ওষুধ শিল্প ও ভেজালের দৌরাত্ম্য

: অলোক আচার্য
প্রকাশ: ১১ মাস আগে

ভেজাল অ্যানেসথেসিয়ায় শিশুর মৃত্যুর ঘটনার পর আবারও ভেজাল ওষুধের বিষয়টি সামনে এসেছে। প্রাণদায়ী ওষুধ যখন প্রাণহরণের কারণ হয় তখন প্রশ্ন জাগতেই পারে আমাদের দাঁড়ানোর জায়গা কোথায়? আমরা ভেজাল খাদ্য খেয়ে অভ্যস্থ হয়ে গিয়েছি। প্রতিদিনই খাচ্ছি। জেনে বা না জেনে খাচ্ছি। সেই ভেজাল খাদ্য খেয়ে আমরা অসুস্থ হচ্ছি। সেই অসুখ ভালো করার জন্য আবার যে ওষুধ বিশ্বাস করে খাচ্ছি এখন সেই ওষুধও নকল বের হয়েছে। খাদ্যে ভেজাল, ওষুধে ভেজাল তাহলে মানুষ যাবে কোথায়? এদিকেও মরতে হবে, ওদিকেও মরতে হবে।

ওষুধ এমন একটি নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের নাম যে এমন মানুষও রয়েছে যার একবেলা ভাত না খেলেও কোনো সমস্যা নেই কিন্তু ওষুধ না খেলে চলে না। প্রতিদিন খরচের একটি অংশ এবং মাসের একটি বড় অংশই চলে যায় ওষুধ কেনার খাতায়। যে সরল বিশ্বাসে আমরা ভালো থাকার জন্য এই খরচ করছি সেই ওষুধ খেয়ে ভালো হওয়ার বদলে অনেকে অসুস্থ হচ্ছেন। কারণ তিনি তো আর জানেন না যে তার বিশ্বাস করে কেনা সেই ওষুধই আসল না ভেজাল বা নকল। এক শ্রেণির অসাধু এবং ভেজাল মানুষ এই জঘন্য কাজটি নির্দ্বিধায় করে যাচ্ছে। মানুষের শেষ ভরসা ওষুধেরও ভেজাল বের করে ফেলেছে। কে সেটা খাচ্ছে আর কে খাচ্ছে না সেটাই বা কে জানে! সারাবছরই অসাধু ব্যবসায়ীরা খাদ্যে ভেজাল দিয়ে আঙুল ফুলে কলাগাছ হন। ওষুধেও যারা এই অপকর্ম করছেন তাদের বিরুদ্ধেও যুদ্ধ ঘোষণা করতে হবে। এরা নিজেদের এত নিচে নামিয়ে এনেছে যে কেবল ঘৃণাটুকুই অবশিষ্ট রয়েছে। মানুষের জীবন এদের কাছে কোনো বিষয় না, খুব তুচ্ছ! সেই নকল ওষুধ তার আত্মীয়-স্বজনদেরও খেতে হচ্ছে। কিন্তু সেই মূর্খরা সেটাই বুঝতে পারছে না। একাধিক চক্র মিলে এই নকল ওষুধের কাজটি করে যাচ্ছে। ভেজাল ও নিন্মমানের ওষুধ খেয়ে রোগ সেরে ওঠার পরিবর্তে রোগ বৃদ্ধি পাচ্ছে। ব্যবসা কিছু অসাধু মানুষের হাত ধরে এমন এক পর্যায়ে পৌছেছে যে তা এখন মাত্রা অতিক্রম করেছে।
যেসব ওষুধ আসল নয় বা সঠিক কাঁচামাল দিয়ে তৈরি নয় সেটাই ভেজাল বা নকল ওষুধ। যে ওষুধ সঠিক কাঁচামাল ছাড়া, মান নিয়ন্ত্রণহীনভাবে তৈরি করা হয় সেটাই হলো নকল ওষুধ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দীর্ঘমেয়াদে গ্রহণ করতে হয় এমন ওষুধই নকলের টার্গেট। সঙ্গে আছে অপারেশনে নিয়মিত ব্যবহার হয় এমন ওষুধ যার দাম একটু বেশি। এসব ওষুধ বাজারজাত হয়ে চলে ভোক্তার পেটে। যারা এর ভোক্তা তাদের ধরার উপায় নেই যে এটি জাল না আসল। কারণ এত সূক্ষ্ম কাজ করা হয় যে তা ধরা সাধারণ মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। ভেজাল দিয়ে তিলে তিলে মানুষকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিচ্ছে যারা তারা সুখে-শান্তিতে জীবনযাপন করছে। বিলাসবহুল অট্টালিকা করছে। ভেজাল ওষুধের সাথে বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ জড়িত আছে। এটা এমন এক চক্র যেখান থেকে সারাদেশে তা ছড়িয়ে পরছে। সমস্যা হলো আমরা যারা রোগী তারা ওষুধের তেমন কিছুই বুঝতে পারি না। নাম দেখে ওষুধ কিনে বাড়ি ফিরে সরল বিশ্বাসে খেতে আরম্ভ করি। আবার যারা লেখাপড়া কেউ জানে না বা স্বল্পশিক্ষিত, তারা তো মুখে মুখে বলেই ওষুধ কিনে খেয়ে নেন। ওষুধের দোকানদারই তাদের ভরসা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে সম্প্রতি নকল ওষুধের এই ভয়ংকর চিত্র বেরিয়ে এসেছে। গ্রেফতার করা হয়েছে। এসব নকল ওষুধ খেয়ে উল্টো কিডনি, লিভার, হৃদযন্ত্র এবং শ্বাসতন্ত্রে মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে বলে জানা গেছে। কেন ভেজাল দেয় বা নকল ওষুধ তৈরি করে? কেবল লাভ আর লোভের বশবর্তী হয়েই তারা এই কাজটি করছে সন্দেহ নেই।
