গত কয়েকদিন পর্যন্ত ফেসবুকে একটি ছবি ভাইরাল হয়েছে। ছবিটি বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সদ্যনিয়োগপ্রাপ্ত ভিসি অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ বদরুজ্জামান ভূঁইয়ার। তিনি সদ্যনিয়োগপ্রাপ্ত হলে তাকে অনেকেই অভিনন্দন জানিয়ে ফুলেল শুভেচ্ছায় সিক্ত করেছেন। যতগুলো ফুলের তোড়া পেয়েছেন, এসব ফুলের মাঝে বসে ছবি তুলে ফেসবুকে পোস্ট করলে এ ছবি নিয়ে কেউ কেউ তার রুচিবোধ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। আবার কেউ কেউ তার পক্ষে অবস্থান নিয়ে মন্তব্য করেছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষক মন্তব্য করেছেন, ‘বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন ভিসি রুচির বন্যা বইয়ে দিয়েছেন। যারা নিয়োগ দিয়েছেন তাদের রুচিরও প্রশংসা না করে পারছি না।’
এ ছবিটি পোস্ট করে বঙ্গবন্ধু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয়ের এক শিক্ষক মন্তব্য করেছেন, ‘নিজেরে করিতে গৌরব দান নিজেরে কেবলি করি অপমান…।’ কেউ একজন ফেসবুকে লিখেছেন, ‘বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের নবনিযুক্ত ভিসি ফুলের রাজ্যে বসে আছেন। কাজের আগেই তৈলাক্ত স্বীকৃতি।’
আবার একজন তার ফেসবুকে লিখেছেন, ‘ফুলের তোড়ার মাঝে যিনি বসে আছেন তিনি বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের নবনিযুক্ত ভাইস চ্যান্সেলর। ক্ষমতার পাশে তেলবাজ চামচারা এভাবেই সবসময় তেলবাজি করতে তোড়া হাতে হাজির হয়। আর ক্ষমতার চেয়ারে বসা ব্যক্তি সেই তেল চুকচুক করে চেটে খায়। তা না হলে কোনো ব্যক্তিত্ববান লোক কখনো এভাবে ছবি তুলে তা ফেসবুকে পোস্ট করে না।’ আবার একজন মন্তব্য করেছেন, ‘বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের নবনিযুক্ত ভিসি ফুলের রাজ্যে বসে আছেন। তেল আরো লাগবে?’
একজন তার ফেসবুক ওয়ালে লিখেছেন, “বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির জন্য এত কম ফুল সুশোভন কী!!! হরপ্রসাদ শাস্ত্রীজি বেঁচে থাকলে লিখতেন ‘তৈল’-এর নবসংস্করণ ‘পুষ্পতৈল’ জাতীয় কিছু। অথবা যদি মহান লেখক আহমদ ছফার হায়াত দীর্ঘ হত, লিখতে পারতেন ‘ঋষভ বিত্তান্ত’। ববির ভিসির এই ছবি পাবলিক ভার্সিটির সামূহিক অধঃপাত-এর অযুত নগ্নচিত্রের একটি..।”
একজন তার ফেসবুক ওয়ালে ছবিটি পোস্ট করে মন্তব্যে লিখেছেন, ‘ভিসি সাহেব যে ফুলের জেয়ারে ভাসছেন, তা অচিরেই কণ্টকশয্যা হতে বাধ্য। কারণ যারা ফুল দিয়েছেন, তারা সহসাই ফুলের মূল্য চুকাতে চাইবেন। ভিসি মহোদয় অভিনন্দনের বদলা দিতে গিয়ে ফতুর হয়ে যেতে পারেন। তখন ভিসি মানে ভাইস চ্যান্সেলর নয়, ভেরি চিপ হবে।
ডভসি মহোদয়ের পক্ষে অবস্থান নিয়ে এক পুলিশ কর্মকর্তা তার ফেসবুকে মন্তব্য করেছেন, ‘আপনার এত জ্বলে কেন.. জনাব…..। বিশ্ববিদ্যালয়ের একজনের শিক্ষকের জন্য ভিসি হওয়াটা নিঃসন্দেহে একটি স্মরণীয় ঘটনা। একজন সরলচিন্তার স্বাভাবিক মানুষ তার লক্ষ্যে পৌঁছলে তাকে তার স্বজন-শুভানুধ্যায়ীরা ফুলেল শুভেচ্ছায় অভিনন্দিত করেন এটা মোটামুটি একটি স্বাভাবিক বিষয়। সেটির ছবি তোলা হয় এবং সে ছবি যদি কেউ তার টাইমলাইনে দেন তো সেটা দোষের কী এবং এর মাধ্যমে কী রসাতলে গেল আমি বুঝলাম না। মানুষ স্বভাবগতভাবেই স্মৃতিকাতর, মানুষ তার জীবনের কোর স্মৃতিগুলো ধরে রাখতে চায়, এটা স্বাভাবিক। সেটা যদি কারো কষ্টের কারণ না হয়, সেটা যদি দুর্বিনীত না হয়, সেটার মধ্যে যদি কোন দৃষ্টিকটু লোকদেখানো ভাব না থাকে তাতে কারো কারো এত জ্বলে কেন!!’
