চীন তার বাস্তুতন্ত্র ও জীববৈচিত্র্য সুরক্ষায় চালু করেছে ৩০টি স্যাটেলাইটের বহর। এ সঙ্গে প্রস্তুত বরেছে সংরক্ষিত অঞ্চলের ম্যাপ। চীনের এ প্রজেক্ট অযাচিত উন্নয়ন থেকে মুক্ত রাখরে এসব সংরক্ষিত অঞ্চলগুলোকে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, এ স্যাটেলাইট ব্যবহার প্রকৃতিকে রক্ষা করতে সাহায্য করবে, কোন অঞ্চলগুলোর বাস্তুতন্ত্র সংরক্ষণ জরুরি তা স্বচ্ছভাবে জানাবে এ স্যাটেলাইট।
অপরিকল্পিত উন্নয়ন থেকে বাস্তুতন্ত্র সংরক্ষণ ও প্রকৃতিকে সুরক্ষা দিতে বিভিন্ন অঞ্চল পর্যবেক্ষণ করতে চীনা সরকারই প্রথম স্যাটেলাইট ব্যবহার করে। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, এই পদক্ষেপটি পরিবেশগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ আবাসস্থলগুলোকে সুরক্ষিত রাখবে এবং সংরক্ষণের জন্য ‘রিমোট সেন্সিং’ ব্যবহারের একটি মডেল প্রদান করবে যা অন্যান্য দেশগুলো অনুসরণ করতে পারে। তবে প্রশ্ন, কোন এলাকাগুলো সংরক্ষণ করবে এবং সীমানাগুলো বাস্তুসংস্থানীয় রেডলাইন হিসাবে পরিচিতÑ তা একটি সামষ্টিক জাতিগত সিদ্ধান্ত।
চীনের সুঝোর ‘ডিউক কুনশান ইউনিভার্সিটির’ ফলিত বাস্তুবিজ্ঞানী চি-ইয়ুং চোই বলেছেন, সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীরা সত্যিই একটি সাহসী পদক্ষেপ এগিয়ে নিয়েছে। পরিবেশগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলগুলো রক্ষা করার জন্য একটি জাতীয় ব্যবস্থা থাকা জরুরি। কারণ প্রাদেশিক সরকারগুলোকে এ সিদ্ধান্ত সংরক্ষণের চেয়ে উন্নয়নকে অগ্রাধিকার দেওয়া থেকে বিরত রাখবে। এ নীতির ফলে জীববৈচিত্র্যের হটস্পটগুলো সুরক্ষিত থাকার সত্যিই বিশাল সম্ভাবনা রয়েছে।
একটি বিশাল জাতি হিসাবে চীন তৃণভূমি, বন, মরুভূমি এবং পর্বতমালার মতো বিভিন্ন আবাসস্থল সংরক্ষণ জরুরি। এর ফলে চীন জায়ান্ট পান্ডা (আইলুরোপোডা মেলানোলিউকা), দক্ষিণ চীনের বাঘ (প্যানথেরা টাইগ্রিস টাইগ্রিস) এবং স্নাব-নোজ বানর (রাইনোপিথেকাস এসপিপি)সহ হাজার হাজার স্বল্পপরিচিত প্রজাতির আবাসস্থল হবে। ‘ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অফ নেচার’- এটিকে বিশ্বের তৃতীয় সর্বাধিক জীববৈচিত্র্যপূর্ণ দেশ হিসাবে গণ্য করে।
গত ২২ এপ্রিল চীনের প্রাকৃতিক সম্পদ মন্ত্রণালয় অধীনে দেশটি তার পরিবেশগত রেডলাইন মানচিত্র চূড়ান্ত করা হয়েছে। প্রতিটি প্রদেশের এলাকাগুলো এখন মন্ত্রণালয় দ্বারা পরিচালিত একটি কেন্দ্রীয় ব্যবস্থায় মাধ্যমে সুনির্দিষ্ট এবং সুরক্ষিত হবে। চীনের ২,৭৫০টি বাস্তুতন্ত্র সংরক্ষণ এবং জীববৈচিত্র্যের হাজার হাজার অঞ্চল সরকারের বিভিন্ন সংস্থার মাধ্যমে সুরক্ষিত হবে।