বিশ্ববাজারে বাংলাদেশে তৈরি ওষুধের চাহিদা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। ওষুধ শিল্প একটি গুরুত্বপূর্ণ শিল্প হিসেবে সম্ভাবনা তৈরি করেছে। এক তথ্যে জানা যায়, শতকরা ৯৮ ভাগ ওষুধ দেশে উৎপন্ন হয়ে রপ্তানি হচ্ছে বিশ্বের ১৫৭টি দেশে। অর্থাৎ একটি বিপুল সম্ভাবনার খাত এই শিল্প। মানসম্পন্ন ওষুধ তৈরির জন্য আন্তর্জাতিক মহলে প্রশংসা কুড়ানোর পাশাপাশি ২০১৮ সালে ‘মেডিসিন প্রডাক্ট অব দ্য ইয়ার’ পদকে ভূষিত হয় ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর। অথচ কিছু অসাধু মানুষের লোভের কারণে দুর্নাম কুড়াতে হচ্ছে। এক তথ্যে দেখা যায়, বিশ্বের উৎপাদিত প্রায় ১৫ শতাংশ ওষুধে ভেজাল রয়েছে। যার মধ্যে এশিয়া ও আফ্রিকার কিছু অঞ্চলে ভেজাল ওষুধের পরিমাণ প্রায় ৫০ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। দরিদ্র ও উন্নয়নশীল দেশগুলোতে ভেজাল ও নকল ওষুধের পরিসংখ্যান বেশি।
আমরা বেশিরভাগই নিজের স্বার্থ নিয়েই ব্যস্ত থাকি। প্রতিদিন খাদ্যপণ্যে ভেজাল মিশিয়ে মোটা টাকা লাভ করে একদিকে এসব ব্যবসায়ীরা বাড়ি-গাড়ির মালিক ও সমাজের হর্তাকর্তা বনে যাচ্ছেন। অন্যদিকে যারা এসব পণ্য খাচ্ছে তারা নিত্য অসুস্থ হয়ে ডাক্তারের কাছে দৌড়ে মরছেন। তাতেও শেষ রক্ষা হচ্ছে না। এর থেকে মুক্তির উপায় সহজ নয়। লাভের লোভ ত্যাগ করা অতটা সহজ নয়। এর জন্য প্রয়োজন হয় নিজেদের প্রতি একটু সততা। আমরা জানি কোনটি আমাদের করা উচিত আর কোনটি করা উচিত নয়। দেশপ্রেম অন্তরের বিষয়। ভেতরে দেশপ্রেম না থাকলে এই লোভ ত্যাগ করা অসম্ভব।
নকল ওষুধ পণ্য বা ভেজাল পণ্যে কেবলই বিশ্বাস কাজ করে। মানুষের বিশ্বাস। আর এই বিশ্বাস পুঁজি করেই এসব ভেজাল কারবারীরা মোটা টাকার মালিক হয়ে যান। এত এত টাকার মালিক হওয়া সত্তেও তিনি কিন্তু তার ভেজাল কারবার বন্ধ করছেন না। কেউ মানুষকে হত্যা করছে অস্ত্র দিয়ে আর কেউ বা খাদ্যে ভেজাল দিয়ে তিলে তিলে! মানুষকে অসুস্থ জীবনের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। যার ফলে সংসারে বেড়ে যাচ্ছে চিকিৎসা ব্যয়। একটি সুস্থ জীবনযাপনের বাঁচার যে অধিকার রয়েছে তা থেকে বঞ্চিত করছে এসব নকল মানুষ। তাদের শাস্তি এমন হতে হবে যাতে অন্য কেউ এই কাজ করতে সাহস না পায়। অন্যকে যারা বিষ খাইয়ে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে তারা কঠিনতম শাস্তির হাত থেকে যেন রেহাই না পায়। চীনে ওষুধ এবং খাদ্যদ্রব্যে ভেজাল মেশালে মৃত্যুদণ্ডের বিধান আছে। গতবছর ঔষধ নিয়ন্ত্রণ আইন-২০২২ এর খসড়ায় চূড়ান্ত অনুমোদন দেয় মন্ত্রিসভা। সেখানে ভেজাল এবং নকল ওষুধ তৈরি করলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের বিধান রেখে ‘ঔষধ আইন ২০২২’-এর খসড়ায় চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। নতুন আইনে ‘ঔষধ’-এর সঙ্গে ‘কসমেটিকস’ শব্দটিও যোগ করা হয়েছে। আইনটি এখন থেকে ‘ঔষধ এবং কসমেটিকস আইন-২০২২’ নামে হয়েছে। মুনাফার জন্য যারা জীবনের ঝুঁকি সৃষ্টি করে, তাদের শাস্তির ব্যাপারে কঠোর হতে হবে। ওষুধ প্রশাসনকে বিস্তৃত করতে হবে। মানুষ যাতে মেয়াদ দেখে ওষুধ কেনে, সেই সচেতনতা জাগাতে হবে। যারা ভেজাল ওষুধ তৈরি করে তাদের গ্রেপ্তার করে কঠোর আইন প্রয়োগ করা হোক। তাহলে হয়তো এসব অপরাধ কমে আসবে। এছাড়াও নকল ওষুধ বাজারজাত বন্ধ না করতে পারলে দেশের সম্ভাবনাময় ওষুধ শিল্প হুমকির মুখে পরতে পারে। সুতরাং সময় থাকতে সাবধান হতে হবে।

লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট

 

#