বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল, হাইটেক ও সফটওয়্যার পার্ক নির্মাণ করছে। বিনিয়োগকারীদের জন্য একটি নিরাপদ আশ্রয়স্থল বাংলাদেশ। সরকারের বাস্তবমুখী নীতির কারণে বিনিয়োগ, শিল্পায়ন ও রপ্তানির একটি আঞ্চলিক কেন্দ্র হতে যাচ্ছে দেশটি। জাপান ছাড়াও সারাদেশের বিনিয়োগকারীদের জন্যে অবাধ সুযোগের সৃষ্টি করেছে দেশটি। বাংলাদেশের ব্যবসাবান্ধব রাজস্ব, আর্থিক নীতি, মেগাপ্রকল্পের সফল বাস্তবায়ন, বিভিন্ন সেক্টরে প্রণোদনা, স্থিতিশীল শাসনব্যবস্থা, বিদেশি বিনিয়োগে অপার সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিচ্ছে দেশটি। এক্ষেত্রে আঞ্চলিক শান্তি ও স্থিতিশীলতা, পারস্পরিক সুবিধা ও আঞ্চলিক সমৃদ্ধির জন্য অর্থনৈতিক সহযোগিতাকে আরও গভীরতর করবে; সাংস্কৃতিক সহযোগিতার সম্প্রসারণ এবং জনগণের মধ্যে আদান-প্রদানের জন্য বাংলাদেশের নিরন্তর প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।
অনেক উন্নত দেশ যেমন ভারত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপ, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া সৌদি আরব ও চীন ইতিমধ্যে তাদের আগ্রহ প্রকাশ করেছে এবং বাংলাদেশে বড় পরিসরে বিনিয়োগ করছে। তথ্যপ্রযুক্তি, ফার্মাসিউটিক্যালসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ করতে পারে। কারণ দেশটি বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য বিস্তৃত সুযোগ-সুবিধা প্রদান করে।
বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে বিশ্বে সুপরিচিত। ১৭ মিলিয়ন জনসংখ্যার একটি দেশ নিজেই একটি ক্রমবর্ধমান বাজার। যেখানে প্রায় তিন বিলিয়ন গ্রাহকের একটি বড় বাজারের কেন্দ্রস্থল, ব্যবসা সম্প্রসারণের জন্য এ বাজার একটি বিশাল সুযোগ সৃষ্টি করেছে।
আমরা আশা করি- বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের অগ্রগতি তুলে ধরে আলোচনার অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ চাহিদাগুলো সফলভাবে চিহ্নিত করবে। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য অর্থনীতির তুলনায় বাংলাদেশে লাভজনক বিনিয়োগের পরিবেশ বিরাজমান রয়েছে।
বাংলাদেশ একটি বহুলাংশে সমজাতীয় সমাজ; যেখানে কোনো বড় অভ্যন্তরীণ বা বাহ্যিক উত্তেজনা নেই। অত্যন্ত স্থিতিস্থাপকতার সাথে জনগণ প্রতিকূলতার মোকাবেলা করে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিবেশ আগের মতো অস্থিতিশীল নয় আছে। জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে এদেশের জনগণ হাজার হাজার বছর ধরে সম্প্রীতি ও বোঝাপড়ায় বসবাস করে আসছে।
প্রশিক্ষিত, উদ্যমী, পরিশ্রমী এবং কম খরচে শ্রমশক্তি যেকোনো শ্রমনিবিড় শিল্পের জন্য উপযুক্ত। দেশটির ভৌগোলিক অবস্থান বৈশ্বিক বাণিজ্যের জন্য আদর্শ, আন্তর্জাতিক সমুদ্র ও বিমান রুটে খুব সুবিধাজনক প্রবেশাধিকার রয়েছে। বাংলাদেশ পানি সরবরাহে সমৃদ্ধ এবং এর মাটি খুবই উর্বর। বাংলা সরকারি ভাষা হলেও ইংরেজি সাধারণত দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে ব্যবহৃত হয়। বাংলাদেশি পণ্য প্রায় সব উন্নত দেশে শুল্কমুক্ত এবং কোটামুক্ত প্রবেশাধিকার ভোগ করে। বৈশ্বিক বাজারে এই প্রবেশাধিকার আরও প্রভাবিত করে যে বৈদেশিক প্রত্যক্ষ বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের নীতিমালা দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে ভালো।
এখানকার বেশিরভাগ বাংলাদেশি পণ্য ইইউ, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া এবং নরওয়েতে সম্পূর্ণ শুল্ক এবং কোটামুক্ত প্রবেশাধিকার উপভোগ করে। যদিও সীমিত পরিসরে, বাংলাদেশের পণ্য ইতিমধ্যেই থাইল্যান্ড, ভারত ও পাকিস্তানের বাজারে কম শুল্কসহ প্রবেশাধিকার পেয়েছে। তবে এ বিষয়ে চীন, রাশিয়া, মালয়েশিয়াসহ প্রতিবেশি দেশগুলোর সঙ্গে আলোচনা চলছে।
