কে? কারা ওখানে? হঠাৎ সাজি আতকে উঠে বলল। সেদিন ছিল স্নিগ্ধ আকাশ। ভরা পূর্ণিমার রাত। নারিকেল গাছের মাথার উপর ডাবের মতো রুপালি চাঁদটা কী অপরূপই না দেখাচ্ছিল। শহরের এক কোণে ছোট্ট একখণ্ড জমির উপর সাজির বাড়িটা। দাদার হাতের নারিকেল গাছ দুটো আজও মাথা উচু করে দাঁড়িয়ে আছে। এটাই তার হাতের শেষ চিহ্ন। নারিকেল গাছের পাতার ফাঁকে ফাঁকে চাঁদ তার মুঠি মুঠি জোছনা যেন ছুড়ে মারছিল সাজির উঠানে। যদিও শহরের নিয়ন আলোর ঝলকানিতে জোছনা তেমন উপভোগ করা যায় না।
সাজি বাতায়ন খুলে এলোকেশে বসলো দখিনা বাতাসে। ঝির ঝির বাতাসে চুলগুলো উড়ছিল কাঁধের উপর। সে নজরুল সঙ্গীত শুনছিল আর গুনগুন করে গাইছিল গানের সাথে। এমন সময় হঠাৎ সাজির চোখ পড়ল নারিকেল গাছের পাশে থাকা ছোট্ট ঝোপের দিকে। মনে হল গাছের আড়ালে কারা যেন দেখছে ওকে। খানিকক্ষণ পরোখ করল সাজি। না, কাউকে দেখতে পেল না। হয়ত মনের ভুল। এই ভেবে আবার সে জানালার পাশে বসে গানের সাথে সাথে গাইতে শুরু করল।
মাঝে মাঝে পাশের বাড়ি জামাল চাচার ফুলের বাগান থেকে হাসনা হেনার সুবাস ভেসে আসেছিল। মাতাল করে তুলছিল সাজির মন। সাজি ময়ূরীর মত ডানা মেলে গাইতে শুরু করল, মিষ্টি আহা কী মিষ্টি ফুলের সুবাস! গাইতে গাইতে আবারও চোখ পড়ল সেই ঝোপের দিকে। সত্যি সত্যিই কার যেন একটা ছায়া দেখতে পেল। সে নিজেকে আড়াল করে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। হ্যাঁ, ঠিকই তো দেখেছে সে। ৫-৭ জনের জটলা। কৌতূহল আরো বেড়ে গেল সাজির। এরা কারা? এখানে কী করছে? আমাকে দেখতেই হবে। তাই সে নিঃশব্দে পদার্পণ করল বাড়ির বাইরে। না, একটা নয়, পাঁচ-ছয়টা ছায়ামানব। কখনও স্বচ্ছ দেখছে, আবার কখনও হারিয়ে ফেলছে আলো ছায়ার মাঝে। ওরা সাজিকে দেখে দ্রুত হাঁটতে শুরু করল। সাজিও তাদের অনুসরণ করতে থাকল। সাজি কখনও রাতের গভীরে এমন দৃশ্য দেখেনি।
শুনেছে শহরে নাকি রাতের আঁধারে নানা রকম খেলা চলে। কীসের খেলা? কী খেলা? তা আজ দেখার জন্য কৌতূহলী হয়ে পড়ল। তাই সে ছুটতে থাকল ওদের পিছু পিছু। ওরা হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে গেল এক গলিতে। গলির উপর দেয়ালে লেখা ছিল নিশাচোরা গলি। তার চোখ পড়ল লেখার দিকে। অদ্ভুত নাম তো। এমন নাম সে কখনও দেখিনি। ওদের অনুসরণ করতে করতে পৌঁছে গেল ওদের গন্তব্যস্থলে। সে খুব সাবধানে নিজেকে সামলিয়ে দেখার চেষ্টা করল। সে হতভম্ব হযে গেল। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে তার কষ্ট হচ্ছিল। শহরের নিশিচোরা গলির দৃশ্য দেখে। মাতাল যুবকের বেসামাল জোড়া জোড়া চোখ। তার বুকের ভিতর কেঁপে উঠল। সত্যিই কি মানুষ? নাকি ছায়ামানব? লাল জোড়া চোখগুলো ছিল ঢুলু ঢুলু। গলির পাশ দিয়ে ছোট ছোট টোঙ দোকান। খুবই সাধারণ দোকানগুলো। কোনো জিনিসের সাজসজ্জা নেই। শুধু পান বিঁড়ি-সিগারেট আর চা-বিস্কুট। কোনো কোনো দোকানে মহিলারা আবার কোনো কোনো দোকানে পুরুষেরা বসে দোকান দিচ্ছে। কিছু যুবক বিড়ির ভিতর কী যেন পুরে পুরে ঠোঁট চেপে চেপে সুখটান দিচ্ছে। হয়ত প্রতি সুখটানের ধোয়ার কুণ্ডলীর সাথে সাথে বিলীন হচ্ছিল কত যুবকের কত স্বপ্ন। নেশায় ঢুলু ঢুলু হয়ে পড়ে ছিল যেখানে সেখানে। আহা! কী শান্তির ঘুম। কিন্তু কেন? জোড়া জোড়া নেশার চোখগুলোতে সাজি দেখতে পেল তার ভাইয়ের ছবি। ডুকরে কেঁদে ওঠে তার মন। তার ভাই সাদমান সতেরো বছর বয়সে শহিদ হন স্বাধীনতা যুদ্ধে।
নেশাচোরা গলির একটু পেছনে যেয়ে থমকে দাঁড়াল সাজি। একটা সুগন্ধি তাকে মোহাচ্ছন্ন করল। এত রাত্রে কীসের সুগন্ধি? না, এটা কোনো ফুলের নয়, এটা তো পারফিউমের সুগন্ধি। সুগন্ধি ছড়াতে ছড়াতে কে যেন হন হন করে ছুটে চলেছে গলির ভিতর। সে উৎসুক চোখে জিজ্ঞেস করল, কে? কে তুমি?এত রাত্রে কোথায় হেঁটে চলেছ? পিছন ফিরে এক ঝলক হেসে জবাব দিল আমি ক্ষুধার্ত নিশিগন্ধ্যা। মানে? জিজ্ঞেস করল সাজি।মানে বুঝলে না? মানে, আমি দেহপসারিণী। নিসঃঙ্গ নিশুতরাতের সঙ্গী। হাসনাহেনার মতো আমিও রাতে গন্ধ্যা বিলাই। এই বলে সে একটা অট্টহাসি দিয়ে চলে গেল। সেই হাসি স্বাভাবিক কোনো হাসি ছিল না। হাসির অন্তরালে যেন একবুক বেদনার ইঙ্গিত। সাজির মন আরো ভারাক্রান্ত হয়ে উঠল। ভরাক্রান্ত মন নিয়ে সাজি তাদের অনুসরণ করতে করতে এগিয়ে চলল। নেশাচোরা গলির পাশে ছিল রেলস্টেশন। হঠাৎ যুবকগুলোকে হারিয়ে ফেলল সাজি। পাগলের মতো খুঁজতে থাকল। ঐ তো ওরা। কোথা থেকে এল? খানিকটা পথ যেতেই একটা নারীকণ্ঠের চিৎকার সাজির কানে ভেসে আসল।
ছেড়ে দে। আমাকে ছেড়ে দে। আমার খুব খিদে পেয়েছে। সাজি খুঁজতে থাকল কে চিৎকার করছে। সে দেখতে পেল স্টেশনে পড়ে থাকা একটা পাগলীকে টেনে-হেঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে একদল মদিরামত্ত যুবক। থমকে দাঁড়াল সাজি। তার পা আর উঠল না। পা দুটি যেন তার নিথর পাথর। তাদের কামুক রসে ভিজিয়ে দিল লাল-সবুজের পতাকা।
