দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বেশ কয়েকটি দেশে তীব্র তাপপ্রবাহের কারণে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। জলবায়ু পরিবর্তন এবং এল নিনোর প্রভাবে তাপপ্রবাহ ধীরে ধীরে বিপজ্জনক হয়ে উঠছে। বাংলাদেশ, মিয়ানমার, ভারত, ফিলিপাইন, ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়া এ তাপপ্রবাহের কবলে পড়েছে। সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও যুক্তরাষ্ট্রের জর্জিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক দীর্ঘমেয়াদি একটি গবেষণা করেছেন। তারা দেখেছেন, ঢাকার বাতাসে পাঁচ ধরনের ক্ষতিকর গ্যাসের অস্তিত্ব রয়েছে। এসব গ্যাস ময়লার স্তূপ (ভাগাড়), ইটভাটা, যানবাহন এবং শিল্পকারখানার ধোঁয়া থেকে তৈরি হচ্ছে এবং বাতাস ও মাটিকে আরও উষ্ণ করে তুলছে। পাঁচ ধরনের গ্যাস হচ্ছে কার্বন মনোক্সাইড, নাইট্রিক অক্সাইড, নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইড, ভোলাটাইল অর্গানিক কম্পাউন্ড এবং ওজোন। এসব গ্যাস ১০ থেকে ৪০০ বছর পর্যন্ত শহরের বাতাসে থেকে যেতে পারে। দেখা গেছে, বাতাসে এসব গ্যাস দ্রুত বাড়ছে। সাময়িকভাবে ঢাকার বাতাসে মিথেন গ্যাসের পরিমাণও বিপজ্জনক পর্যায়ে পাওয়া গেছে। তাপপ্রবাহের সঙ্গে যুক্ত হওয়া এসব ক্ষতিকর গ্যাসের কারণে রাজধানীর আবহাওয়া অসহনীয় হয়ে উঠেছে এবং শহরবাসীর নানা রোগবালাই দেখা যাচ্ছে। ভোলাটাইল অর্গানিক কম্পাউন্ড এবং ওজোন গ্যাস গ্রীষ্ম ও বর্ষা ঋতুতে সবচেয়ে বেশি পাওয়া যাচ্ছে। মিথেন গ্যাসের পরিমাণও এই দুটি ঋতুতে বেশি পাওয়া গেছে। মূলত যানবাহনের তেল পোড়ানো, ইটভাটা এবং ময়লা-আবর্জনা ফেলে রাখলে তা থেকে এসব গ্যাস তৈরি হয়। এসব তথ্য আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান সাময়িকী ‘অ্যাটমসফেয়ারিক কেমিস্ট্রি’-তে প্রকাশিত হয়েছে।
জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক বিজ্ঞানীদের প্যানেল আইপিসিসি-র সর্বশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাতাসে অতিক্ষুদ্র বস্তুকণা নির্ধারিত মানমাত্রার চেয়ে বেশি থাকলে তাপমাত্রা দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস অতিরিক্ত বৃদ্ধি পায়। আর ওজোন, কার্বন মনোক্সাইড, নাইট্রিক অক্সাইড গ্যাস বাড়লে তাপমাত্রা আরও দশমিক ৫ থেকে ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়ে। আবহাওয়াগত কারণে কোনো এলাকার তাপমাত্রা যে পরিমাণ বাড়ে, তার সঙ্গে ওই গ্যাসগুলো যোগ হলে উত্তাপ আরও বৃদ্ধি পায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের এক গবেষণায় দেখা গেছে, এ ধরনের গ্যাস ও অতিক্ষুদ্র বস্তুকণা সবচেয়ে বেশি পাওয়া গেছে ময়লার ভাগাড়গুলোতে। গবেষণায় ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ১০টি ময়লার ভাগাড় এবং রমনা পার্কের ময়লা ফেলার