এ মন্ত্রণালয়ের ঘোষণা অনুসারে, ৩ মিলিয়ন বর্গকিলোমিটার ভূমি সুরক্ষিত অঞ্চল হবে, যা চীনের মূল ভূখণ্ডের প্রায় ৩০ শতাংশ। এছাড়াও এর সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে ১৫০,০০০ বর্গ কিলোমিটার সামুদ্রিক অঞ্চল। কুনমিং-মন্ট্রিল গ্লোবাল বায়োডাইভারসিটি ফ্রেমওয়ার্কের লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ২০৩০ সালের মধ্যে অন্তত ৩০ শতাংশ ভূখণ্ড এবং অভ্যন্তরীণ জলজ এলাকাগুলো সংরক্ষিত করবে চীন। চীনের সাংহাইয়ের ফুদান বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস্তুতন্ত্র সংরক্ষণ বিষয়ক জীববিজ্ঞানী ঝিজুন মা বলেছেন, রেডলাইন মানচিত্রটি দ্বিগুণ করে অযাচিত উন্নয়ন থেকে এসব অঞ্চলগুলো আইনগতভাবে সুরক্ষিত রাখা হবে।
রেডলাইন মানচিত্র শেষ হওয়ার চার দিন পর পরিবেশ ও বাস্তুতন্ত্র মন্ত্রণালয় এসব অঞ্চলগুলো পুলিশিং ব্যবস্থার মাধ্যমে মনিটরিং চালু করার ঘোষণা করেছে। ৩০টি উপগ্রহের একটি বহর চালু করা হয়েছে, যা হাই- রেজ্যুলেশন ইমেজ ক্যাপচার করতে সক্ষম। অ্যালগরিদম পদ্ধতিতে স্বয়ংক্রিয়ভাবে বনভূমির উপরিভাগ এবং রেডলাইনের মধ্যে ভূমি ব্যবহারের পরিবর্তনগুলো সনাক্ত করা যাচ্ছে এ উপগ্রহের বহরটির মাধ্যমে।
বেইজিংয়ের পিকিং ইউনিভার্সিটির বাস্তুতন্ত্র বিষয়ক জীববিজ্ঞানী ফাংইয়ুয়ান হুয়া বলেছেন, উপগ্রহগুলো একটি তিন-স্তরীয় পর্যবেক্ষণ নেটওয়ার্ক যা স্পেস, আকাশ ও ভূমির তথ্য দিবে। আকাশ এবং ভূমি থাকছে ড্রোন ব্যবস্থার অধীন। অন-গ্রাউন্ড কর্মকর্তারা সুরক্ষিত অঞ্চলে মানুষের কার্যকলাপ তদন্তে ভূমিকা রাখবে। এ সিস্টেমের উদ্দেশ্য হল খনি বা রিয়েল-এস্টেট উন্নয়নের জন্য ভূমিতে কোনো অবৈধ কার্যকলাপ হচ্ছে কি না তা সনাক্ত করে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার পথ মসৃণ করা।
হুয়া আরো বলেছেন, এ বিষয় নিয়ে গবেষণা করতে আগ্রহী পরিবেশ বিজ্ঞানীরা কিন্তু সরকারের স্বচ্ছতার অভাবের কারণে তারা হতাশ। যদিও মানচিত্রটির মাধ্যমে সারাদেশে অঞ্চলগুলো ঠিক করা হয়েছে, আসলে জানি না মানচিত্রটি কেমন দেখাচ্ছে, সংরক্ষণের সীমানাগুলো কোথায় কোথায় তা প্রকাশ্যে এখনো আনা হয়নি। পাবলিক রেকর্ড ছাড়া স্থানীয় সরকার উন্নয়নের প্রয়োজনীয়তা উপলব্দি করে এসব সংরক্ষিত হাত দিতে পারে। কী ঘটছে তা নিরীক্ষণ করা সাধারণ মানুষের পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়বে।
গতবছর চোই এবং তার সহকর্মীরা মানচিত্রের একটি খসড়া ব্যবহার করে দেখান উপকূলীয় অঞ্চলে পাখি সংরক্ষণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ১৭২টি জোনের প্রায় ৭৫ শতাংশ এ নতুন পরিকল্পনা দ্বারা সুরক্ষিত হবে। হংকং বিশ্ববিদ্যালয়ের সংরক্ষণ জীববিজ্ঞানী অ্যালিস হিউজ বলেছেন, অন্যান্য দেশ চীনের উদাহরণ অনুসরণ করতে পারে। চীনকে এ বিষয়ে তথ্য আরো সহজলব্য করতে পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। তবে চোই কখন মানচিত্রগুলো সর্বজনীনভাবে প্রকাশ করবে, সে সম্পর্কে মন্তব্য করতে নারাজ।
চোই বলেছেন, স্যাটেলাইট মনিটরিং হবে একটি খুব শক্তিশালী ও কার্যকর সিস্টেসে। যদি এটি সঠিকভাবে করা যায়, তবে এসব তথ্য উন্মুক্ত করতে হবে, যাতে গবেষকরা জীববৈচিত্র্য ও বাস্তুতন্ত্র নিয়ে আরো ব্যাপক কাজ করতে পারে।
সূত্র : নেচার, অনুবাদ : ইমামুল ইসলাম