নিজের চোখকে বিশ^াস করতে পারল না সাজি। এটাও কি সম্ভব? নাকি শহরের নিশুত আঁধারে খেলা। কাঁচের মতো সব বিশ্বাস ভেঙে খান খান হয়ে গেল। বেজন্মা জোড়া জোড়া জোঁকগুলো দিনের বেলায় রক্ত চুষে খাচ্ছে জননীর বুক চিরে। আর রাতে খেলা জমায় চোরাগলিতে। হায়রে স্বাধীনতা আমার! এই জন্যই কি তুই জীবন দিয়ে ছিলি ভাই? তোর জীবনের প্রতিদানে আমাকে এসব দেখতে হবে তা কখনও ভাবতেই পারিনি। সাজির বুক হু হু করে কেঁদে উঠল। নিঃসঙ্গ রাতের আলো-আঁধারি খেলায় ঘৃণার দীপশিখা জ্বলে উঠল সাজির চোখে।
গলির পশ্চিম দিকে কযেকশ গজ দুরে একটা হুতোমপেঁচার কান্নার সুরে সাজির বুকটা কেঁপে উঠল। কাছেই যেয়ে দেখল হুতোমপঁচা নয়, একটা ছায়ামানবী। পাগলীর মতো কুন্তলীগুলো পিঠের উপর ছড়ানো। গায়ের কাপড় ছেঁড়া ছেঁড়া। সারা শরীরে হায়েনার হিংস্র দাঁত ও নোখের আঁচড়। ফ্যাল ফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল সাজির দিকে। নির্বাক কণ্ঠ। সেই চোখে হাজারও প্রশ্নের ভিড়। যেন কৈফিয়ত চাইছে ৩০ লক্ষ মানুষের আত্মদানের কৈফিয়ত, মা বোনের সম্ভ্রম হারানোর কৈফিয়ত। ভাই সাদনানের আত্মত্যাগের কৈফিয়ত খুঁজছে অবরুদ্ধ মুক্তির পথ। যেন আসামির সন্দিগ্ধ চোখ। পাগলীর বোবা কান্নার গোঙানিতে যেন প্রকম্পিত সাগরের ঢেউ। সাজির বুকের ভিতর আগুনের দাবানল দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠল। খানিকটা দাঁড়িয়ে থেকে নিজেকে শান্ত করল। আস্তে আস্তে নীলিমা আকাশে ভোরের তারাটার আলো ক্ষীণ হতে থাকল। আকাশটা আস্তে আস্তে ফর্সা হতে থাকল। আর দেখা মেলেনি ছায়ামানবের।
সাজি ভাবল বাড়ি ফিরবে। তাই সে ব্যথাতুর চিত্তে হাঁটতে থাকল। নিঃসঙ্গ রাতের সঙ্গীরা সাজির গায়ে মুড়িয়ে দিল বিষাদের মোড়ক। রাতের সাথে জেগে থাকা জোছনা মলিন হয়ে গেল। সাজির দু’চোখ ভিজে গেল নোনাজলে। তার স্বপ্নাতুর চোখে এখন ধোঁয়াটে আকাশ। রাতে আলো-ছায়ার আড়ালে স্বাধীনতাও গুমরে কাঁদে। নক্ষত্রের আলো নিবু নিবু। আবছা আবছা আলো-আঁধারে হারিয়ে গেল দূরাকাশের তারা। আস্তে আস্তে দিনের আলোয় মিশে গিরগিটিরা।
নিশুত রাতের সঙ্গীরা ঢুলু ঢুলু চোখে গড়িয়ে পড়ল বিছানায়। সাজির রাতজাগা নেত্রদ্বয় ক্লান্ত হয়ে আসল। স্বাধীনতার নীরব কান্নায় ভিজে গেল বাংলার মাটি। সাজি অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল চোরাগলির দিকে।