সকাল থেকে আরাফের মন খারাপ। নিজের রুমেই বসে আছে। মা বেশ কয়েকবার সাধাসাধি করে গেছেন নাশতা খাওয়ার জন্য, কিন্তু সে কিছুতেই নাশতা খাবে না। রাগে-অভিমানে আচ্ছন্ন তার মন। আজ স্কুলেও যায়নি সে। পিতা-মাতার আদরের ছেলে আরাফ একটু কিছুতেই অভিমান করে বসে। আজও তাই হয়েছে। গতকাল বিকালে আরাফ তার বন্ধুদের নিয়ে পাঁচ তলা বাড়ির ছাদে ক্রিকেট খেলেছে। ওদের শব্দে নাকি পাঁচ তলার ভাড়াটিয়ার দুপুরে ঘুমাতে অসুবিধা হয়েছে। তিনি বাড়ির মালিকের কাছে অভিযোগ করেছেন। দুপুরে স্কুল ছুটি হয়ে যাওয়ার পর বাড়ির কাজ শেষ করে বিকাল সময়টায় কিছুই করার থাকে না। তাই খেলতে ইচ্ছা করে তার। বন্ধুদের মধ্যে আবার সবাই খেলতে চায় না। অধিকাংশই কম্পিউটার, হোম ভিডিও, মোবাইল গেমস ইত্যদি নিয়ে ব্যস্ত থাকে। শত ডাকলেও আসতে চায় না। আসলে আরাফদের খেলার কোনো মাঠ নেই। যা-ও একটি ছোট মাঠ আছে পার্কের পেছনে, সেখানেও প্রবেশাধিকার সংরক্ষিত।
খেলাধুলা থেকে বঞ্চিত আরাফের বন্ধুরা কেবল নয়। বর্তমানে শহরের শিশুরা খেলাধুলা করতে যেন ভুলেই গেছে। কিন্তু, শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশের জন্য খেলাধুলার গুরুত্ব রয়েছে। যেকোনো ধরনের ঝুঁকিমুক্ত খেলাধুলা শিশুর বুদ্ধি বিকাশে সাহায্য করে। বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে শিশুর আগ্রহ ও চাহিদার পরিবর্তন ঘটে। সাধারণত জন্মের ছয় মাস অতিবাহিত হওয়ার পর একটি স্বাভাবিক শিশু তার মায়ের দিকে তাকিয়ে হাসে আর তিন মাস পেরিয়ে গেলে হাতে উজ্জ্বল রঙ খেলনাসামগ্রী দিলে ধরতে পারে, তাছাড়া শব্দ করে এমন কিছু খেলনাসামগ্রী পেলে শব্দের দিকে দৃষ্টি দেয়। স্কুল বয়সি শিশুদের বিভিন্ন ধরনের পাজল দেয়া হয়। এতে শিশুরা যে শুধু আনন্দ পায় তাই নয়, তাদের বুদ্ধিরও চর্চা হয়। আরো একটু বেশি বয়সে বিভিন্ন ধরনের ইনডোর বা আউটডোর গেমসে শিশুকে আগ্রহী করে তোলা হয়। কিন্তু শহরকেন্দ্রিক জীবনযাপনে অভ্যস্ত নাগরিকদের জন্য আশঙ্কার কারণ হচ্ছে খেলার মাঠের অপ্রতুলতায় শিশুরা ঘরে বসে কম্পিউটার গেমস নিয়ে মেতে থাকে। বিভিন্ন ধরনের গেমস শিশুদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকে রাখছে কম্পিউটারের সামনে। বিশ্বায়নের এ যুগে এসব থেকে বিরত রাখা যাবে না ঠিক; তবে এসব গেমস শিশুর জন্য একপর্যায়ে নেশায় পরিণত হয়ে যাচ্ছে।
খেলাধুলা মানবজীবনের অন্যতম বিনোদন। দেহগঠনে এর প্রভাব অনেক। শিশু বয়স থেকে মানুষ খেলাধুলার সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়। আর এভাবেই শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশ সম্পন্ন হয়। পরিচ্ছন্ন বিনোদন ও খেলাধুলায় শিশু সফল মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠে। কিন্তু অপরিচ্ছন্ন বিনোদনে বেড়ে ওঠা শিশুর জীবন হয় হুমকিস্বরূপ। খেলাধুলা প্রতিটি দেশের নিজস্ব অবিচ্ছেদ্য অংশ। চিরায়ত বাংলার প্রচলিত বহু লোকজ খেলা রয়েছে। কিন্তু, নগরায়নের সাথে প্রযুক্তির প্রসারের ফলে সেগুলো থেকে ক্রমে দূরে সরে পড়ছে আগামী প্রজন্ম। শহরের শিশুরা অভ্যস্ত হচ্ছে কম্পিউটার, ট্যাব ও মোবাইলে। কৃত্রিম পার্কও তাদের অন্যতম