জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষার্থী ফাইরুজ অবন্তিকার মৃত্যুতে সাবেক প্রক্টর মোস্তফা কামালকে তদন্তসাপেক্ষে জবাবদিহির আওতায় আনাসহ নতুন ৬ দাবি জানিয়েছে শিক্ষার্থীরা। এদিকে আজ সোমবার অবন্তিকার আত্মহত্যার ঘটনায় ‘প্ররোচনাদাতাদের’ বিচারের দাবিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষার্থী-শিক্ষকরা ক্যাম্পাসে মানববন্ধন করেন। অপরদিকে, অবন্তিকার আত্মহত্যার প্ররোচনায় সংশ্লিষ্টতা নিয়ে কারো কাছে কোনো তথ্য-প্রমাণ থাকলে তা আগামী দুই দিনের মধ্যে জমা দেওয়ার অনুরোধ করেছে তদন্ত কমিটি।
জানা যায়- অবন্তিকা ১৪ নভেম্বর একটি আবেদন দেন প্রক্টর বরাবর। এ আবেদনের বিষয়বস্তু- ‘উত্ত্যক্তকারীর দীর্ঘদিনের হয়রানিমূলক আচরণের সুষ্ঠু বিচার ও প্রতিরোধ প্রসঙ্গে’ ছিল। এছাড়া চির্ঠিটি আইন বিভাগের চেয়ারম্যানের মাধ্যম হয়ে প্রক্টর বরাবর পৌঁছেছে। এক্ষেত্রে সেই আবেদনটিকে কতটুকু গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে সেই সময়ের প্রক্টর সেটিও খতিয়ে দেখা জরুরি বলে মন্তব্য করেছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কিছু শিক্ষক।
আবেদনে উল্লেখ আছে- ক্যাম্পাসে অবন্তিকার চলাচলের পথে রায়হান সিদ্দিকী আম্মান ‘অশ্লিল ও কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য করে’। এ ধরনের যৌন হয়রানিমূলক অভিযোগ কেন প্রক্টর যৌন নির্যাতন প্রতিরোধ কমিটির নিকট উপস্থাপিত হল না? কী উদ্দেশ্যে তিনি এটা করলেন? শিক্ষার্থীর অভিযোগের ভিত্তিতে সাবেক প্রক্টর কী কী ব্যবস্থা নিয়েছেন- তা জবাবদিহিতার আওতায় আনা দরকার। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করলে হয়তো বের হয়ে আসবে- জবির অনেক ছাত্রছাত্রীরা মনে করেন। এছাড়া এ রকম একটি স্পর্শকাতর বিষয় সমাধানের জন্য কেনই বা একজন নারী সহকারী প্রক্টরকে বাদ দিয়ে একজন পুরুষ সহকারী প্রক্টরকে দেওয়া হল- তা নিয়েও অনেক শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা প্রশ্ন তুলেছেন।
এদিকে, অবন্তিকার আত্মহত্যার ঘটনায় ‘প্ররোচনাদাতাদের’ বিচারের দাবিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষার্থী-শিক্ষকরা আজ সোমবার মানববন্ধন করে সুষ্ঠু বিচারের দাবি জানিয়েছেন। তাদের দাবি, যাদের কারণে ফাইরুজ সাদাফ অবন্তিকা আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছে, তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনতে হবে। এই দাবিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষার্থী-শিক্ষকরা সোমবার দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের শহিদ মিনারের সামনে থেকে পদযাত্রা করেন। পুরো ক্যম্পাস ঘুরে ফের শহিদ মিনারে এসে তারা মানববন্ধনে মিলিত হন। অবন্তিকার মৃত্যুর ঘটনায় সুষ্ঠু তদন্ত চেয়ে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা বক্তব্য দেন সেখানে।
শিক্ষার্থীরা বলেন, আম্মান তাকে অনলাইন ও অফলাইনে ‘হুমকির ওপর রাখতেন’ এবং সহকারী প্রক্টরকে অভিযোগ দেওয়ার পর তিনিও ‘হুমকি ধমকি দিয়েছেন’ এমন অভিযোগের কথা লিখে গেছেন অবন্তিকা। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র উপদেষ্টা ইয়াসুনুল কবির মনে করেন, ‘একটি উজ্জ্বল নক্ষত্রের পতন’ ঘটল। অবন্তিকা শেষ পর্যন্ত তার অবস্থা আমাদের যদি জানাত, তাহলে হয়ত আমরা তার মানসিক অবস্থা বুঝে সাহায্য করতে পারতাম। অবন্তিকার সমস্যার বিষয়ে কিছু জানতেন না বলে আফসোস করেন আইন বিভাগের শিক্ষকরা।
