লালনের ভাষাভাবনা

: রেজাউল করিম
প্রকাশ: ৯ মাস আগে

বাংলাভাষার বিকাশের ইতিহাস মসৃণ নয়। বাংলাভাষার উপর দিয়ে বহু ঝড়-তুফান বয়ে গেছে বিশেষ করে বাংলায় মুসলিম শাসন সূচনা হওয়া এবং মুসলমানদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায়। বাংলায় যারা মুসলিম শাসক ছিলেন তারা সকলেই ছিলেন মধ্য এশিয়া ও মধ্য প্রাচ্যের লোক। তাদের মাতৃভাষা ছিল আরবি, ফারসি, তুর্কি। যে সমস্ত পির, আউলিয়া, সুফি, দরবেশ বাংলায় ধর্মপ্রচার করতে এসেছেন তাদের ভাষাও ছিল আরবি, ফারসি। শাসক সম্প্রদায় এবং পির, আউলিয়া, সুফি, দরবেশ ও ধর্ম প্রচারকেরা বাঙালি মুসলমানের কাছে খুবই সম্মান ও শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন। ইসলাম ধর্মের ন্যায় আরবি ফারসি ভাষাও ছিল বাঙালি মুসলমানের কাছে পবিত্র। অভিজাত মুসলমানরা বাংলাকে হিন্দুর ভাষা বলে ঘৃণা করতে থাকেন আর আরবি-ফারসির প্রতি প্রীতি দেখাতে থাকেন। শুরু হয় বাংলাভাষার বিরুদ্ধে ধর্মীয় ফতোয়া দেওয়া। বাংলাকে হিন্দুর ভাষা, গেঁয়োর ভাষা বলে নিন্দা করা হতে থাকে। নিন্দা ও ফতোয়াকে খণ্ডন করতে অনেক বাঙালি কবি-সাহিত্যিক এগিয়ে আসেন। তাঁদের অন্যতম ছিলেন কবি শাহ মুহম্মদ সগীর, কবি সৈয়দ সুলতান, কবি আবদুল হাকিম ও লালন ফকির। আরবি ফারসি ও নাগরি ভাষা যখন বাংলা ভাষার উপর চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে তখন কবি গুরু লালন সাঁইজি এর প্রতিবাদে গাইলেন-

বাংলা কেতাব কতই জনা পড়ে

আরবি ফারসি নাগরি বুলি কে বুঝিতে পারে

শিখবি যদি নাগরি বুলি

আগে বাংলা লওগা পাস করে।।

(আবদেল মাননান সম্পাদিত অখণ্ড লালনসঙ্গীত, রোদেলা, ফালগুন ১৪২২, পৃ. ৩০৮)।

আরবি ফারসি ভিনদেশি ভাষা। সকলের পক্ষে ভিনদেশি ভাষা আত্মস্থ করা কঠিন। তখন মুসলমানরা স্থানীয় ভাষার সাথে আরবি ফারসির সমন্বয় ঘটিয়ে ভারতে নতুন দুইটি ভাষার উদ্ভব ঘটান। উত্তর ভারতে উর্দু এবং পূর্ব ভারতে নাগরি ভাষা। উর্দু ছিল হিন্দির বিকল্প এবং নাগরি ছিল বাংলার বিকল্প। আরবি, ফারসি, কাইথি, বাংলা ও দেবনাগরি লিপির সংমিশ্রণে চতুর্দশ শতকের প্রথম দশকে সিলেটি নাগরি লিপির উদ্ভব ঘটে। মধ্যযুগে বিশেষ করে হযরত শাহ জালালের সিলেট বিজয়ের পর সিলেট ও আসামের কাছার ও করিমগঞ্জে নাগরি বুলি ও নগারি লিপির প্রচলন ও প্রভাব বেড়ে যায়। এ লিপির প্রচলন ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা ও কিশোরগঞ্জ অঞ্চলে লক্ষ্য করা যায়। সংস্কৃত ও বাংলা ভাষা ও লিপিকে মুসলমানরা হিন্দু সম্প্রদায়ের ভাষা ও লিপি মনে করত। হযরত শাহজালাল ও তাঁর ৩৬০ অনুসারী বাংলায় আউলিয়া নামে অভিহিত। তাঁরা আরবি ও ফারসি ভাষার সঙ্গে সিলেটের স্থানীয় ভাষার সংমিশ্রণে এক মুসলমানি বাংলা ভাষার প্রচলন করেন, তা সিলেটি নাগরি ভাষা বা নাগরি বুলি, নাগরি লিপি, জালালাবাদী নাগরি, মুসলমানী নাগরি নামে পরিচিত। সিলেটের তৎকালীন মুসলমান লেখকগণ বাংলার পরিবর্তে এই লিপিতেই ধর্মীয় বিষয়সমূহ চর্চায় স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন। আহমদ হাসান দানীর মতে সিলেটে মুসলমান শাসনের শুরু থেকেই সিলেটি নাগরীর ব্যবহার চলে আসছে। এর বর্ণমালা ছিল ৩২টি এবং তা ডান থেকে বাম দিকে পড়তে হতো।