গন্তব্য। অথচ গ্রামের শিশুরা ছোটবেলা থেকেই বাড়ির সামনের আঙিনায় বা খোলা মাঠে তেমন কোনো উপকরণ ছাড়াই মেতে ওঠতো দাঁড়িয়াবান্ধা, কানামাছি, গুঁটি খেলা, গোল্লাছুট, বৌচোরা, এক্কা-দোক্কা, মোরগ লড়াই, ডাংগুলি, ইচিং বিচিং, জোলাভাতি, কাবাডি, ঘুড়ি ওড়ানোর মতো বিভিন্ন মজার লোকজ খেলায়। কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপটে এসব খেলা আগের তুলনায় নেই বললেই চলে। পক্ষান্তরে সারা দেশে খেলার মাঠ হ্রাস পাচ্ছে, বৃদ্ধি পাচ্ছে জনসংখ্যা। আবাসিক এলাকাগুলোতেও খেলাধুলার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেই বললেই চলে। একেকটা বাসাবাড়ি যেনো চতুর্দিকে গ্রিলবেস্টিত কয়েদখানা। ছেলেরা সুযোগ পেলে অলিগলিতে ক্রিকেট খেলে, কাছে মাঠ পেলে গিয়ে ফুটবল খেলায় মাতে। মেয়েদের অবস্থাটা আরও বেশি নাজুক। অধিকাংশ স্কুলের মেয়েদের রুটিনের মতো একটা জীবন- কোচিং, স্যারের বাসা, হোমওয়ার্ক, পরীক্ষা আতঙ্ক।
(গ্রামের শিশুরা ছোটবেলা থেকেই বাড়ির সামনের আঙিনায় বা খোলা মাঠে তেমন কোনো উপকরণ ছাড়াই মেতে ওঠতো দাঁড়িয়াবান্ধা, কানামাছি, গুঁটি খেলা, গোল্লাছুট, বৌচোরা, এক্কা-দোক্কা, মোরগ লড়াই, ডাংগুলি, ইচিং বিচিং, জোলাভাতি, কাবাডি, ঘুড়ি ওড়ানোর মতো বিভিন্ন মজার লোকজ খেলায়। কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপটে এসব খেলা আগের তুলনায় নেই বললেই চলে। পক্ষান্তরে সারা দেশে খেলার মাঠ হ্রাস পাচ্ছে, বৃদ্ধি পাচ্ছে জনসংখ্যা। আবাসিক এলাকাগুলোতেও খেলাধুলার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেই বললেই চলে)
তাছাড়া, প্রতিযোগিতাপূর্ণ প্রেক্ষাপটে অতিরিক্ত পড়াশোনার চাপের কারণে শিশুদের তীব্র শারীরিক ও মানসিক চাপে পড়তে হচ্ছে। দিনের পুরো সময় বেশি রাত পর্যন্ত পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে। তাই খেলাধুলা করার সুযোগ হয়ে ওঠে না। অনেক ক্ষেত্রে অভিভাবকরা পড়াশোনার ক্ষতি হবে ভেবে শিশুদের খেলাধুলা করার সুযোগ দিতে অনীহা প্রকাশ করেন। অথচ পড়াশোনা নিয়ে কেবল ব্যস্ত থাকলে শিশুরা নিষ্প্রাণ ও মানসিকভাবে ক্লান্ত-বিরক্ত হয়ে পড়ে। হারিয়ে ফেলে শিশুর স্বতঃস্ফূর্ততা। চিত্তবিনোদন শূন্যতায় অল্প বয়সেই বিভিন্ন অপরাধ চক্রে জড়িয়ে যায় কোমলমতি শিশুরা। খেলাধুলা না করায় শিশু-কিশোরদের অবসর কাটে টিভি, মোবাইল, কম্পিউটার কিংবা ভিডিও গেমসে, যা শিশুর চোখের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। প্রযুক্তি নির্ভর শিশুরা নিজেই তৈরি করে নিচ্ছে আলাদা এক জগৎ। যে জগৎ শিশুর সহজ-সরল স্বাভাবিক জীবনের জন্য প্রতিবন্ধকতা। খেলাধুলার মাধ্যমে অর্জিত আনন্দ শিশুমনে পরিপূর্ণ বিকাশে সহায়ক। একটি শিশু বিভিন্ন মাধ্যমে থেকে বিনোদন খুঁজে। খেলাধুলার মাধ্যমে শিশুদের ভেতর ভ্রাতৃত্ববোধ ও সম্প্রীতির বন্ধন গড়ে ওঠে।
