সংস্কৃতি অস্তিত্বে, বহমান জীবনে 

: ইমামুল ইসলাম
প্রকাশ: ১১ মাস আগে

চিন্তার দৈন্যদশা দেখা যাচ্ছে আমাদের সমাজব্যবস্থায়। পহেলা বৈশাখ, নববর্ষ উদযাপন,  মঙ্গল শোভাযাত্রা ও হাওরের ১৪ কিলোমিটার সড়কে আলপনা আঁকা নিয়ে কিছু গোষ্ঠী হিংসা-বিদ্বেষ ছড়ানোর পাশাপাশি বিভিন্ন বিষয়ের অবতারণা করেছেন- যা মোটেই সংশ্লিষ্ট বিষয়ের সঙ্গে প্রাসঙ্গিক নয়। আমরা কেন দুর্নীতি নিয়ে সরব হই না, স্বাস্থ্যখাত কেন পিছিয়ে,  শিক্ষাখাত কেন খাঁদের কিণারে, বুড়িগঙ্গা কেন দূষণমুক্ত করতে পারি না- ইত্যাদি ইত্যাদি বিষয়ের অবতারণা করছেন এসব সংকীর্ণমনা সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী।

আমরা আমাদের নিজস্ব জাতীয়তাবাদ, নিজস্ব সংস্কৃতি কী তা ভালোভাবে চিনতে পারিনি বলেই গভীর এক সংকট প্রজন্মের মধ্যে দিন দিন বাড়ছে। তাই তাদের ভাবনায় সংকীর্ণতা থাকে, ধর্মান্ধতা থাকে, থাকে সাম্প্রদায়িকতার বিষাক্ত নিঃশ্বাস। এজন্যই তারা আমাদের সংস্কৃতির মূল স্রোতধারা নিয়ে প্রশ্ন তুলে, সংস্কৃতির সুস্থধারাকে প্রশ্নবিদ্ধ করার অপচেষ্টা চালিয়ে যায়।

আমাদের দেশে উৎসব পালনের ক্ষেত্রে ধর্মীয় ভাবাবেগ কাজ করে। যেমন মুসলমানদের মধ্যে ইদ, কোরবানি, শবে মিরাজ, শবে বরাত, ইদে মিলাদুন্নবিসহ বিভিন্ন উৎসব পালন করতে দেখা যায়। হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে কালীপূজা, স্বরস্বতী পূজা, লক্ষ্মীপূজাসহ বিভিন্ন পূজায় তারা উৎসব পালন করে, আনন্দ করে। খ্রিস্টান সম্প্রদায় বড়দিন পালন করে, বৌদ্ধদের উৎসব হল বুদ্ধপূর্ণিমা।  এসব উৎসব ধর্মকেই কেন্দ্র করে চলে। এসব উৎসবে সব ধর্মের লোকের অংশগ্রহণের সুযোগ থাকে না।

রাষ্ট্র এমন একটি কাঠামো যেখানে কোনো বিশেষ শ্রেণি বসবাস করে না। রাষ্ট্রকাঠামোতে সব শ্রেণি-পেশার মানুষ থাকে। রাষ্ট্র ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব শ্রেণি-পেশার মানুষকে ধারণ করে, এক্ষেত্রে রাষ্ট্র বৈষম্যমূলক আচরণ করতে পারে না। যেহেতু আমাদের রাষ্ট্রকাঠামোয় বিভিন্ন ধর্ম, বর্ণ ও শ্রেণি-পেশার মানুষের বসবাস, তাই আমাদের রাষ্ট্রকাঠামো অসাম্প্রদায়িক,  এখানে সব মানুষ সমান মর্যাদা লাভ করে।  রাষ্ট্র সব মানুষকে এক কাঠামোয় নিয়ে আসতে হলে প্রয়োজন নিজস্ব সংস্কৃতির চর্চা ও প্রসার। পূর্বেই উল্লেখ করেছি- ধর্মাবরণে যে উৎসবগুলো হয়,  তা দিয়ে দেশের সব মানুষকে এক ছাতার নিচে নিয়ে আশা যায় না। তাই আমাদের রাষ্ট্রকাঠামোতে এমন কিছু উৎসব ও দিবস আছে যা দিয়ে দেশের সমগ্র মানুষকে এক ছাতার নিচে সমবেত করা যায়। স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, মহান একুশে ফেব্রুয়ারির ভাষাশহিদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস,  পহেলা বৈশাখ, বসন্তবরণ, নবান্ন উৎসব ইত্যাদি অনুষ্ঠানে ধর্ম, বর্ণ, দল, মত নির্বিশেষে সব শ্রেণি-পেশার মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করে। এসব অনুষ্ঠানে ধর্ম-বর্ণে বিভাজনের সুযোগ নেই। এসব অনুষ্ঠানের অসাম্প্রদায়িক চেতনা সুসংহত করতে রাষ্ট্র এসব অনুষ্ঠানের পৃষ্ঠপোষকতা করবে এটাই স্বাভাবিক। কারণ এসব অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আমাদের রাষ্ট্রকাঠামোয় বসবাসরত সব নাগরিক একই ছাতার নিচে সমবেত হতে পারে। আর আমাদের রাষ্ট্রকাঠামো উৎসব ও সংস্কৃতি চর্চার এ পরিশুদ্ধ বলয় নিয়ে যারা প্রশ্ন তুলে, তারা মূলত প্রতিক্রিয়াশীল সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী, যারা মানুষে মানুষে বিভাজন সৃষ্টি করে, হিংসা-বিদ্বেষ ছড়ানোর কাজে লিপ্ত থাকে।

