কয়েকদিন আগে ঝিনাইদহ জেলার শৈলকুপা উপজেলায় বঙ্গবন্ধুর রাত কাটানো স্মৃতিবিজড়িত ঘরটি সম্পর্কে সংসদে কথা বলেছিলেন সংরক্ষিত মহিলা আসন ৯-এর সংসদ সদস্য শৈলকন্যা পারভীন জামান কল্পনা। তাঁর কথায় অনুপ্রাণিত হয়ে শুক্রবার (৮-০৩-২০২৪ ) অনেক আগ্রহ নিয়ে খাঁ খাঁ রৌদ্র শরীরে মেখে- সেই ঘরটাকে একটু স্পর্শ করে নিতে চেয়েছিলাম- দেশের জন্য যে মানুষের সপরিবারের বলিদান হলো তাঁর হৃদয়ের স্পর্শ পাব বলে অনেক বাসনা নিয়ে পা বাড়াই বাড়িটির দিকে। গ্রামের অনেক লোকও সঠিকভাবে বাড়িটির সন্ধান দিতে পারে না। অবশেষে অনেক খোঁজাখুঁজি করে আবিষ্কার করা গেল বাড়িটি। যে বাড়িটি হতে পারত গোটা গ্রাম তথা ঝিনাইদহ জেলার কেন্দ্রবিন্দু অথচ এই বাড়িটি সম্পর্কে অনেকে জ্ঞানই রাখেন না। কারণ বাড়িটিকে আমরা নতুন প্রজন্মের কাছে সেভাবে তুলে ধরতে পারিনি। কিন্তু সেই স্মৃতি আজ মলিন। ব্যর্থতা আর হতাশাময় হৃদয় নিয়ে ফিরে এসেছিলাম আমি আর কবি বায়েজিদ চাষা। আমাদের মনের মধ্যে একটা কথায় বারংবার আলোড়িত হচ্ছিল একাজ কল্পনা আপা করলেন কী করে- বঙ্গবন্ধুর যে স্মৃতিকে তিনি আঁকড়ে ধরে রাখবেন, ঘরটাকে সংরক্ষণ করবেন। কারণ এই ঘরে জাতির পিতা রাত কাটিয়ে ছিলেন, এই ঘর আমাদের ইতিহাস সাক্ষী। আমাদের তরুণ প্রজন্ম দলে দলে দেখতে যাবে আর আঙ্গুল উচিয়ে বলবে এই ঘরে, এই সেই ঘর এই ঘরে আমাদের জাতির স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাত্রিযাপন করেছিলেন। এই স্মৃতির সাথে কল্পনা আপার বাবা কামরুজ্জামানের স্মৃতিও তো জড়িত ছিল। অথচ সেই স্মৃতির অবশিষ্ট আজ আর কিছু নেই। সেখানে একতলা ওয়াল উঠেছে। এক রুমে একটা খাট পাড়া আছে, অন্য রুমে কিছু জিনিসপত্র রেখে দিয়েছেন। অনেকেই বাড়িটি দেখতে আসেন। কিন্তু বাড়িটিতে সেই পুরাতন ঘরটি আর নেই। বর্তমানে বাড়িটির একপাশে বসবাস করছেন বাড়ির মালিক প্রয়াত অধ্যক্ষ কামরুজ্জামানের ভাতিজা আশফার আহমেদ বেলাল দম্পতি।
এই ঘরটি তৎকালীন পাকিস্তানের জাতীয়, প্রাদেশিক পরিষদ ও স্বাাধীন বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের সাবেক সদস্য এবং আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য প্রয়াত অধ্যক্ষ কামরুজ্জামানের বসত বাড়ি। তৎকালীন পুর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট প্রার্থী অধ্যক্ষ কামরুজ্জামানের পক্ষে নৌকা প্রতিকের প্রচরণায় তিনি এই অজপাড়াগাঁ বাখরবা গ্রামে এসেছিলেন। ঝিনাইদহ-শৈলকুপা-হরিনাকুণ্ডু আসনে যুক্তফ্রন্টের নৌকা প্রতিকের প্রার্থী ছিলেন তিনি। সেই নির্বাচনে প্রচারণার জন্য বঙ্গবন্ধু এখানে এসেছিলেন। তিনি ট্রেনযোগে ঢাকা থেকে কুষ্টিয়া হয়ে খোকসা আসেন। পারে দলবল নিয়ে গড়াই নদী পার হয়ে বাখরবাতে আসেন। বাড়ির পাশে একটি পুকুরে গোসল করেন। দুপুরে খওয়া-দাওয়া শেষে বিকালে কাতলাগাড়ী বাজারে নির্বাচনি জনসভায় ভাষন দেন। রাতে কামরুজামানের বাড়িতে রাত্রি যাপন করেন। সকালে তিনি ঝিনাইদহের উদ্দেশ্যে রওনা দেন। এ সময় তার সঙ্গে ছিলেন আওয়ামীলীগ নেতা মহিউদ্দিন ও শেখ আজিজ। (তথ্য : বহুমাত্রিক. কম অনলাইন)