আমরা জানি, জনসংখ্যায় বাংলাদেশের অবস্থান। আর আধুনিকায়নের যুগে শহরগুলি যেনো উন্নত থেকে উন্নততর দিকে ধাবিত হওয়ার প্রতিযোগিতায় নেমেছে। ফলে বেড়ে উঠছে অপরিকল্পিত শহরায়ন। যার দরুন শিশুদের সুস্থ জীবন যাপনের মনোভাব কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ছে দিনকে দিন। যেমন দ্রুত বেগে বেড়ে উঠছে দালান কোঠা, তাতে কমে যাচ্ছে আবাদি জমির পরিমাণ, আর শিশুরা হারাচ্ছে তাদের খেলার মাঠ। অন্যদিকে অবাধে কাটা পড়ছে গাছ-পালা। সুস্থ বায়ু সেবনে শিশুদের জীবন হয়ে পড়ছে কষ্টসাধ্য। খোলা প্রান্তর বা মাঠের সঙ্গে দুরন্ত এক শৈশবের সম্পর্ক রয়েছে। মাঠ শিশু-কিশোরের বিনোদনের একটি বড় অনুষঙ্গ। আজকের শহরে বড় হওয়া ছেলে-মেয়েরা জানেই না খেলার মাঠে দৌড়ঝাঁপের মজাটা কী! মাঠ মানেই খোলা আকাশের সঙ্গে পরিচিতি হওয়া। মাঠ মানেই অনেক শিশু-কিশোরের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন, যা পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে শিশুর মনোজগৎ বিস্তৃত হতে সাহায্য করে।
আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। কিন্তু, আজকের শহরকেন্দ্রিক শিশুদের ভবিষ্যত অন্ধকারের দিকে ঠেলে ফেলার উপক্রম। শুধু বাড়ছে বিল্ডিং, ফ্ল্যাট আর ফ্ল্যাট; নেই কোনো উপযুক্ত খেলার মাঠ। শিশুরা আজ চারদেয়ালের মধ্যে বন্দিদশায় আবদ্ধ। শৈশব ও কৈশোরে দেহের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দ্রুত বাড়ে বলে অনেক সময় মাংসপেশির সাথে স্নায়ুর সমন্বয় ঘটে না। এজন্য ছেলে-মেয়েদের খেলাধুলার বিশেষ প্রয়োজন। এছাড়া দীর্ঘ ক্লাসের লেখাপড়া শিশুর স্বাভাবিক আনন্দ লাভের অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। এতে শিশুর স্বাভাবিক ক্রিয়া যেমনÑপরিপাক তন্ত্র, রক্ত সঞ্চালন ইত্যাদির ব্যাঘাত ঘটে। ফলে শিশুর দেহ ও মন অবসাদগ্রস্থ হয়ে পড়ে। এই ক্লান্তি দূর করার জন্য পড়াশুনার ফাঁকে ফাঁকে খেলাধুলার প্রয়োজন। এতে পাঠের একঘেয়েমিতা দূর হয় এবং মনের সজীবতা ফিরে আসে। অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ও পেশিসমূহের শ্রীবৃদ্ধি ও সুগঠিত হয়। ফলে আমরা নিরোগ দেহের অধিকারী হতে পারি এবং উন্নত জীবনযাপন করতে পারি। এছাড়া, খেলাধুলার মাধ্যমে শিশুর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ফুটে উঠে। সহপাঠী এবং সমবয়সীদের সাথে খেলাধূলা করে শিশুদের মনোভাবের উন্নতি ঘটে। খেলাধুলার মাধ্যমে শিশুরা নানা পরিস্থিতি সামাল দিতে শেখে। আবেগ নিয়ন্ত্রন করতে পারে। পরাজয় মেনে নিতে শিখে। নিজেদেরকে অপরের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে পারে। খেলাধুলার নানাবিধ আইন-কানুন অনুসরণ করে শিশুরা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা করে চলতে অভ্যস্ত হয় এবং সমাজ ও দেশের প্রতি তাদের দায়িত্ববোধ জাগ্রত হয়। আর তা-না হলে মোবাইল গেমসে আসক্ত হয়ে ঘরে বন্দি থাকতে থাকতে মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়বে। তা থেকে পরিত্রাণ পেতে শিশুদের জন্য শারীরিক এবং মানসিক বিকাশ সাধনের জন্য খেলাধুলার প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। তাই যেভাবেই হোক শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশে শিশুকে মাঠে খেলার সুযোগ করে দিতে হবে। কারণ, শিশুদের একটি আনন্দমাখা শৈশব উপহার দেয়া আমাদের সকলের দায়িত্ব।
লেকক : পুলিশ সুপার, নৌ পুলিশ, সিলেট অঞ্চল