্য বঙ্গবন্ধুর হৃদয়ের যে দরদ, যে ভালোবাসা, তার গভীরতা অপরিমেয়।
শেখ মুজিবুর রহমান টুঙ্গিপাড়ার চিরায়ত গ্রামীণ সমাজের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না আবেগ-অনুভূতি শিশুকাল থেকে গভীরভাবে প্রত্যক্ষ করেছেন। গ্রামের মাটি আর মানুষ তাকে প্রবলভাবে আকর্ষণ করত। শৈশব থেকে তৎকালীন সমাজ জীবনে তিনি জমিদার, তালুকদার ও মহাজনদের অত্যাচার, শোষণ ও প্রজাপীড়ন দেখে চরমভাবে ব্যথিত হতেন।
গ্রামের হিন্দু-মুসলমানের সম্মিলিত সম্প্রীতির সামাজিক আবহে তিনি দীক্ষা পান অসাম্প্রদায়িক চেতনার। কিশোর বয়সেই তিনি রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। এর পরের গল্প শুধুই আন্দোলন-সংগ্রাম আর লড়াইয়ের। জেল, জুলুম, অত্যাচার, নির্যাতন সহ্য করে, মৃত্যুভয় উপেক্ষা করে তার নেতৃত্বে বিশ্বমানচিত্রে অভ্যুদয় ঘটে স্বাধীন বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের।
স্বাধীনতার পর তিনি যখন তার স্বপ্নের বাংলাকে সোনার বাংলা হিসাবে গড়ে তোলার কাজ শুরু করেন, যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে এগিয়ে নিতে থাকেন বিশ্ব মর্যাদার আসনে; তা ভালো লাগেনি পরাজিত শক্তির। মাত্র ৫৫ বছর বয়সে হায়েনার দল কেড়ে নেয় তার প্রাণ।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে হত্যা করা হয় জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানকে। ঘাতকরা তার নাম ইতিহাস থেকে মুছে ফেলতে চেয়েছিল; কিন্তু পারেনি। জীবিত বঙ্গবন্ধুর চেয়ে মৃত্যুঞ্জয়ী বঙ্গবন্ধু আরও শক্তিশালী ও তেজস্বী। তিনি চিরভাস্বর হয়ে আছেন প্রতিটি বাঙালির হৃদয়ের মণিকোঠায়। কবির ভাষায়-‘ধ্রুবতারা তুমি জ্বলজ্বলে উজ্জ্বল/স্বপ্ন তোমার হয়নি তা নিষ্ফল/ ওহে দিকদিশারি, স্বপ্নচারী/ তোমার স্বপ্নে আলোকিত আজ বাংলার বিভাবরী।/ এই বাংলার প্রতি ধূলিকণা জানে/ মিশে আছ তুমি বাংলার প্রতি প্রাণে/ অনন্তকাল বেঁচে রবে তুমি গল্প কবিতা গানে’।
দেশের প্রতিটি কোনায় আজ উচ্চারিত হচ্ছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম। ‘যদি রাত পোহালে শোনা যেত, বঙ্গবন্ধু মরে নাই…’। এটি যেন শুধু গান নয়, বাঙালির আকুতি।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যু কিংবা জন্মদিনে এ গানটি বাজানো হয় অবধারিতভাবেই। আজও সারা দেশে তা শোনা যাবে। কারণ বাঙালির হৃদয়ের মণিকোঠায় এখনো তিনি চিরভাস্বর।
কবির ভাষায়-‘মানলে তাকে, অতীত যাকে হয় না কিছুই কীর্তিহারা/ অনাথ জাতি ভরসা পায় থাকে না আর পিতৃহারা/ ধর্ম যেমন ধর্ম তো নয় মঠ মসজিদ চার্চকে ছাড়া/ বাঙালি কি বাঙালি হয় সতেরই মার্চকে ছাড়া।/ শান্তি স্থিতি কিংবা লড়াই জয় নেই রণ তূর্য ছাড়া/ বাংলাদেশের মুক্তিও নেই মুজিব নামের সূর্য ছাড়া।’