সেই পুরাতন ঘর সম্পর্কে জানতে চাইলে পাশের বাড়ির এক ভদ্র মহিলা জানালেন গতবছর কল্পনা আপাই তো পুরাতন ঘর ভেঙে নতুন এই ঘরটি তৈরি করেছেন। অথচ মহান সংসদে কল্পনা আপা বললেন বাড়িটি আজ সংরক্ষণ করার সময় এসেছে। সংরক্ষণ করার আগেই তো তা নতুন বিলিং দখল করে নিয়েছে। সব জানার পরেও তিনি আজ সংরক্ষণ করবেন। কী সংরক্ষণ করবেন? এমন নানা প্রশ্ন আমার মনে উদিত হয়েছিল। বার বার চাষাকে বলছি আপা এমন কাজ করল কী করে? হতাশা আর ভাঙা মন নিয়ে আমরা ছুটে চলেছি কাতলাগাড়ির দিকে। কাতলাগাড়ি বাজার হয়ে চলেছি গড়াইয়ের অববাহিকা দেখার জন্য। এই কাতলাগাড়ি ঘাটে বসে পুরাতন স্মৃতি মন্থনে কিছুটা বুকের মধ্যে প্রশান্তি কাজ করেছিল। এবার আমরা টলারে চেপে গড়াই নদী (গড়ই নদী) পার হয়ে পৌঁছে গেলাম চাঁদট ঘাটে এটা শৈলকুপা ছেড়ে খোকসার মধ্যে পড়েছে। গ্রামীণ আবহে কিছুটা বটের তলে প্রশান্তির বাতাস শরীরে লাগিয়ে জেলেদের জালের সুনিপুণ কারুকার্য দেখতে দেখতে আবারও আমরা ফিরে আসি কাতলাগাড়ি ঘাটে। এখানেই চলে সাহিত্যের চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধারের নানা বাহানা। গ্রামীণ বাজারে ঘুরে ঘুরে আমি আর বায়েজিদ অবলোকন করি নানা জিনিসপত্র, এই বাজারেও যেন আগের মতো সেই আগ্রহ নেই, কি যেন এখন বাজারগুলোতেও নেই, চারিদিকে শূন্যতা বিরাজ করে। এখন সব করপোরেট করপোরেট মনে হয়। এরই মধ্যে কবি অনীক সিদ্দিকীর ফোন- তার বাড়িও কাছে। গোসাইডাঙা যেতে হবে। চেপে বসি ভ্যানে- আমরা কবির বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে চলেছি খালের পাশের রাস্তা দিয়ে, এই রাস্তার ধারে দীর্ঘদিন যে বৃক্ষ চোখে পড়েনি সেই বাবলা বৃক্ষের সমারোহ। আগে রাস্তার ধারে প্রচুর বাবলা বৃক্ষ ছিল এখন আর দেখা মেলে না- ছোটবেলায় এই বাবলার পাতা চিবিয়ে মিষ্টি করেছি মুখ। সেই সুখময় স্মৃতি আজও হৃদয় খোঁড়লে বাজে। এই অঞ্চলে এই বিলুপ্তপ্রায় বৃক্ষ দেখে ভালই লাগল। অনীক সিদ্দিকীর সাথে আ্ডা মেরে আমরা আবার চলে আসি কাতলাগাড়ি বাজারে।
আগেও শুনেছি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শৈলকুপা এসেছিল কোথায় এসেছিল জানাছিল না- কবি বায়েজিদ চাষারও জানা নাই যে শৈলকুপা বঙ্গবন্ধু এসেছিল। সে তার বাবার মুখে শুনেছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কুষ্টিয়া এসেছিল- কিন্তু নিজ অঞ্চলে যে জাতির মহান নেতা এসেছিলেন তা তাদেরও জানা নাই। তবে এটুকু জানাছিল যে কাতলাগাড়ির এই দিকেই কোথাও হবে। কারণ এই কাতলাগাড়ি স্কুলমাঠে একবার বঙ্গবন্ধুকে স্মরণ করে একটা আর্ট ক্যাম্পেরও ব্যবস্থা করা হয়েছিল। আমরা সেই জায়গাই দেখতে গিয়েছিলাম- যেখানকার আলো-বাতাস মেখেছেন এই মহান নেতা শরীরে। ছুটে গিয়ে ছিলাম রাজনৈতিক ব্যক্তি কামরুজ্জামান সাহেবের বাড়িতে যে বাড়িতে বঙ্গবন্ধু দুই রাত অবস্থান করেছিলেন। যে ঘরে ছিলেন সেই ঘরও গত বছর ভেঙে সেখানে নতুন ঘর তৈরি হয়েছে। সেই পুরাতন ঘরের টিন দিয়ে পাশে বেড়া দেওয়া হয়েছে। ঝিনাইদহ শহর থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরে শৈলকুপার বাখরবা গ্রামে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্মৃতি বহন করে চলেছে একটি বাড়ি। ৭০ বছর আগে এক রাজনৈতিক জনসভায় যোগ দিতে এখানে এসেছিলেন তিনি। কিন্তু সংস্কারের অভাবে বাড়িটি এতোদিনে জীর্ণদশায় পরিণত হয়েছিল। কিন্তু যে পুকুরে তিনি গোসল করেছিলেন সেই পুকুরের অবস্থা নাজুক। যে খাটে তিনি ঘুমাতেন সেই খাট, থালা, চেয়ারের অস্তিত্বও নাই।
