বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দুজনেই বিশ্বমানবতা ও বিশ্বশান্তির জন্য নিবেদিত প্রাণ। এ দুই মহাপুরুষের চিন্তাভাবনা ও কর্মকাণ্ডে ছিল বাংলা ও বাঙালির অপরিসীম প্রেম। বাংলাভাষা ও বাঙালিকে বিশ্বদরবারে উপস্থাপন করেছেন একজন সাহিত্য দিয়ে, অন্যজন রাজনীতি দিয়ে। ‘বাঙালি’ বলে যে জাতির কথা রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, বঙ্গবন্ধু সে জাতিকেই আবিষ্কার করেন ‘সোনার বাংলায়’। যে বাংলাকে ভালোবেসে রবীন্দ্রনাথ লিখেন, ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি,’বঙ্গবন্ধু সেটিকে ভালোবেসে জাতীয় সংগীতে রূপ দেন।
বঙ্গবন্ধু রবীন্দ্রনাথের আদর্শকে আজীবন লালন করেছেন। রাজনৈতিক বক্তৃতা-বিবৃতিতে তিনি রবীন্দ্রনাথকে বারবার স্মরণ করেছেন। রবীন্দ্রনাথের আদর্শ দিয়েই তিনি দেশকে গড়ে তুলতে চেয়েছেন। এমনকি রবীন্দ্র-রচনাই ছিল তাঁর প্রেরণা। যখনই রবীন্দ্রনাথের অপমান অবজ্ঞার সূত্রপাত হয়েছে, বঙ্গবন্ধু কঠোরভাবে তাঁর সমালোচনা করেছেন। রবীন্দ্রনাথের লেখা আর গান তাঁকে লড়াইয়ের পথে উজ্জীবিত করেছে। বঙ্গবন্ধু যতবার জেলে গেছেন ততবারই তাঁর সঙ্গে থাকত সঞ্চয়িতা।
শেখ হাসিনা তাঁর ‘শেখ মুজিব আমার পিতা’ গ্রন্থে অবহিত করেন, ‘১৯৪৯ থেকে আব্বা যতবার জেলে গেছেন কয়েকখানা নির্দিষ্ট বই ছিল যা সব সময় আব্বার সঙ্গে থাকত। জেলখানায় বই বেশিরভাগই জেল লাইব্রেরিতে দান করে দিতেন কিন্তু আমার মা’র অনুরোধে এই বই কয়টা আব্বা কখনও দিতেন না, সঙ্গে নিয়ে আসতেন। তার মধ্যে রবীন্দ্র-রচনাবলি, শরৎচন্দ্র, নজরুলের রচনা, বার্নাড শ’র কয়েকটা বইতে সেন্সর করার সিল দেওয়া ছিল।…মা এই কয়টা বই খুব যত্ন করে রাখতেন। আব্বা জেল থেকে ছাড়া পেলেই খোঁজ নিতেন বইগুলি এনেছেন কিনা। যদিও অনেক বই জেলে পাঠানো হতো। মা প্রচুর বই কিনতেন আর জেলে পাঠাতেন। নিউ মার্কেটে মার সঙ্গে আমরাও যেতাম। বই পছন্দ করতাম, নিজেরাও কিনতাম। সব সময়ই বই কেনা ও পড়ার একটা রেওয়াজ আমাদের বাসায় ছিল।…আমার খুবই কষ্ট হয় ঐ বইগুলির জন্য যা ঐতিহাসিক দলিল হয়েছিল। কিন্তু ১৯৭১ সালে সবই হারালাম।’ (শেখ মুজিব আমার পিতা, পৃষ্ঠা : ৭০ ও ৭১)।
বঙ্গবন্ধু তাঁর জীবনে কাব্য চর্চা করে কবি হতে পারেননি ঠিকই কিন্তু হয়েছেন রাজনীতির কবি। তাঁর ভাষণে থাকতো রবীন্দ্রনাথের কবিতার উদ্ধৃতি এতে তাঁর ভাষণও হয়ে যেত কবিতার পঙ্ক্তি। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের ওপর প্রতিবেদন তৈরি করতে গিয়ে বিশ্বখ্যাত মার্কিন সাপ্তাহিক নিউজউইক পত্রিকা তাদের নিবন্ধ ‘দ্য পয়েট অব পলিটিক্স’-এ লেখা হয়, ‘৭ মার্চের ভাষণ কেবল একটি ভাষণ নয়, একটি অনন্য কবিতা।’ ১৯৭১ সালের ৫ এপ্রিল সংখ্যায় ‘নিউজ উইক’ ছাপা হয়, ‘রাজনীতির প্রকৌশলী নন মুজিব, মুজিব হচ্ছেন রাজনীতির কবি, বাঙালির স্বাভাবিক প্রবণতা প্রায়োগিক নয়, শৈল্পিক; তাই মনে হয়, বাংলাদেশের সব মানুষ, শ্রেণি ও মতাদর্শকে এক সূত্রে গাঁথা হয়তো কেবল মুজিবের মতো রাজনৈতিক কবির পক্ষে সম্ভব।’
