বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ এক অবিচ্ছেদ্য নাম। বঙ্গবন্ধু মানেই বাংলাদেশ আর বাংলাদেশ মানেই বঙ্গবন্ধু। বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের পথপ্রদর্শক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। স্বাধীন বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধুর অমর কীর্তি। বাঙালি জাতির জন্ম যদিও হয়েছে হাজারো বছর পূর্বে; কিন্তু বাঙালি জাতি হিসেবে কোনো স্বীকৃতি ছিল না, পৃথক জাতিসত্তা হিসেবে কোনো পরিচিতি ছিল না, বাঙালি জাতির স্বাধীন কোনোও ভূখণ্ডও ছিল না। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালিকে স্বতন্ত্র জাতি হিসেবে বিশ্বে পরিচিত করেছেন।
১৭৫৭ সালে পলাশীর প্রান্তরে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত যাওয়ার পর দীর্ঘ ১৯০ বছরে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণ ও নির্যাতনের হাত থেকে ১৯৪৭ সালে ভারতীয় উপমহাদেশের মানুষ মুক্তি পেলেও পূর্ব বাংলার বাঙালির ওপর নেমে আসে অমানিশি অন্ধকার। ধর্মের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত দ্বিজাতিতত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে ভারত থেকে আলাদা হয়ে পাকিস্তান নামের রাষ্ট্রের জন্ম হয়। এর মধ্য দিয়ে শুরু থেকে বাঙালির জীবনে আবারও নেমে আসে শোষণ, অত্যাচার ও নির্যাতন। ব্রিটিশ শাসনের হাত থেকে স্বাধীন হলেও এই ভূখণ্ডের বাঙালি আবার পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয়ে পড়ে। তবে থেমে থাকেনি বীরের জাতি বাঙালি।
বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের যে পটভূমি, তাতে সর্বাধিক দায়, দক্ষতা ও সফলতার সঙ্গে পদচারণা একমাত্র বঙ্গবন্ধুর। বঙ্গবন্ধু বায়ান্নর ভাষা-আন্দোলনের অন্যতম বীরসেনানী; বাষট্টির গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পথিকৃৎ; ছেষট্টির ছয় দফা আন্দোলনের ঋত্বিক; ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের প্রেরণা-পুরুষ; সত্তরের নির্বাচনের ঈর্ষণীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনকারী; একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক; বাঙালি জাতীয়তাবাদের রূপকার; সর্বোপরি স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের মহান স্থপতি এবং বাঙালি জাতির পিতা, অবিসংবাদিতভাবেই। তাই প্রাণসংশয়ের চরম মুহূর্তেও তাঁর কণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছে, ‘ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়ে আমি বলব আমি বাঙালি, বাংলা আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা।’ সত্যি তিনি সমগ্র দেশ ও জাতিকে অগ্নিকুণ্ডের মুখে ঠেলে দিয়ে কাপুরুষের মতো আত্মগোপন করেননি। বরং দখলদার বাহিনীর আক্রমণের প্রথম শিকারে পরিণত হয়েছেন; হাসিমুখে মৃত্যুর ঝুঁকি আলিঙ্গন করেছেন।
গোপালগঞ্জের মিশন স্কুলপড়ুয়া সেই কিশোর ছেলেটি যেদিন স্কুলের প্রধান ফটকে এ কে ফজলুল হক এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর পথ আগলে দাঁড়িয়েছিলেন, নিঃশঙ্কচিত্তে জানিয়েছিলেন তাঁর দাবি, সেদিন তার ভেতর যে নেতৃত্ব ও সাংগঠনিক ক্ষমতার স্ফূরণ দেখা গিয়েছিল, তা-ই সেদিনকার সেই অকুতোভয় মুজিবকে পরবর্তী সময়ে সাড়ে সাত কোটি বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিল। আর সেই মহান নেতা দীর্ঘপ্রতীক্ষিত জাতিকে উপহার দিলেন পরম কাক্সিক্ষত স্বাধীনতা, দিলেন একটি ভূখণ্ড, একটি পতাকা, একটি জাতীয় সংগীত। টুঙ্গিপাড়ার দামাল ছেলেদের নিয়ে গড়ে তোলা সেদিনের সেই খুদে সংগঠনের খুদে স্থপতি হয়ে উঠলেন একটি দেশের স্থপতি। নির্মাণ করলেন ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের একটি স্বাধীন দেশ, যার নাম তিনি নিজেই রেখেছেন বাংলাদেশ। ১৯৬৯ সালের ৫ ডিসেম্বর হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুবার্ষিকীতে ঢাকা হাইকোর্ট প্রাঙ্গণে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেছিলেন, ‘এই ভূখণ্ডটির নাম হবে বাংলাদেশ।’