এ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক নূরনাহার মজুমদার বলেন, আমাদের বিভাগে কোনো অভিযোগ করেনি, সে অভিযোগ করেছিল প্রক্টর বরাবর। সে আমাদের মৌখিকভাবে কিছু অভিযোগ করেছিল সহপাঠীদের বিরুদ্ধে। আমরা সে ব্যাপারে তাদের সাথেও কথাও বলেছি এবং তাদের সতর্ক করে বলা হয়েছে। পরবর্তীতে সে সরাসারি প্রক্টরের কাছে অভিযোগ জানিয়েছে। আইন বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক সরকার আলী আক্কাস বলেন, অবন্তিকার মৃত্যুতে আইন বিভাগে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। আমাদের বিভাগের মেধাবী ছাত্রী অবন্তিকার মৃত্যুর সাথে যারা জড়িত তাদের বিচারের দাবি জানাই।
অপরদিকে, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষার্থী অবন্তিকার আত্মহত্যার ঘটনায় সাবেক সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলামের সংশ্লিষ্টতা নিয়ে কারো কাছে কোনো তথ্য-প্রমাণ থাকলে তা আগামী দুই দিনের মধ্যে জমা দেওয়ার অনুরোধ করেছে তদন্ত কমিটি। তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক মো. জাকির হোসেন গণমাধ্যমকে এ তথ্য জানান।
অবন্তিকার আত্মহত্যার ঘটনা তদন্তে বিশ্ববিদ্যালয় গঠিত পাঁচ সদস্যের কমিটি আজ সোমবার দ্বিতীয়বার বৈঠকে বসে। বৈঠক শেষে কমিটির সদস্য সচিব ডেপুটি রেজিস্ট্রার অ্যাডভোকেট রঞ্জন কুমার দাসের স্বাক্ষরে একটি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষার্থী ফাইরুজ অবন্তিকার আত্মহত্যার ঘটনায় অভিযুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যানেজমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের সহকারী অধ্যাপক দ্বীন ইসলামের সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি তদন্ত পূর্বক প্রতিবেদন পেশ করার জন্য একটি উচ্চপর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে প্রকৃত ঘটনার বিষয়ে তথ্য ও উপযুক্ত প্রমাণাদি প্রয়োজন। কারো নিকট কোনো তথ্য ও উপযুক্ত প্রমাণ থাকলে তা আগামী ২০ মার্চের মধ্যে তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক মো. জাকির হোসেনের নিকট জমা প্রদান করে তদন্তে সহযোগিতা করার জন্য বিশেষভাবে অনুরোধ করছি।
জবি ছাত্রছাত্রীদের দাবিগুলো- অবিলম্বে তদন্ত করে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছাত্র আম্মান সিদ্দিকী ও শিক্ষক দ্বীন ইসলামকে স্থায়ী বহিষ্কার করতে হবে, অভিযুক্তদের সাথে সংশ্লিষ্ট তৎকালীন প্রক্টরিয়াল বডি, প্রক্টর মোস্তফা কামালসহ সবাইকে তদন্ত সাপেক্ষে জবাবদিহিতায় আনতে হবে, পূর্বে ঘটে যাওয়া সকল নিপীড়নের বিচার দ্রুততম সময়ের মধ্য নিশ্চিত করতে হবে, অতিদ্রুত সময়ে নিরপেক্ষ নিপীড়ন দমন সেল গঠন করতে হবে এবং প্রতি বিভাগে বিভাগে অভিযোগ বাক্স স্থাপন করতে হবে, বিশ্ববিদ্যালয়ে স্পেশালিস্ট মনোবিশেষজ্ঞ নিয়োগ দিতে হবে : ইন্টার্ন দিয়ে চলবে না, প্রশাসনের দেওয়া প্রতিশ্রুত আগামী ৭ কর্মদিবসের মধ্য উপস্থাপিত দাবি বাস্তবায়ন করতে হবে।
প্রসঙ্গত, শুক্রবার রাতে কুমিল্লা নগরের বাগিচাগাঁও এলাকার অরণি নামের ভাড়া বাসায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন অবন্তিকা। আত্মহত্যার আগে তিনি ফেসবুক স্ট্যাটাসে মৃত্যুর জন্য সাবেক সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলাম ও সহপাঠী আম্মানকে দায়ী করেন। এরপর দায়ীদের বিচারের দাবিতে আন্দোলন শুরু করে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। রাতেই জবি প্রশাসন অবন্তিকার সহপাঠী ও সহকারী প্রক্টরের বিরুদ্ধে আইনগত পদক্ষেপ নেওয়ার আশ্বাস দেয়। পরদিন তাদের গ্রেপ্তার করে ডিএমপি।