মুসলমানরা তাদের নবোদ্ভাবিত সিলেটি নাগরিতে পুস্তক রচনা শুরু করেন। ১৮৬০-৭০ খ্রিস্টাব্দের দিকে সিলেটি নাগরী ছাপাখানা স্থাপনের পর থেকে এর প্রসার শুরু হয়। ‘সিলেট ইসলামিয়া ছাপাখানা’ এরূপ প্রথম প্রেস এবং মৌলবি  আবদুল করিম টাইপ নির্মাণ ও প্রেস স্থাপনের প্রথম উদ্যোক্তা। পরে প্রতিষ্ঠিত ‘সিলেট শারদা প্রিন্টিং প্রেস’, কলকাতার ‘শিয়ালদহ হামিদী প্রেস’ ও গার্ডেনার লেনস্থ ‘জেনারেল প্রিন্টিং ওয়ার্কস’ থেকেও এ লিপিতে পুথিপত্র প্রকাশিত হতে থাকে। সিলেটি নাগরির পহেলা কেতাব এবং সিলেটি নাগরি লেখা নামক দুটি গ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে এ লিপির ব্যবহার বৃদ্ধি পায়।

সিলেটি নাগরিতে লিখিত উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হচ্ছে সাধক কবি গোলাম হুছনের তালিব হুছন (১৫৪৯)। পরে ফাজিল নাসির মোহাম্মদ রাগনামা (১৭২৭), সৈয়দ শাহ নূর (১৭৩০-১৮৫৪) নূর নছিহত (১৮১৯), রাগনূর, সাতকন্যার বাখান, শাহ হুছন আলম (১৭৫০-১৮৫০) ভেদসার, শীতালাং শাহ (মৃত্যু. ১৮০০) মুশকিল তরান, হাসর তরান, রাগবাউল, কেয়ামতনামা, শীতালাঙ্গী রাগ, নছিম আলী (১৮১৩-১৯২০) হরুফুল খাছলাত (১৮৭৫), মুন্সী মোহাম্মদ সাদেক আলী হালতুন্নবী (১৮৫৫), মহববতনামা, হাসর মিছিল, রদ্দেকুফুর ইত্যাতি গ্রন্থ রচনা করেন। আবদুল করিম রচিত কড়িনামা, ছদছী মছলা, সোনাভানের পুঁথি খুবই জনপ্রিয় ছিল। এযাবৎ প্রাপ্ত তথ্যে ষাটজন লেখকের মুদ্রিত ও পান্ডুলিপি মিলিয়ে ১৫০খানা গ্রন্থের সন্ধান পাওয়া গেছে। লেখকের নামবিহীন জনপ্রিয় পুথিগুলির মধ্যে হরিণনামা, হুশিয়ারনামা, সফাতুন্নবী, আবু সামা, নূর নাজাত, পেঁচার গল্প  ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। (বাংলা পিডিয়া)।

আরবি ছিল ইসলাম ধর্মের ভাষা, আর ফারসি ছিল রাজভাষা, নাগরি ছিল আউলিয়ার ভাষা, আর বাংলা ছিল গাঁও-গ্রামের সাধারণ মানষের ভাষা। ধর্ম বিশ্বাস বা রাজভক্তির কারণে মানুষ আরবি-ফারসি-নাগরি ভাষায় কেতাব বা বই পড়ে, কিন্তু বুঝতে পারে না। বুঝতে পারলেও কয়জনা পারে? দু’একজন বুঝতে পারে। মায়ের ভাষা বাংলায় তা পড়লে অতি সহজেই বুঝতে পারে। তাই বিদেশী ভাষা শিখো আপত্তি নেই, কিন্তু তার আগে মাতৃভাষা শিখে নাও। এ কথা বলতে গিয়ে সাঁইজি বলেছেন যে, শিখবি যদি নাগরি বুলি/ আগে বাংলা লওগা পাস করে।

