অনেকে ঈদকে উৎসব হিসেবে অভিহিত করেন। কিন্তু উৎসবের সাথে ঈদের ফারাক ঢেড়। ঈদ মানে আনন্দ। উৎসব মানে আনন্দ অনুষ্ঠান। উৎসবে থাকে শৈল্পিক প্রকাশ যা হয় স্বতঃস্ফুর্তভাবে। যেমন- সঙ্গীত, নাচ, নাটক, আবৃত্তি, অভিনয়, মিছিল। সে সাথে থাকে মেলা। উৎসব ও মেলা অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। বর্তমানে ঈদ নামাজ উৎসব বা প্রার্থনা উসবে পরিণত হয়েছে। নামাজের পর এটি সামাজিক উৎসবে পরিণত হলে কতই না ভালো হতো! উৎসবে ধর্ম-বর্ণ থাকে না। থাকে শৈল্পিক আনন্দ, থাকে পারফরম্যান্স। উনিশ শতকে ঈদ উৎসব সামাজিক উৎসবে পরিণত হয়েছিল। বাংলাপিডিয়া উৎসব প্রসঙ্গে মুসলমানদের ঈদ নিয়ে লিখেছে :
উনিশ শতকের শেষ দিকে ঈদের আনুষঙ্গিক আনন্দ হিসেবে যুক্ত হয় একটি নতুন উপাদান লোকায়ত মেলা। ঈদ উপলক্ষ্যে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে মেলার আয়োজন করা হতো। ঈদ উৎসবের একটি প্রধান অঙ্গ ছিল বিশেষ ধরনের খাওয়া-দাওয়া। মফস্বল ও গ্রামাঞ্চলের খাবারের মধ্যে থাকত কোরমা-পোলাও, ঘরে প্রস্তুত নানা রকমের পিঠা, সেমাই ও শিউলি বোটার রঙে মাখানো জরদা। অবিবাহিত মেয়েরা পিঠার উপর আঁকত প্রজাপতি, যা বহুকাল ধরে বাঙালিদের কাছে বিয়ের প্রতীক হিসেবে পরিচিত। ঈদের খাওয়ার তালিকায় প্রধান হয়ে উঠত ঘরে তৈরি মিষ্টান্ন। ঢাকায় উনিশ শতকে ঈদের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল ঈদ মিছিল। সম্ভবত ঢাকার নায়েব-নাজিমগণ ঢাকার বিখ্যাত জন্মাষ্টমী মিছিলের অনুপ্রেরণায় এ মিছিল চালু করেছিলেন।
বিশ শতকের ত্রিশ-চল্লিশ দশকে ঢাকায় ঈদের দিন রমনা, আরমানিটোলা বা অন্যান্য মাঠে ‘খটক’ নাচ অনুষ্ঠিত হত। এছাড়া ছিল নৌকা বাইচ, ঘুড়ি উড়ানো, ঘোড়দৌড়, হিজরা নাচ ইত্যাদি। ঘোড়দৌড় ও হিজরা নাচ ছিল ঢাকার বাবু কালচারের অঙ্গ, যা যুক্ত হয়েছিল ঈদ উৎসবের সঙ্গে। সে সময়ে মুসলমানদের ঈদে গান-বাজনা ছিল একটি প্রধান উপাদান যা স্বতঃস্ফূর্ততার প্রতীক।
ওহাবি প্রভাবে ইসলাম আজ নিরামিশে পরিণত হয়েছে, আরো হচ্ছে। যে সুফিগণ ও সুফিজম ভারতবর্ষে ইসলাম প্রচার ও প্রসার ঘটিয়েছে আজ তাদেরকে কাফির এবং তাদের মতবাদকে কুফরি বলা হচ্ছে।
অথচ হযরত মুহাম্মদ (সা.) নিজেও সঙ্গীত, ক্রিড়াকৌতুক বা আনন্দ বিনোদনমুখী মানুষ ছিলেন। এর স্বপক্ষে অনেক তথ্য প্রমাণ রয়েছে। হযরত আয়েশা (রা.) বলেন, ‘ঈদের দিন দুইটি মেয়ে আমার কাছে দফ (ঢোল) বাজিয়ে গান করছিল। এমন সময় রাসুলুল্লাহ (সা.) ঘরে এসে চাদর মোড়া দিয়ে শুয়ে পড়েন। ইতিমধ্যে হযরত আবু বকর (রা.) আগমন করেন এবং মেয়ে দুইটিকে ধমক দিয়ে বলেন, রাসুল্লাহর গৃহে শয়তানের বাদ্যযন্ত্র! এ কথা শুনে রাসুলুল্লাহ বলেন, হে আবু বকর! তাদেরকে বাধা দিও না, কেননা আজ ঈদের দিন।’ (হযরত ইমাম গাযযালী রহ., সৌভাগ্যের পরশমনি, ২য় খণ্ড, অনূদিত আবদুল খালেক, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, পৃ. ২০৪। মূল গ্রন্থের নাম কিমিয়া সাদত, অনুবাদকৃত নাম সৌভাগ্যের পরশমনি)। হযরত আয়েশা (রা.) একটি মেয়েকে লালন পালন করতেন। অতঃপর তিনি তাকে এক আনসারের সাথে বিয়ে দেন। তিনি মেয়েটিকে তার স্বামীর গৃহে রেখে আসেন। হযরত আয়েশা (রা.) প্রত্যাবর্তনের পর রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁকে জিজ্ঞেস করেন, ‘তুমি কি মেয়েটিকে তার স্বামী গৃহে রেখে এসেছ? উত্তরে আয়েশা (রা.) বলেন, হ্যাঁ। রাসুলুল্লাহ (সা.) আবার জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি এমন কাউকে তাদের বাড়ি পাঠিয়েছ যে গান গাইতে পারে? তিনি বলেন, না। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, তুমি তো জানো আনসাররা অত্যন্ত সঙ্গীতপ্রিয়। (হাদিস নং ৪৭৮৫, বুখারি শরিফ, ৮ম খণ্ড, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, পৃ. ৪৪৫)।
হযরত আয়েশা (রা.) বলেন, আমার পাশে বসে এক দাসী গান গাইছিল। এমন সময় হযরত ওমর (রা.) আগমন করেন এবং ভেতরে প্রবেশের অনুমতি চান। হযরত ওমরের আগমন টের পেয়ে দাসীটি সেখান থেকে পালিয়ে যায়। তিনি ভেতরে প্রবেশ করতেই রাসুল (সা.) মুচকি হাসি হাসছিলেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসুল, আপনি কেন হাসছেন? রাসুল (সা.) এরশাদ করলেন, দাসী আমাদের পাশে বসে গান করছিল। তোমার আগমন টের পেয়ে সে পালিয়ে যায়। হযরত ওমর বলেন, আপনি যা শুনেছেন আমি তা না শোনা পর্যন্ত দাসীকে ছাড়ছি না। অতঃপর মহানবি (সা.) দাসীকে ডেকে গান শোনাতে বললেন। (সাইয়্যেদ আবুল হাসান আলী দাতাগঞ্জে বখ্শ হাজবেরী (র.), কাশফুল মাহজুব, বঙ্গানুবাদ : সুফি মুহাম্মদ ইকবাল হোসাইন কাদেরী, ঢাকা, রশীদ বুক হাইজ, ফেব্রুয়ারি ২০১২, পৃ. ৩৬০)।
লেখক : গবেষক ও বিশ্লেষক