জানা যায়, ১৯৫৪ সালে তৎকালীন প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট মনোনীত প্রার্থী প্রয়াত অধ্যক্ষ কামরুজ্জামানের পক্ষে নির্বাচনি প্রচারণায় কুষ্টিয়ার খোকসা হয়ে ঝিনাইদহের শৈলকুপার বাখরবা গ্রামে আসেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সন্ধ্যায় কামরুজ্জামানের বাড়িতে রাত্রিযাপন করে সকালে তার বাড়ির পুকুরে গোসল শেষে দুপুরে পাশেই কাতলাগাড়ী বাজারে জনসভায় যোগ দেন বঙ্গবন্ধু। সভা শেষ করতে সন্ধ্যা হওয়ায় সে রাতও তিনি এই বাড়িটিতে থেকে যান। পরদিন সকালে সেখান থেকে ঢাকার উদ্দেশে রওনা দেন তিনি।
সেই ঘর এবং একটি চৌকি দীর্ঘদিন বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি হিসেবে থাকলেও তা আজ অতীত। ঘরটির সব কিছুই সে সময়কার। তবে যে প্লেটে জাতির জনক খেয়েছিলেন তা এখন নেই। আর যে চেয়ারে তিনি বসেছিলেন সেটিও কয়েক বছর আগে চুরি হয়ে গেছে। তবে তার ব্যবহৃত শোবার চৌকিটিও সরেজমিনে আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়নি। তবে সেই পুরাতন ঘরের চালের টিন দিয়ে বাড়ি ঘেরার কাজ করা হয়েছে।
সে সময়কার বাড়িটির ঐতিহ্য ধরে রাখতে বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি বিজড়িত ঘরে একটি পাঠাগার বা জাদুঘর হতে পারত। যে মাটিতে বঙ্গবন্ধু এসেছিলেন সেটি হতে পারত তাঁর স্মৃতি বিজড়িত বঙ্গবন্ধু ও কামরুজ্জামান জাদুঘর অথচ আজ এই বাড়ির মেয়ে জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত মহিলা আসন ৯-এর সংসদ সদস্য। তবুও তিনি ঘরটি রক্ষা করতে পারলেন না। বঙ্গবন্ধুর স্মৃতির সাথে নিজের বাবার স্মৃতিও হলো মলিন। তিনি (পারভীন জামান কল্পনা) সংসদে রাষ্ট্রপতির ভাষণের উপর বক্তব্য রাখতে গিয়ে বাড়িটির কথা উল্লেখ করেন। কিন্তু দুঃখের ব্যাপার গতবছর কল্পনা আপা নিজেই পুরাতন ঘরকে ভেঙে সেখানে নতুন ঘর তৈরি করেছেন।
শৈলকুপার কাতলাগাাড়ি’র যে স্কুলমাঠে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ভাষণ দিয়ে ছিলেন সেই স্মৃতিকে ধরে রাখতেই ঝিনাইদহের সাবেক জেলা প্রশাসক সরোজ কুমার নাথ স্মৃতি ফলকটি ১৭ মার্চ ২০২৩ নির্মাণ করেন। স্কুলমাঠের চারিদিকে বড় বড় ইটের প্রাচীর উঠেছে। সংকুচিত হয়েছে মাঠের সীমানা। তবুও কিছু সময় আমরা এই মাঠের প্রান্তে দাঁড়িয়ে নিতে চেয়েছি সেই মহান নেতার কিছুটা গায়েবি স্পর্শ। আর মনে মনে বলেছি, এই মহান নেতা মানুষের জন্য কোথায় জাননি। বাংলাদেশের মানুষের জন্য দেশের একপ্রান্ত হতে অন্যপ্রান্তে, এক অঞ্চল হতে অন্য প্রান্তে ছুটে বেড়িয়েছেন। একেই বলে নেতা, একেই বলে সত্যিকারের জনগণের বন্ধু। যে কারণে তিনি হতে পেরেছেন বঙ্গের বন্ধু।
লেখক : কবি ও গবেষক