ব্রিটিশ সরকার ১৮৩৫ সালে ফারসির স্থলে ইংরেজিকে ভারতের রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা করেন এবং ১৮৩৭ সালে তা কার্যকর হয়। শুরু হলো বাংলা শিক্ষা বাদ দিয়ে বাঙালিদের ইংরেজির পেছনে ছোটা। বাংলাভাষা পড়ে যায় বিপাকে, হয়ে পড়ে অবহেলিত। তখন লালন সাঁইজি বলে উঠলেন-

বাংলা শিক্ষা করো মন আগে

ইংরেজিতে মন তোমার রাখো বিভাগে

বাংলা না শিখে, ইংরেজিতে মন দিয়ে

লালন করছে পাসের ভাবনা।।

বিদেশি ভাষা শিখে পরীক্ষায় পাস করা যায়। কিন্তু তা মায়ের ভাষার মতো সহজ সাবলীল হয় না, প্রাণ খুলে মনের ভাব প্রকাশ করা যায় না। আত্মার আনন্দ ও সাবলীলতা রয়েছে মাতৃভাষায়, বিদেশী ও বিজাতীয় ভাষায় নয়। লালন সাঁইজি ইংরেজি ভাষা শিখতে নিষেধ করেন নি। তবে তার আগে মাতৃভাষা বাংলা আয়ত্ত করার কথা বলেছেন। বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ‘আমার ছেলেবেলা’ প্রবন্ধে অনুরূপ কথা বলেছেন, “আগে চাই বাংলা ভাষার গাঁথুনি, তারপরে ইংরেজি শেখার পত্তন।” অথচ রবীন্দ্রনাথের বহু আগে লালন এ কথা বলেছেন।

ভাষায় কোনো পাপ-পুণ্য নেই। ঈশ্বরের নিজস্ব কোন ভাষা নেই। মানুষের সকল ভাষাই ঈম্বরের ভাষা। মানুষ যে ভাষাতেই কথা বলুক না কেন তা বুঝতে ঈশ্বরের অসুবিধা হয় না। কবি আবদুল হাকিম (১৬২০-১৬৯০) তাঁর ‘বঙ্গবানী’ কবিতায় বলেন,

যেই দেশে যেই বাক্য কহে নরগণ

সেই বাক্য বুঝে প্রভু আপে নিরঞ্জন।

মানবতার কবি লালন ফকিরও অনুরূপ কথা বলেছেন,

আরবিতে বলে আল্লাহ ফারসিতে খোদাতায়ালা

গড বলেছে যিশুর চেলা ভিন্ন দেশে ভিন্নভাবে।।

ভাষা মনুষ্যসৃষ্ট। ফলে বিশ্বের একেক অঞ্চলের মানুষ একেক ভাষায় কথা বলে। পরম স্রষ্টাকে কেউ আল্লাহ, কেউ খোদা, কেউ গড, কেউ হরি, ঈশ্বর, ভগবান, জেহবা নামে অভিহিত করে। ভিন্ন ভাষায় ভিন্ন নামে তাঁকে তুলে ধরে। বস্তু একই, কল্পনা এক।ভাষা হচ্ছে মনের ভাব প্রকাশের মাধ্যম। মনের ভাব প্রকাশের জন্য ভাষার সৃষ্টি। ভাষা জানলেই স্রষ্টা জানা হয় না, নিজকে জানা হয় না, এমনকি জ্ঞানও হয় না। ভাষা বাক্য দিয়ে অধর মানুষ, মনের মানুষ, অচিন মানুষ বা পরমাত্মাকে পাওয়া যায় না। এর জন্য দরকার হয় সাধনা, থাকতে হয় অন্তর্দৃষ্টি। লালন বলেন,

মনের ভাব প্রকাশিতে ভাষার সৃষ্টি এ জগতে

অচানক অধরকে চিনতে ভাষা বাক্যে নাহি পাবে।।

লেখক : লালন গবেষক, সহযোগী অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ, সরকারি রাজেন্দ্র কলেজ, ফরিদপুর। 

  • রেজাউল করিম
  • #