বরিশাল বিশ^বিদ্যালয়ের এক শিক্ষক লিখেছেন, ‘সম্ভবত ফুল পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর এবং পবিত্র জিনিস, তা বনফুল হলেও। কেউ যখন কাউকে ফুল দেয়, তখন সবচেয়ে সুন্দর জিনিসটাই দেয়। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের মাননীয় উপাচার্য স্যার যখন ট্রেজারার থেকে ভিসি হিসেবে যোগদান করলেন স্বাভাবিকভাবেই বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের বিভিন্ন অংশীজন ফুলেল শুভেচ্ছা জানান। এর মধ্যে আছে ২৫টি বিভাগ, ৬টি অনুষদ, বিভিন্ন দপ্তর, এবং সহ-শিক্ষা কার্যক্রমের সাথে জড়িত বিভিন্ন সংগঠন।
সাধারণত কাউকে ভালোবেসেই ফুল দেওয়া হয়। অবশ্য আমাদের দেশের সংস্কৃতিতে ইদানীং স্বার্থসিদ্ধির নিয়তেও ফুল দেয়। আমাদের ভিসি স্যারকে দেওয়া ফুল নিয়ে একটা ছবি ভাইরাল হয়ে গেল। আপাত: দৃষ্টিতে ছবিটা দেখতে অনেকের খারাপ লাগতে পারে। তবে, বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অংশীজন হিসেবে বলতে পারি, এখানে স্বার্থসিদ্ধিটা নিয়ত বা বাসনা ছিল না। আমি নিজেও উনাকে অভিনন্দন জানিয়েছি, উনার সাথে ছবি শেয়ার করেছি, যেটা আমি সাধারণত করি না। এটা যতটা না ভিসি হিসেবে, তার চেয়ে বেশি একই বিভাগের সমসাময়িক সিনিয়র ভাই হিসেবে। তাছাড়া, একটা বিভাগ বা একটি অনুষদ অথবা একটি সংগঠন একটা নবীন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কী সুবিধাই বা নিতে পারে!
বরং বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বার্থে উনি এমন কিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যেটার স্বীকৃতি এটা। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাইমারি অংশীজনমাত্রই এটা জানেন। উনি রুটিন দায়িত্ব থাকাকালীন বেশ কিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যেটা না হলে বিশ্ববিদ্যালয়কে ঠিক বিশ্ববিদ্যালয় মনে করা যায় না। যেটা আগামীতেও বহাল থাকবে বলে আমার বিশ্বাস। কারণ, এটা নতুন বিশ্ববিদ্যালয়। তার বড় হওয়া দরকার। তার উপর আছে বাংলাদেশের সামাজিক-রাজনৈতিক বাস্তবতা। এরপরও, উদীয়মান একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ভিসি হিসেবে উনার যেকোনো কাজ আতশি কাচের নিচে থাকবে এটা অস্বীকার করা যাবে না। তবে, সমালোচনা করার আগে আমাদের মনে হয় একটু সময় নেওয়া উচিত। উনি কাজ শুরু করেছেন মাত্র। শুরুতেই একটা লোককে হতোদ্যম করে দিলে একটা উদীয়মান প্রতিষ্ঠান কেবলই হোঁচট খাবে। এখানকার অংশীজন হিসেবে আমরা এটা প্রতিনিয়ত টের পাই। এটা সামগ্রিকভাবে কারো জন্যই সুখকর নয়। স্যারের প্রতি শুভকামনা রইল। এগিয়ে যাক বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়।’
এখন আসি আমার মতামত নিয়ে। বিশ^বিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ব্যক্তির আত্মমর্যাবোধ নিয়ে প্রশ্ন তো যে কেউ তুলতে পারেন। আবার তার পক্ষেও যে কেউ অবস্থান করে মন্তব্য করতে পারে। এ মন্তব্য করার সুযোগ থাকাটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তবে আমাদের সমাজব্যবস্থায় রুচির দুর্ভিক্ষ নিয়ে অনেক আগেই তো প্রশ্ন তোলা হয়েছে। কোন কাজটা শোভনীয়, কোনটা শোভনীয় নয়Ñ এমন একটা পরিমিতিবোধ থাকাটা জরুরি। একজন ভিসি কিংবা ট্রেজারারকে মহামান্য রাষ্ট্রপতি নিয়োগ প্রদান করেন। সেক্ষেত্রে মাননীয় ভিসি মহোদয়ের মর্যাদা অনেক উপরে। সেই মর্যাদাবোধ নিয়ে আমাদের ভিসি মহোদয়রা কতটুকু চলেন- এমন প্রশ্ন করা অবান্তর নয়। যেহেতু এ বিষয়টা নিয়ে যারা প্রশ্ন তুলেছেন তাদের অধিকাংশই কিন্তু শিক্ষক সমাজের।