বঙ্গবন্ধু তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে লিখেছেন, তিনি কবি ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ ও তাঁর সহকর্মী জনাব মাজহারের সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলেন, রুশ লেখক আইজ্যাক অ্যাসিমভ, তুর্কি কবি নাজিম হিকমতের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন, পাঞ্জাবে অনুষ্ঠিত প্রগতিশীল লেখকদের সম্মেলনে যোগদান করেছেন, লাহোরে কবি আল্লামা ইকবালের বাড়ি ‘জাভেদ মঞ্জিল’-এ অবস্থান করেছেন। তাঁর রাজনৈতিক গুরু হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী সাহেবের সঙ্গে করাচি অভিমুখে যাত্রাকালে তিনি সহযাত্রী কয়েকজন কৌঁসুলিকে কাজী নজরুল ইসলামের কিছু কবিতা ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতাংশ আবৃত্তি করে শোনান। বাংলা ভাষার দিগন্তকে বিস্তৃত করার জন্য বিশ্বকবির অবদানকে বঙ্গবন্ধু বিনয়ের সঙ্গে স্মরণ করতেন। চীনে ভ্রমণকালে তিনি তাঁর উপলব্ধি লিপিবদ্ধ করেন, ‘কবিগুরু রবীন্দ্রনাথকে না জানে এমন শিক্ষিত লোক চীন কেন দুনিয়ার অন্যান্য দেশেও আমি খুব কম দেখেছি।’ (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃষ্ঠা : ২২৮)
স্বদেশে বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় তিনি যেমন প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়েছেন তেমনি বৈশ্বিকপর্যায়ে বাংলা ভাষার মহত্ত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব উন্মোচনে তিনি ছিলেন অতি উদ্যমী। ১৯৫২ সালে পিকিংয়ে এশীয় ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় আঞ্চলিক শান্তি সম্মেলনে তিনি বাংলা ভাষায় বক্তৃতা প্রদান করেন। বঙ্গবন্ধু ও ভারতের ঔপন্যাসিক মনোজ বসু বাংলায় বক্তব্য উপস্থাপন করায় কৌতূহলী অনেক শ্রোতাকে বঙ্গবন্ধু যেভাবে উত্তর দান করেন তা স্মরণযোগ্য, ‘বাংলা ভাষা যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষা এ অনেকেই জানে। ঠাকুর দুনিয়ায় ‘ট্যাগোর’ নামে পরিচিত। যথেষ্ট সম্মান দুনিয়ার লোক তাঁকে করে।..পাকিস্তানের শতকরা ৫৫ জন লোক এই ভাষায় কথা বলে এবং দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ ভাষার অন্যতম ভাষা বাংলা।’ (আমার দেখা নয়াচীন, পৃষ্ঠা : ৪৪)
বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদস্বরূপ ১৯০৫ সালের ৭ আগস্ট যে গান বাউল সুরে গীত হয় তা বঙ্গবন্ধুর অভিপ্রায় অনুযায়ী সার্বভৌম বাংলাদেশের জাতীয় সংগীতরূপে স্বীকৃতি লাভ করে। বঙ্গবন্ধু শিল্পী জাহিদুর রহিমের কণ্ঠে ‘আমার সোনার বাংলা’ শুনতে পছন্দ করতেন। বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে জাহিদুর রহিম বঙ্গবন্ধু কর্তৃক আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রায় নিয়মিত রবীন্দ্রসঙ্গীত পরিবেশ করতেন। বঙ্গবন্ধু ‘হে মোর দুর্ভাগা দেশ’, ‘সুপ্রভাত’, ‘বিপদে মোরে রক্ষা করো’, ‘দুই বিঘা জমি’ প্রভৃতি কবিতা যেমন আবৃত্তি করতেন, তেমনি গুন গুন করে রবীন্দ্রনাথের গানও গাইতেন। ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে’, ‘নাই নাই ভয়, হবে হবে জয়, খুলে যাবে এই দ্বার’ বঙ্গবন্ধুর প্রিয় গানগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য।