আঞ্চলিক বিনিয়োগের কেন্দ্র হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে বাংলাদেশ। তাই আরও বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার প্রচেষ্টা জোরদার করতে হবে। একটি দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়াতে এফডিআই (প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগ) একটি অপরিহার্য ভূমিকা পালন করে। বাংলাদেশের মতো ক্রমবর্ধমান অর্থনীতির জন্য এর তাৎপর্য অনেক বেশি।
উচ্চ এফডিআই প্রবাহ বৃহত্তর কর্মসংস্থান সৃষ্টি, প্রতিযোগিতা, উচ্চ আউটপুট, ভাল মজুরি এবং উন্নত কাজের দিকে পরিচালিত করে। এটি আরও ভাল বিনিময় হারের স্থিতিশীলতাকে কার্যকর করে যা অর্থনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ। মূলত, এটি অর্থনৈতিক উন্নয়ন অর্জনের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ উপায়।
আরও বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। অন্যান্য এশিয়ান দেশগুলোকে অনুসরণ করতে হবে; যারা ব্যাপক এফডিআই আকৃষ্ট করতে সক্ষম হয়েছে। বাংলাদেশের উচিত আরও অবকাঠামো উন্নয়ন, আরও দক্ষ কর্মী বাহিনী গড়ে তোলা, সংযোগ উন্নত করা এবং টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য উচ্চপ্রযুক্তিকে উৎসাহিত করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
বিশেষজ্ঞদের অভিমত- বৈশ্বিক মুদ্রাস্ফীতি, সরবরাহ শৃঙ্খলে ব্যাঘাত এবং বৈশ্বিক অস্থিরতা ও যুদ্ধ আগামীদিনে দেশে এফডিআই বৃদ্ধিকে ব্যাহত করতে পারে। এছাড়াও জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি, জ্বালানি ও বিদ্যুতের ঘাটতি এবং স্থানীয় মুদ্রা টাকার উল্লেখযোগ্য অবমূল্যায়নের কারণে পরিবহন খরচ বেড়ে যাওয়া এফডিআই প্রবাহে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।
বৈদেশিক রিজার্ভকে শক্তিশালী করা, নতুন কাজের সুযোগ সৃষ্টি এবং শ্রম দক্ষতা বৃদ্ধি করে আমাদের সামনে অগ্রসর হতে হবে। এফডিআই প্রবাহ বাড়ানোর জন্য একটি অনুকূল পরিবেশ তৈরি করার জন্য বিভিন্ন সময় গৃহীত উপযোগী নীতির ফলাফল পাচ্ছে দেশটি। সরকার দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে উদার বিনিয়োগ নীতি অনুসরণ করেছে- এফডিআই সুরক্ষা এবং কাঁচামালের শুল্কমুক্ত আমদানির বিষয়টি নিশ্চিত করার জন্যে ব্যবসা ও বিনিয়োগবান্ধব নীতি গ্রহণ করেছে বাংলাদেশ।
যদিও কয়েক বছর ধরে এফডিআই বাড়ছে। বিশেষজ্ঞদের মতামত- আগামীদিনে আরও বিনিয়োগের সুযোগ রয়েছে। কাজেই এফডিআই প্রবাহ বাড়াতে ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ, কর সংস্কার এবং দীর্ঘমেয়াদি নীতি প্রয়োজন। এটা খুবই আশ্চর্যজনক- বাংলাদেশে এখনও একটি প্রাসঙ্গিক এফডিআই নীতি নেই। একটি সম্পূর্ণ এফডিআই নীতি প্রণয়ন করা বাধ্যতামূলক যা আরও বিনিয়োগ আকর্ষণ করবে। বর্তমান বিনিয়োগ নীতিতে শুধুমাত্র প্রণোদনা প্রদান যথেষ্ট নয়; পাশাপাশি বিনিয়োগকারীদের আস্থা অর্জন করা অপরিহার্য।
এসব প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও সাম্প্রতিক সময়ে কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে অবকাঠামোগত উন্নয়ন, বিদ্যুৎ খাতের উন্নয়ন, নিবন্ধন প্রক্রিয়ার ডিজিটালাইজেশন, বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনের নির্দেশিকাগুলোতে নিয়ন্ত্রণমূলক সংস্কার ইত্যাদি। কিছু সংস্কার কার্যক্রম যার মধ্যে ‘ওয়ান স্টপ সার্ভিস’উল্লেখযোগ্য।
এফডিআই প্রবাহ দেশের উন্নতিতে একটি বড় প্রভাব ফেলবে; যা টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে উৎসাহিত করবে। তবেই আঞ্চলিক বিনিয়োগের কেন্দ্র হিসেবে বাংলাদেশ আবির্ভূত হয়ে সফলতার পরিচয় দিতে পারবে।
লেখক : গবেষক