আমরা দেশে এত সুন্দর সুন্দর নামের ফসল তরিতরকারি খেয়ে ক্ষুধা মিটায় তা কিভাবে আসে এক চিমটি ভাবছেন? ফুলের মত ফুলকপি, তৃণ সবুজ কাঁচামরিচ, লাল টমেটো, লাউ, পেপে, বেগুন, কড়লা, শিম, কচু, পটল, ঝিঙা, মুলা, পুইশাক, লালশাক ও পালঙশাক ইত্যাদি কেমনে হয়? আজ আমি একজন বিজ্ঞ কৃষক সম্পর্কে বলব। যিনি সব কৃষিতে অবিজ্ঞ। যিনি একজন কৃষি শিল্পী! কতশত পরিশ্রম করে নিজের ছেলেমেয়ের মত লালনপালন করে আমাদের জন্য তরিতরকারি উৎপাদন করেন। বিষয়টা সহজ নয়! এটাও এক রকমের ইঞ্জিনিয়ার! কেন ইঞ্জিনিয়ার বললাম? আসুন জানি বিজ্ঞ কৃষক রফিক চাচা সম্পর্কে।
প্রচণ্ড শীতের ঠাণ্ঠায় আপনি যখন লেপের নিচে নিদ্রায় বিভোর। তখন রফিক চাচা কুয়াশা-মাখানো বিলের মাঝে কাজ করছে। নিজের সন্তানের মত মায়া ভরে যত্ন নিচ্ছে সোনার ফসলে। আপনি আমার কাছে শীত মানে কতকিছু! কিন্তু রফিক চাচার কাছে শীত মানে ফুলকপি, বাঁধাকপি, টমেটো, মুলা ও শিম ক্ষেতে কৃষি বুদ্ধিজীবীর মতো কাজ করা। দেশে খাদ্য সরবরাহ করা। যে মাঠে কাজ করছে সে মাঠে সামনে দশ ফুট স্পষ্ট নয়। অদৃশ্য মান একেবারে। এতো তীব্র কুয়াশা আর ঠান্ডা যে হাত টনটন করবে আপনার। আঙ্গুল কনকনে ঠাণ্ডায় ভাজ পড়ে যায়। কিন্তু না উনার মনোযোগ কাজে। শীত কুয়াশা ঠাণ্ডা এসবে তাঁর নজর নেই।
কাঁচামরিচ যে খান! জানেন কী কত পর্যায়ে এই চাষ হয়? প্রথমে সঠিক জায়গা নির্ধারণ করা। খনন করে বিজ ছিটিয়ে ফেলতে হয়। চারা গজায় কিছুদিন পর। সেই চারা অন্য জায়গায় রোপণ করা হয়। প্রতিদিন পানি দেওয়া। একটু একটু সতেজ হওয়া। নতুন পাতা গজানো। বড় হতে হতে একসময় কলি ফুল ছোট্ট ছোট্ট মরিচ! আহ! মরিচ ধরে যখন ক্ষেত পরিপূর্ণ হয়। মরিচের ঘ্রাণ আসে নাকে। আপনার ঠিক জীবনানন্দের কথা মনে পড়বে, ‘এই পৃথিবীতে এক স্থান আছে।’ কবি এসব দেখেই পাগল হয়েছিলেন। মরিচে ভরে গাছ নুয়ে পড়লে রফিক চাচা হাতে ধরে ধরে আদর করে। ঠিক যেভাবে নিজের সন্তানদের সোহাগ করে।
ভোরবেলা কুয়াশার টপ টপ ফুটার নিচ দিয়ে করলা ক্ষেতে ফুল লাগাতে যায়। প্রতিটা ফুলের পাশে গিয়ে ফুলের মাথায় জরি লাগাতে হয়। কুয়াশায় ভিজে একাকার হয়ে যায়। তারপর আসে মিষ্টি কুমড়ার মাঠে। সবুজ শ্যামল মাঠে কুমড়োর ফুল ফুটে কাজী নজরুলের ‘ঝিঙেফুল’ কবিতার মতো। হলদে হয়ে যায় মাঠ। একটা একটা করে খুঁজে খুঁজে জরি লাগিয়ে কুমড়োকে খাওয়ার উপযোগী করে তুলে। সেখানে আবার বিভিন্ন প্রাণীর ভয়। পাহাড়ি ক্ষেতে হাতি, বন্যশূকর ও সজারু ইত্যাদি এসবে ক্ষেত-কামারে হানা দেয়। ফসল নষ্ট করে কৃষকের কপালে হাত দিতে বাধ্য করে। জীবন কঠিন!
বর্ষাকালে পানিতে টইটম্বুর সব। আপনি আমি বাসায় ঘুম। টিভির সামনে ব্যাস্ত নয়তো হাতে মোবাইল। অথবা পরিকল্পনা করছি কি করা যায় এই পুকুরডুবা বর্ষায়! তখন রফিক চাচা ভাঙা ছাতা নিয়ে চলে গেছে পাহাড়ে! যেখানে মৃত্যুর গন্ধ ছড়ায়। পাহাড় ধসে পড়ে। বনের মস্ত বড় হাতি হাঁক ছাড়ে। বন্যকুকুর ও হিংস্র প্রাণীর ভয়! পানিতে ঝিরিপথ ও গিরিপথ নদীর মতো হয়ে গেছে। রাস্তা কোথায় চিনার বিন্দুমাত্র রেশ নেই। সেই পানি পার হয়ে রফিক চাচা বাগানে পেয়ারা আনতে যায়। গভীর জঙ্গলে বৃষ্টির ফুটা পড়ছে মাথায় চোখে মুখে। তবুও রফিক চাচা থেমে নেই গাছে উঠে পেয়ারা ছিড়ে। নির্দিষ্ট সময়ে ৭০ কেজি ওজনের বোঝা বহন করে বাজারে এনে বিক্রি করতে হবে। জসিমউদদীনের “রুপাই” কবিতার কথা চিন্তা করুন!