জায়গাগুলোর ওপর সমীক্ষা করা হয়েছে। এতে মাতুয়াইল ও আমিনবাজার ভাগাড়ে সবচেয়ে বেশি গ্যাসের উপস্থিতি পাওয়া গেছে, যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানমাত্রার চেয়ে প্রায় ছয়গুণ বেশি। অন্য ভাগাড়গুলোর তুলনায় ওই দুই জায়গায় গ্যাসের পরিমাণ দ্বিগুণেরও বেশি পাওয়া গেছে। ওই গ্যাস এবং ক্ষতিকর বস্তুকণা বাতাসকে উষ্ণ করে তুলছে এবং বিষাক্ত উপাদান ক্রমাগত বাড়িয়ে দিচ্ছে।
অন্যদিকে আমাদের চারপাশে নির্বিচারে অসংখ্য গাছপালা কাটা হচ্ছে, উজার করে ফেলা হচ্ছে বন। ফলে স্বভাবতই এসব গাছপালা কাটার ফলে এলাকায় তাপমাত্রা বেড়ে যাচ্ছে। আগে গরমের সময় বিভিন্ন পার্ক কিংবা এসব স্থানে গাছের ছায়ায় আরাম করা যেত- এখন কোথাও সেই আরাম পাওয়ার কথা চিন্তাই করা যায় না। রাজধানীর শাহবাগ এলাকার শিশুপার্কে আগে ৪০ ভাগের মতো জায়গায় গাছ ছিল; বাকি অংশে ছিল নানা ধরনের খেলনা ও ফাঁকা জায়গা। এখন সেখানে অনেক গাছই আর নেই। ফলে সহজেই তাপমাত্রা বেড়ে যাচ্ছে। ঢাকার ফার্মগেটে আনোয়ারা উদ্যানে অনেক গাছপালা ছিল। সেখানে তা কেটে মেট্রোরেলের অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়েছে। ফার্মগেট থেকে পান্থকুঞ্জ হয়ে শাহবাগের শিশুপার্ক প্রায় তিন কিলোমিটার এলাকা কয়েক বছরের ব্যবধানে সবুজ গাছপালা প্রায় হারিয়ে গেছে। শুধু পার্ক বা ফাঁকা জায়গাই নয়, রাস্তার পাশেও সড়ক বিভাজকের কারণে অসংখ্য গাছপালা কেটে ফেলা হয়েছে। মানুষের আন্দোলন এবং বিভিন্ন কর্মসূচি এসব গাছ কাটাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। অথচ রাজধানী শহরসহ সারা দেশে যে তীব্র তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে, তার জন্য মূলত দায়ী হচ্ছে গাছপালা কেটে বিশাল অট্টালিকা বানানো। গাছের পাশাপাশি জলাধারও গরমের কষ্ট লাঘবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। কিন্তু ঢাকা শহরে প্রয়োজনের তুলনায় পর্যাপ্ত গাছ ও জলাশয় না থাকায় চরম কষ্টে ভুগছে মানুষ। বিশেষজ্ঞদের মতে, মানুষ তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। কিন্তু গাছপালা ও জলাশয়ের মাধ্যমে স্বস্তিতে থাকতে পারে। আর তাই গাছপালা ও জলাশয় ধ্বংস করে আমরা ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনছি।
বিশ্বের শীর্ষ যেসব জনবহুল শহর রয়েছে, তার মধ্যে ঢাকা অন্যতম। মানুষের বাড়তি চাপের চাহিদা মেটাতে মাত্রাতিরিক্ত যানবাহন ও অবকাঠামোর চাপ স্বাভাবিকভাবেই গরমের তাপ বাড়িয়ে দিচ্ছে। একটি জরিপে দেখা যায়, রাজধানীর শাহবাগ, রমনা পার্ক, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, বুয়েট ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় বসবাসকারী লোকজর কম তাপপ্রবাহে ভুগছেন। এসব এলাকায় উষ্ণতার মাত্রা সবচেয়ে কম। সব মিলিয়ে উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৯০ ভাগ এলাকা তীব্র তাপপ্রবাহের বিপদে রয়েছে। নগরবিদ ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজধানীর ৯০ ভাগ এলাকা গ্রীষ্মকালের প্রায় পুরোটা সময় অত্যধিক গরম থাকে। আর এর প্রধান কারণ হচ্ছে- অল্প জায়গায় বিপুল সংখ্যক মানুষের বসতি, অতিমাত্রায় শীতাতপ যন্ত্রের ব্যবহার, গাছপালা ও জলাশয় না থাকা এবং রাজধানী শহরের বেশিরভাগ জায়গা কংক্রিটের স্থাপনা দিয়ে আচ্ছাদিত। ফলে এখানে অতি উষ্ণতা বা তাপপ্রবাহের ঝুঁকি প্রতিবছর বাড়ছে। বাংলাদেশে অন্যান্য দুর্যোগের মতো তাপপ্রবাহ বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি তৈরি শুরু করেছে। এমনকি এর ফলে মানুষের মৃত্যুও ঘটছে। আর তাই এখনই এ তাপপ্রবাহের বিপদকে দুর্যোগ হিসেবে ঘোষণা দেওয়া উচিত বলে আমি মনে করি।
গাছপালা ও জলাধারসমৃদ্ধ প্রাকৃতিক ভূমি আবরণবিশিষ্ট একটি অঞ্চলকে যখন শহরে রূপান্তরিত করা হয়, তখন সেখানে ইট-পাথরের আবরণ দেওয়া হয়। মাটির ওপর ফুটপাত, রাস্তা, বহুতল ভবনসহ বহু ধরনের স্থাপনা এসব অবকাঠামোতে তৈরি করা হয়। যখন মাটি এ ধরনের স্থাপনা দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়, তখন তা অধিক তাপ শোষণ করে এবং ধরে রাখে। এতে সেই অঞ্চলের তাপমাত্রা বেড়ে যায়। সেজন্য একটি শহরের জন্য কমপক্ষে ২০ থেকে ২৫ ভাগ সবুজ জায়গা থাকা প্রয়োজন। কিন্তু আছে মাত্র ৮ ভাগের মতো সবুজ জায়গা (বাস্তবে হয়তো তা-ও নেই)। গত এক দশকে ঢাকা শহরের সবুজের পরিমাণ যে ব্যাপকভাবে কমেছে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। অন্যদিকে, ঢাকার জলাভূমি সব ভরাট করে ফেলা হচ্ছে; বানানো হচ্ছে বিভিন্ন স্থাপনা। খোলা জায়গা তথা খেলার মাঠ নেই বললেই চলে।
বর্তমান সময়ে যেভাবে বিভিন্ন ভবন বা অট্টালিকা তৈরি হচ্ছে, তাতে ছাদকৃষি একটি আশাব্যঞ্জক দিক। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, অসহ্য গরম থেকে রক্ষা পেতে ছাদবাগান বিরাট ভূমিকা রাখতে পারে। ইট-পাথরের জঞ্জালপূর্ণ শহরে ছাদবাগান এখন ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। বনবিভাগের ভাষ্যমতে, একটি গাছ বছরে ১০টি শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রের সমান কাজ করে। ছাদের এই ছোট গাছগুলোর প্রভাবে এভাবেই হয়তো নগরীর বাতাস থেকে প্রতিদিন হাজারো শীতাতপ যন্ত্রের সমান তাপ শোষিত হচ্ছে। তাই প্রকৃতিকে রক্ষা করতে এবং বর্তমান সময়ে বিশাল ভবনগুলোতে এই ছাদবাগান আরও বাড়াতে হবে। পাশাপাশি যেভাবে নির্বিচারে গাছপালা কেটে ফেলা হচ্ছে, তা বন্ধ করতে হবে এবং প্রয়োজনে আরও গাছ লাগাতে হবে। ময়লার ভাগাড়, ইটখোলা এবং শিল্পকারখানা স্থাপনের ব্যাপারে খেয়াল রাখতে হবে। আমাদের সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টাই পারে একটি সুস্থ ও সুন্দর দেশ গড়তে- একটু সুন্দরভাবে বেঁচে থাকতে।
লেখক : কবি ও কলামিস্ট