১৯৫৬ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত পাকিস্তান গণপরিষদের অধিবেশনে পাকিস্তানের পশ্চিমাংশ থেকে আগত সংসদ সদস্যগণের সম্মানে বঙ্গবন্ধু কার্জন হলে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রনাথ, নজরুলের গানসহ লোকসংগীত পরিবেশিত হয়। ডি এল রায় রচিত ‘ধন ধান্য পুষ্প ভরা’ গানটি বঙ্গবন্ধুর প্রিয় গান হিসেবে অনুষ্ঠানে গীত হয়। অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী সনজীদা খাতুনকে ‘আমার সোনার বাংলা’ গাইবার জন্য বঙ্গবন্ধু অনুরোধ জানিয়েছিলেন। পাকিস্তানিদের নিকট ‘সোনার বাংলা’-র রূপমাধুর্য ও প্রীতি পৌঁছে দেয়ার উদ্দেশ্যে বঙ্গবন্ধু এ গানটি নির্বাচন করেছিলেন।
পাকিস্তানি সরকারের বিরোধিতা সত্ত্বেও বাঙালি পালন করে রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী। এতে দেশে অসাম্প্রদায়িক আন্দোলনের ধারা গতিশীল হয়ে ওঠে। এই আন্দোলনের ধারা অধিকতর বেগবান হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছয় দফা ঘোষণার পর। তাঁর স্বতন্ত্র জাতিসত্তার ভাবনায় রবীন্দ্রনাথ কীভাবে প্রেরণা যুগিয়েছিল এর প্রমাণ পাওয়া যায় ১৯৬৬ সালের ঢাকার ইডেন হোটেলে আওয়ামী লীগের তিনদিনব্যাপী কাউন্সিল অধিবেশনে। এই অধিবেশনের উদ্বোধন হয়েছিল ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’ গানটি দিয়ে, গানটির প্রতি ছিল তাঁর আলাদা আবেগ।
১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের সময় রবীন্দ্রসংগীত প্রচার বন্ধ থাকে। ১৯৬৭ সালের ২৩ জুন পাকিস্তান সরকার রবীন্দ্রসংগীত প্রচারের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে তৎকালীন তথ্যমন্ত্রী খাজা শাহাবুদ্দিন বলেন, ‘রবীন্দ্রসংগীত আমাদের সংস্কৃতির অঙ্গ নয়’। প্রতিবাদে সারাদেশে বিক্ষোভ দানা বেঁধে ওঠে। আওয়ামী লীগ প্রতিবাদ জানিয়ে বলে, ‘ক্ষমতাবলে হয়তো সাময়িকভাবে রেডিও ও টেলিভিশন হইতে রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রচার বন্ধ করা যাইতে পারে। কিন্তু গণচিত্ত হইতে রবীন্দ্রসঙ্গীতের সুমধুর আবেদনকে কোনোকালেই মুছিয়া ফেলা যাইবে না।’
১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি রেসকোর্স ময়দানে বক্তৃতা প্রদানকালে বঙ্গবন্ধু দৃঢ়কণ্ঠে উচ্চারণ করেন, ‘আমরা মির্জা গালিব, সক্রেটিস, শেক্সপিয়ার, এরিস্টটল, দান্তে, লেনিন, মাও সেতুং পড়ি জ্ঞান আহরণের জন্য। আর দেউলিয়া সরকার আমাদের পাঠ নিষিদ্ধ করে দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথের লেখা, যিনি একজন বাঙালি কবি এবং বাংলায় কবিতা লিখে যিনি বিশ্বকবি হয়েছেন। আমরা এই ব্যবস্থা মানি না আমরা রবীন্দ্রনাথের বই পড়বই, আমরা রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইবই এবং রবীন্দ্রসঙ্গীত এই দেশে গীত হবেই।’ (মুনতাসীর মামুন, পৃষ্ঠা : ২৯৬)