১৯২০ সালের ১৭ মার্চ গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় জন্ম নেয়া জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁর আয়ুষ্কালের প্রতিটি মুহূর্ত ব্যয় করেছেন বাঙালি জাতির মুক্তিসংগ্রামে। বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ, বাঙালি জাতিসত্তা, স্বাধীনতা এবং বাংলাদেশ এক ও অভিন্ন। বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতির মুক্তির জন্য আজীবন লড়াই করেছেন। এ দেশের মানুষ যাতে আত্মমর্যাদা নিয়ে বিশ্বদরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে এজন্য তিনি তাঁর জীবন উৎসর্গ করেছেন। তাঁর রাজনীতির মূলমন্ত্রই ছিল আদর্শের জন্য সংগ্রাম, আদর্শের জন্য আত্মত্যাগ যে আদর্শ, বিশ্বাস ও স্বপ্ন নিয়ে তিনি রাজনীতি করতেন, শত কষ্ট ও প্রচণ্ড চাপেও তিনি তাতে অটল ছিলেন।
১৯৩৯ সালে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে তাঁর কারাবরণ শুরু। বস্তুত জেল-জুলুম ও নিপীড়ন বঙ্গবন্ধুর জীবনে এক নিয়মিত অধ্যায়ে পরিণত হয়েছিল। জনগণের জন্য, দেশের জন্য তিনি ৪ হাজার ৬৮২ দিন কারাগারে ছিলেন, যা তাঁর মোট জীবনকালের প্রায় এক-চতুর্থাংশ। অপরিসীম সাহস, দৃঢ়চেতা মনোভাব ও আপসহীন নেতৃত্ব দিয়ে বঙ্গবন্ধু পরাধীন বাঙালি জাতিকে সংগ্রামী হওয়ার প্রেরণা যুগিয়েছিলেন।
১৯৬৬ সালের ৫ ফেরুয়ারি বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেন ঐতিহাসিক ছয়দফা। বাঙালির মুক্তি সনদ বা ‘ম্যাগনাকার্টা’ বলে কথিত ছয় দফা মূলত ছিল স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক পরিকল্পনা। একাধিক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ‘৬ দফার মাধ্যমে আমি তোমাদেরকে সাঁকো তৈরি করে দিলাম। তোমাদের দায়িত্ব হচ্ছে এই পারে (স্বাধীনতা) পৌঁছা।’ ১৯৭০ সালের ডিসেম্বরে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ওই বছরের ৭ জুন বঙ্গবন্ধু ঘাষণা করেন, ‘আসন্ন নির্বাচন হবে ছয়দফার প্রশ্নে গণভোট।’ বাস্তবেও তাই ঘটে। জনগণ ছয়দফার পক্ষে ঐতিহাসিক রায় প্রদান করে। এ কারণে নির্বাচনের পর পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বঙ্গবন্ধুর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে নানা টালবাহানা করে। বঙ্গবন্ধুকে তার ছয় দফা থেকে সরে দাঁড়াতে নানা অপচেষ্টা চালায়। কিন্তু বঙ্গবন্ধু ছিলেন অনড়। আর পাকিস্তানিরা বুঝে নিয়েছিল, ছয়দফা বাস্তবায়ন মানেই বাঙালির স্বাধীনতা।
বঙ্গবন্ধু অবশেষে ছয় দফার মূল নির্যাস এক দফার ডাক দিলেন। ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণে সুস্পষ্টভাবে বলেন, ‘রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দিব। এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাআল্লাহ।’ তিনি আরও বলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ অতঃপর ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করলেন, ‘আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন’। এই ভাষণেই তিনি সমস্ত বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধভাবে সশস্ত্র লড়াইয়ে অংশগ্রহণের আহ্বান জানিয়েছিলেন প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলা এবং যার যা কিছু আছে তা নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করার জন্য প্রস্তুত থাকতে বলার মধ্যে স্বাধীনতা অর্জনের সেই সশস্ত্র প্রত্যয়ই ঘোষিত হয়েছিল। এমনকি ‘আমি যদি নাও থাকি’ কিংবা ‘আমি যদি হুকুম দেবার না পারি’ উচ্চারণের মধ্যে ছিল জাতির মুক্তি আন্দোলনে নিবেদিত অন্যান্য নেতাকর্মী ও আপামর জনতার ওপর নির্ভর করার আত্মবিশ্বাস। প্রকৃতপক্ষে, ৭ মার্চের ভাষণে তিনি বাঙালি জাতিকে মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রস্তুত থাকার চূড়ান্ত নির্দেশ দেন।
বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সাড়া দিয়ে বাংলার সর্বস্তরের মানুষ জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধভাবে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী ও বীরত্বপূর্ণ সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে ত্রিশ লাখ শহিদের আত্মত্যাগ ও দুই লাখ মা বোনের সম্ভ্রমহানির বিনিময়ে ১৬ ডিসেম্বর বাঙালি জাতি কাক্সিক্ষত বিজয় লাভ করে। বিশ্বের মানচিত্রে নতুন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের আত্মপ্রকাশ পুরোটাই বঙ্গবন্ধুময়। জাতির পিতার অন্যতম স্বপ্ন ছিল সোনার বাংলা বিনির্মাণ। কিন্তু স্বপ্নের সোনার বাংলা নির্মাণযাত্রা ছিল নানাভাবে কণ্টকাকীর্ণ ও বিপদসংকুল। যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশ, ভৌত-অবকাঠামো, রাস্তাঘাট-ব্রিজ-যানবাহন, বিদ্যুৎ, টেলিফোন, প্রায় সবকিছুই বিনষ্ট বিধ্বস্ত। প্রশাসন ছিল অসংগঠিত। বৈদেশিক মুদ্রার শূন্য ভাণ্ডার ও ভারসাম্যহীন আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, নিঃস্ব ও সহায়-সম্বলহীন কোটি শরণার্থীর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন ও পুনর্বাসন চ্যালেঞ্জ, বন্যা, খাদ্যাভাব।
এমন প্রতিকূল পরিস্থিতিতে দেশের দায়িত্বভার গ্রহণ করে বঙ্গবন্ধু যখন খাদ্যাভাব দূরীকরণ, সামাজিক অস্থিরতা নিরসন, আইন-শৃঙ্খলার উন্নতিতে নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ এবং যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে পুনর্গঠন করার জন্য বিভিন্ন উন্নয়নমুখী নীতি ও আইন প্রণয়ন করে দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন, ঠিক তখনি ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করে বঙ্গবন্ধুর সেই স্বপ্ন বাস্তবায়ন হতে দেয়নি ঘাতকেরা। একজন ব্যক্তি মুজিবকে হত্যা করা যায়, কিন্তু তার আদর্শ এবং স্বপ্নকে হত্যা করা যায় না। জাতির পিতার অসমাপ্ত স্বপ্নগুলো বাস্তবায়ন করে চলেছেন তারই সুযোগ্য কন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা।
ছাপান্ন হাজার বর্গমাইলের বাংলাদেশ নামক ভূখণ্ডের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের জন্য আজীবন সংগ্রাম করে যাওয়া মানুষটির নাম শেখ মুজিবুর রহমান। পিতা-মাতা আদর করে ডাকতেন খোকা বলে। ২০০৪ সালে বিবিসি বাংলার জরিপে বঙ্গবন্ধু সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি হিসেবে নির্বাচিত হন। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আমরা একটি স্বাধীন দেশ পেয়েছি। তাঁর স্বপ্ন আজ বাস্তবায়নের পথে ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত, আধুনিক ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ। তাই বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ যেন দেহ ও আত্মার মতো এক অবিচ্ছেদ্য অংশ আমাদের কাছে।
লেখক : পুলিশ সুপার, নৌ-পুলিশ, সিলেট অঞ্চল