রফিক চাচা আবার ধান উৎপাদন করেন। যে ধান থেকে চাল আসে। আমরা চিবায় চিবায় খায়। এই ধান সহজে চালে পরিণত হয় না। কঠোর পরিশ্রম করতে হয়। কষ্টের পর কষ্ট করে যখন রফিক চাচা সকালে ধানের সবুজ গায়ে পিউর পরিস্কার কুয়াশা দেখে, মন অজান্তেই হেসে উঠে। জড়িয়ে ধরে বুকে। নিঃশ্বাস নেয় বড় বড় করে। আসমানের দিকে চেয়ে থাকে। এক সময় গাছে শিষ আসে। ধান হয়। তবে ভয় আছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেই ‘সোনার তরী’ কবিতার কৃষকের মত। কখন বৃষ্টি আসে। কখন বন্যা আসে। লালিত পালিত করে তুলা ধানকে গ্রাস করে ফেলবে। বহু চিন্তা হতাশা পেরিয়ে যখন ধান বাড়িতে আসে। উঠান পরিপূর্ণ হয় ধানের স্তূপ। তখন নতুন চালের পিঠা বানায়। গ্রামের সবাই মিলে খায়। আহ আনন্দ!
রফিক চাচা আবার তরমুজ ও বাঙ্গির চাষও করে। তপতপে রোদে পাহাড়ের ঢালে। পানি কাঁধে নিয়ে উঠতে হয়। প্রতি গাছের গুঁড়ায় গুঁড়ায় পানি দিতে হয়। কি তীব্র রোদ। খা-খা করছে পাহাড়। মানুষ এসি রুমে নিঃশ্বাষ নিতে পারে না। সেই রোদে রফিক চাচা বারোজোনা (জায়গার নাম) পাহাড়ের উঁচুতে পানি তুলে তরমুজ বাঙ্গি চাষ করে। তরমুজ ধরার পরে কাটলে গড়গড়ে লাল যখন দেখে সমস্ত আর্তনাদ দুঃখকষ্ট গায়ের ঘাম চলে যায়। হাসি ফুটে তৃষ্ণাময় ঠোঁটে। ক্ষেতের তরমুজ খেয়ে তৃষ্ণা মিটায়। কেটে কেটে সবাইকে খাওয়ায়। শহর থেকে বড় বড় আড়তদার গিয়ে পুরো ক্ষেত কিনে ফেলে। একত্রে টাকা পেলে সে কী উল্লাস! গরু কিনে। মেয়ে বিয়ে দেয়। ঘরবাড়ি ঠিক করে।
রফিক চাচা আবার মসলা চাষও করে। আদা হলুদ ও পিঁয়াজের চাষ করে। আপনি গভীর বর্ষায় আদা ক্ষেতের পাশে দাঁড়িয়ে থাকলে এক অদ্ভুত নেশায় হারিয়ে যাবেন। কী সুললিত গ্রাণ! চমৎকার অনুভূতি! আদা গাছে ফুল আসে। ফুল বিক্রি করে। আদা ও হলুদ মাটির নিচে পড়ে। এক ফালা তুল হাতে নিলে দেখবেন আহসান হাবীবের কবিতা সেই ‘অস্ত্রের মতো’ তাকিয়ে আছে। তবে ভয়ের নয় আশার অস্ত্র! হা হা হা! কী প্রফুল্ল সূর্যমুখীর ন্যায় আদা ও হলুদের ফালা। পিঁয়াজ গাছের গন্ধে মাতোয়ারা! রফিক চাচা যেন ফসলের দার্শনিক! তিনি একাধারে সব ফসল তৈরি করতে পারেন। দেশের কাঁচা বাজারে অবদান রাখতে পারেন। মানুষের ক্ষুধা নিবারণ করেন।
এছাড়াও রফিক চাচার জাতীয় ফল কাঁঠালের গাছ আছে। লিচু, আম, কুল, কলা, পেপে এবং পেয়ারা বাগান আছে। সকালের সূর্যদয়ের আগে ঘুম থেকে উঠে। নামাজ বাদ যায় না। সন্ধ্যায় সূর্য ডুবা পর্যন্ত সোনার দেশের সোনার মাঠে সোনার ফসল তুলে সোনার স্বদেশের মানুষের জীবিকা মিটায়। সহস্র কষ্ট, দুর্দশা, হতাশা, হাসি, কান্না, সুখ ও দুঃখ নিয়ে রফিক চাচার জীবন। কেউ কিছু চাইলে খালি হাতে ফেরত দেন না। মানুষ মরলে কবর খনন করতে ভুলেন না। জানাজায় উপস্থিত হতে ভুলেন না। নামাজে বসে প্রার্থনা করতে ভুলেন না। সনাতন বা ভিন্ন ধর্মের বন্ধু ও প্রতিবেশীর সাথে নিদারুণ ভাব। মারা গেলে গোরস্থানের পাশে কাঁদে। একে অপরকে ভালোবাসে সম্মান করে। বিপদ-আপদ পাশে কাছে সঙ্গে থাকে। রফিক চাচারা বেঁচে থাকুক হাজার বছর।
লেখক : শিক্ষার্থী, সরকারি সিটি কলেজ, চট্টগ্রাম