বৈশাখ বাংলা বারো মাসের প্রথম মাস, সম্রাট আকবর বাংলা সনের প্রচলন করেন, খাজনা আদায়ের সুবিধার্থে তিনি বাংলা সন প্রচলন করেন। কালের পরিক্রমায় এ বাংলা সন আমাদের সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ; আমাদের পূর্বপুরুষরা বাংলা সনের, বাংলা মাসের ওপর নির্ভর করে হালখাতা উৎসব, শীতকালে পিঠাপুলির উৎসব,  বৈশাখে বিভিন্ন মেলার আয়োজনসহ নানা অনুষ্ঠান করত এবং করে। ইংরেজি নববর্ষ বৈশ্বিকভাবে পালিত হচ্ছে, থার্টি ফার্স্ট নাইটে আতশবাজি ফোটানো হয়, আমরাও এসব অনুষ্ঠান সমবেগে ও সম-আবেগে পালন করি। তাহলে আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশগুলো পালনে কেন এত প্রশ্ন তুলতে হবে?

এবার আসি হাওরের ১৪ কিলোমিটার সড়কের আলপনা নিয়ে। হাওরের এ আলপনা কোনো বেসরকারি কোম্পানির স্পন্সরে আঁকা হয়েছে। এখানে সরকারের কোনো টাকা-পয়সা খরচ করতে হয়নি। কোনো কোম্পানি মার্কেটিংয়ের স্বার্থে কী করবে সেটা তার নিজস্ব সিদ্ধান্ত। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ আলপনা আঁকা নিয়ে সরকারকে তুলোধুনো করা হয়েছে। এসব সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী, যাদের কাজই হচ্ছে হিংসা-বিদ্বেষ ছড়ানো, তারা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে এসব হীন কাজ করে যাচ্ছে। সরকারের ওপর দায় চাপানোর আগে নিজেদের সংকীর্ণতা দূর করে নিজস্ব সংস্কৃতির চর্চা করতে শিখুন, উদার মানসিকতা ও অসাম্প্রদায়িক মূল্যবোধ নিয়ে একটু ভাবতে শিখুন।

দুর্নীতি, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাত, বুড়িগঙ্গায় দূষণ এসব নিয়ে অবশ্যই আমাদের ভাবতে হবে। এসব জাতীয় ইস্যু, এগুলো কোনো বেসরকারি অর্থায়নে সমাধান করা যায় না। আলপনা আঁকায় যে কোম্পানি স্পন্সর করেছে, তারা কি এসব জাতীয় সমস্যা সমাধানে স্পন্সর করবে? কিংবা এসব বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের আমাদের এই জাতীয় সমস্যা সমাধানে সক্ষমতা, সামর্থ্য ও রাজনৈতিক প্রাধিকার আছে? এছাড়া কেনোইবা আমাদের জাতীয় সমস্যা আমাদের উৎসব-আনন্দের সঙ্গে উপাস্থাপন করে এমন গোলমেলে সংকীর্ণতা দেখাতে হবে। জাতীয় সমস্যা সমাধানে আমাদের সামষ্টিকভাবে লড়তে হবে, রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলা করতে হবে। অন্যদিকে উৎসব ও জাতীয় দিবস, যা সংকীর্ণতা, সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মান্ধতার বলয় ভেঙে দেয়, সেসব উৎসব ও দিবস পালনে রাষ্ট্র পৃষ্ঠপোষকতা করবে, নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে- এটাই তো ছিল আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অবিনাশী চেতনা। এ যুদ্ধ এখনো চলছে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে,  অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রকাঠামোর ভিত সুদৃঢ় করার জন্যে।

রাষ্ট্র তার নিজস্ব কাঠামোয় সব মানুষকে ধারণ করবে, অসাম্প্রদায়িক ও উদার সংস্কৃতি চর্চার পৃষ্ঠপোষকতা করবে, কারো প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ করবে না। মার্কিন কবি ও চিত্রশিল্পী লরেন্স ফারলিংগেটি বলেন, ‘হায়! দুর্ভাগা সেই জাতি,/যে নিজ ভাষা ও সংস্কৃতি ছাড়া/অন্যেরটা হজম করে না।’ এখন দেখছি আমরা আমাদের নিজের ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতিকেই হজম করতে চাই না। অন্যের ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি সম্মান করি না। এ প্রজন্ম দিয়ে আমাদের কী হবে?

আমার সংস্কৃতি আমার অস্তিত্ব, আমার সংস্কৃতি আমার প্রাণ- এমন ভাবনায় বিলিয়ে দিতে হবে আমার বহমান জীবন। এ ভাবনা প্রজন্মের মধ্যে জাগ্রত করতে হবে। এ প্রজন্মকে আমাদের পলিকণা নিয়ে ভাবতে হবে, নিজস্ব সংস্কৃতিকে বুকে আগলে রাখতে হবে। অন্য সংস্কৃতির উদার ও নির্মল আনন্দকে কেনোইবা বাদ দেব; সেখান থেকেও রসদ গ্রহণের মাধ্যমে নিজেদের সমৃদ্ধ করব আমরা। এর সঙ্গে সঙ্গে প্রতিক্রিয়াশীল ধর্মান্ধগোষ্ঠীর হিংসা-বিদ্বেষ ও সংকীর্ণতার সমুচিত জবাব দিয়ে তাদের প্রতিহত করতে হবে। আর প্রতিহত না করতে পারলে তাদের আস্ফালন দমন কঠিন হয়ে পড়বে।

লেখক : কবি ও সাংবাদিক

#