দ্বিতীয়ত, উক্ত ভিসি মহোদয় এর আগে বরিশাল বিশ্ববিদ্যলয়ের ট্রেজারার ছিলেন, ট্রেজারার থাকা অবস্থায়ই তিনি ভিসির পদে স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন। ট্রেজারারের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই কেন ভিসি হিসেবে নিয়োগ দিতে হবে। সেক্ষেত্রে আবার ট্রেজারারের পদটি ফাঁকা হয়ে গেল। আবার এ শূন্যপদে নিয়োগপ্রক্রিয়ার জন্য মহামান্য রাষ্ট্রপতির দারস্থ হতে হবে। তাই এ সময় পর্যন্ত বরিশাল বিশ্ববিদ্যলয়ের ট্রেজারারের পদটি ফাঁকা থাকল, নিয়োগপ্রক্রিয়া সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত এ পদটি শূন্য থাকছে এবং বিশ্ববিদ্যলয়ের কার্যক্রম সুচারুভারে পরিচালনা করতে এ পদটি জরুরিভিত্তিতে পূরণ করা আবশ্যক। তা না হলে উন্নয়ন বিশ্ববিদ্যলয়ের কার্যক্রম কিছুটা ব্যাহত হতে পারে।
এখন আসি বিশ্ববিদ্যলয়ের গভীরতা নিয়ে। বিশ্ববিদ্যলয়ে যারা পড়াশুনা করে কিংবা যারা করান সবাই স্কলার, শিক্ষার্থীরা জুনিয়র স্কলার এবং শিক্ষকরা সিনিয়র স্কলার নামে অভিহিত। তাই বিশ্ববিদ্যলয় হবে জ্ঞানচর্চা ও গবেষণার বাতিঘর। এই আসল কাজ যদি বাদ দিয়ে বিশ্ববিদ্যলয়ে অন্যকিছুর চর্চা হয়, পদ-পদবি নিয়ে যদি তর্ক-বিতর্ক চলে কিন্তু মূল কাজ জ্ঞানচর্চা ও গবেষণার দিকটি যদি উপেক্ষিত থেকে যায় তা খুবই কষ্টদায়ক। আমাদের বিশ^বিদ্যালয়গুলো আন্তর্জাতিক র্যাংকিংয়ে কোন অবস্থানে আছে। যদি বিশ্ববিদ্যলয়েরগুলো জ্ঞানচর্চা ও গবেষণার বাতিঘর হিসেবে কাজ করত তাহলে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আন্তর্জাতিক মানের হত, বিদেশি শিক্ষার্থীরা এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসত।
বরিশালের যেকোনো বিষয় আমাকে আবেগাপ্লুত করে। বাঙালি জাতীয়তাবাদের অবিসংবাদিত নেতা শেরে বাংলার তীর্থভূমি বরিশাল। এ বরিশালে শেরে বাংলা মেডিকেল কলেজ থেকে অনেকেই ডাক্তার হয়ে যুগ যুগ ধরে মানুষের সেবা করে যাচ্ছেন। তেমনি বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও মেধাবী শিক্ষার্থীরা পাশ করে বের হয়ে দেশের কল্যাণে নিজেদের নিয়োজিত করবে- এমন প্রত্যাশা আমরা বরাবর করতে পারি। এ অঞ্চলসহ সারা ভারতবর্ষের মানুষের মধ্যে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে মহান নেতা শেরে বাংলার অবদান আজও আমরা কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করি। তাই বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় যাতে শিক্ষিত ও আলোকিত মানুষ তৈরি করতে পারে- এমন প্রত্যাশা বুকের কোণে পুষে রাখি। আশা রাখি, এক্ষেত্রে ভিসি মহোদয় এক্ষেত্রে তার সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখবেন।
ভিসি মহোদয় ফুলের প্রতি যে অগাধ ভালোবাসা দেখিয়েছেন তা নিয়ে কেউ কেউ তীর্যক মন্তব্য বা কেউ তার পক্ষে অবস্থান করলেও আমার ব্যক্তিগত কোনো ক্ষোভ কিংবা অনুরাগ নেই। তবে ফুল নিয়ে আমার ভাবনা আছে- বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া প্রত্যেকটি ছাত্রছাত্রী ফুলের মতো। এ ফুলগুলো ফুটতে দিতে হবে, সেক্ষেত্রে এ ফুলগুলোর পরিচর্চা করতে হবে। তাই বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়কে জ্ঞানচর্চা ও গবেষণার কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে হলে ভিসি মহোদয়সহ শিক্ষকমণ্ডলী ও স্থানীয় আলোকিত মানুষদের মুখ্য ভ’মিকা পালন করতে হবে। ভিসি মহোদয় তার সর্বোচ্চটুকু দিয়ে শেরে বাংলার তীর্থভ’মিকে আরো আলোকিত করবেন- এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
লেখক : বিশ্লেষক ও সমাজকর্মী