১৯৬৯ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলা একাডেমিতে আয়োজিত অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু উল্লেখ করেন, Tagore had reflected the hopes and aspiration of the millions of Bengalies through his works. Without him the Bengali Language was incomplete (The Pakistan Times, 17.12.1969). রবীন্দ্রসাহিত্য চর্চার ক্ষেত্রে সমধিক গুরুত্বারোপ করে বঙ্গবন্ধু তৎকালীন কেন্দ্রীয় বাংলা উন্নয়ন বোর্ডকে রবীন্দ্র-রচনাবলি প্রকাশের আহ্বান জানান। বঙ্গবন্ধু জানতেন, একটি জাতির ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি দমিত হলে সে জাতি ক্রমান্বয়ে নির্মূল হয়ে পড়ে। তাঁর ভাষায়, ‘একটি জাতিকে পঙ্গু ও পদানত করে রাখার সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা হলো তার ভাষা ও সংস্কৃতিকে বিনষ্ট করা।’ (মুনতাসীর মামুন, পৃষ্ঠা : ২৫৬)। তিনি শাহজাদপুরে অবস্থিত রবীন্দ্র কুঠিবাড়ি সংরক্ষণের দাবি উত্থাপন করেন। অনুষ্ঠানে কলিম শরাফী, জাহিদুর রহিম, আফসারী খানম, বিলকিস নাসির উদ্দীন ও রাখী চক্রবর্তী রবীন্দ্রসঙ্গীত পরিবেশন করেন।
১৯৭১ সালের ৩ জানুয়ারি রেসকোর্স ময়দানে জনসভা করেন বঙ্গবন্ধু রবীন্দ্রনাথ রচিত ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ গান দিয়ে অনুষ্ঠান শুরু হয়। ৩০০ ফুট দীর্ঘ এক সুবৃহৎ নৌকার অবয়বে তৈরি হয়েছিল মঞ্চ। এই মঞ্চে দাঁড়িয়ে আওয়ামী লীগের নির্বাচিত সদস্যরা শপথ নিলেন ৬ দফা বাস্তবায়নই তাদের লক্ষ্য। ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর জনপ্রিয়তা সার্বজনীন। ছাত্র-জনতা-রাজনৈতিক কর্মী ধীরে ধীরে এদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য মানসিকভাবে নিজেদের প্রস্তুতি করছেন। ঠিক সেই সময় বঙ্গবন্ধু শিক্ষার্থীদের জনসভায় রবীন্দ্র-নজরুল প্রসঙ্গে পাকিস্তানি শাসকদের মনোভাবের তীব্র সমালোচনা করেন। আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন ‘পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ’-এর ২৩তম বার্ষিকী উদযাপিত হয় ১৯৭১ সালের ৪ জানুয়ারি। এ উপলক্ষ্যে ঢাকার রমনায় আয়োজিত অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন প্রধান অতিথি। রবন্দ্রী-নজরুলকে পাকিস্তানি শাসকেরা বাদ দিতে চাইলে বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হন। তিনি বলেন, ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুলকে বাদ দিয়ে বাংলা ভাষা এবং সাহিত্যের কথা ভাবা যায় না। কিন্তু এর উপর বারবার হামলা এসেছে। ভেবে অবাক হতে হয়, কাজী নজরুলের কবিতার শব্দ পরিবর্তন করা হয়েছে।’
২৪ জানুয়ারি ঢাকার ইঞ্জনিয়ার্স ইনস্টিটিউটে পূর্ব পাকিস্তান সংগীতশিল্পী সমাজ বঙ্গবন্ধুর সম্মানে সংবর্ধনার আয়োজন করে। এই সংবর্ধনা সভায়ও তিনি রবীন্দ্র-নজরুলের প্রসঙ্গ উত্থাপন করেন। শিল্পীদের তিনি শ্রমজীবী মানুষের জন্য, সর্বহারা মানুষের জন্য গান রচনার আহ্বান জানান। তিনি তাদের বলেন, ‘আপনারা ভালোবাসা এবং শান্তির অনেক গান গেয়েছেন। আজ বস্তির নিঃস্ব সর্বহারা মানুষের জন্যে গান রচনার দিন এসেছে।’ তিনি রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের মতো বিপ্লবী গান গাইতে আহ্বান করেন।
১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি কারাগার থেকে মুক্তি পান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। ব্রিটিশ বিমানবাহিনীর বিমানে লন্ডন থেকে দিল্লি হয়ে ঢাকা ফেরেন বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা। ভারতীয় দূতাবাসের নির্দেশে কূটনৈতিক অফিসার শশাঙ্ক এস ব্যানার্জি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ছিলেন। তাঁর স্মৃতিচারণে জানা যায়, বিমানে বসে বঙ্গবন্ধু ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’ গাইতে শুরু করেন। এ সময় তাঁর চোখে জল দেখেন ভারতীয় কূটনৈতিক। গানটিকে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত করা উচিত বলে মনে করেন বঙ্গবন্ধু। তিনি মিস্টার ব্যানার্জিকে গানটি গাওয়ার অনুরোধ করেন। তাঁর ভাবনায় ছিল স্বাধীন বাংলাদেশ গঠন আর নতুন রাষ্ট্রের জাতীয় সংগীতও তিনি অনেক আগেই ঠিক করে রেখেছিলেন।
১০ জানুয়ারি স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে রবীন্দ্রনাথকে উদ্ধৃত করেন। সেদিন পাকিস্তনের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে রেসকোর্সের ময়দানে লাখ লাখ জনতার সামনে দাঁড়িয়ে কবিগুরুর সেই বিখ্যাত কবিতার লাইন ‘সাত কোটি বাঙালিরে হে মুগ্ধ জননী, রেখেছ বাঙালি করে মানুষ করোনি’র বিপরীতে অশ্রুভেজা কণ্ঠে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘কবিগুরু তোমার উক্তি ভুল প্রমাণিত হয়েছে। দেখে যাও তোমার বাঙালি আজ মানুষ হয়েছে।’ রবীন্দ্রগবেষকরা মনে করেন এর থেকে বড় শ্রদ্ধার্ঘ্য কবিগুরুর প্রতি মুক্তিযুদ্ধের মহানায়কের আর কী হতে পারে?
১২ জানুয়ারি তারিখে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নতুন মন্ত্রিপরিষদ গঠন করেন। প্রধানমন্ত্রীরূপে শপথ গ্রহণের কিছুক্ষণ পরেই জনৈক সাংবাদিক যখন বঙ্গবন্ধুকে জিজ্ঞেস করেন, ‘স্যার, আজকের দিনে জাতির প্রতি আপনার বাণী কি?’ জবাবে চিরাচরিত হাস্যমুখে তিনি বলেন, ‘উদয়ের পথে শুনি কার বাণী, ভয় নাই ওরে ভয় নাই, নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান, ক্ষয় নাই তার ক্ষয় নাই।’ তিনি ১৯৭২ সালের ১৩ জানুয়ারি মন্ত্রিসভার বৈঠকে রবীন্দ্রনাথ রচিত ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’ বাংলাদেশের জাতীয় সংগীতে রূপ দেন। বঙ্গবন্ধুর অভিপ্রায় অনুযায়ী সার্বভৌম বাংলাদেশের জাতীয় সংগীতরূপে ‘আমার সোনার বাংলা’ স্বীকৃতি লাভ করে।
আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে প্রতিবেশী দেশ ভারত সুদৃঢ় ও প্রত্যক্ষ সমর্থন জুগিয়েছে। শরণার্থীদের আশ্রয়দান, প্রবাসী সরকার গঠনে সহায়তা এবং মুক্তিবাহিনীর সংগঠন, সামরিক প্রশিক্ষণ ও সমরাস্ত্র দিয়ে ভারতের ভূমিকা ছিল প্রত্যক্ষ। ভারত সরকারের আমন্ত্রণে বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি কলকাতা সফরে যান। কলকাতার ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডে ভারতের ইতিহাসের বৃহত্তম জনসভায় বঙ্গবন্ধু ভারতবাসীকে কৃতজ্ঞতা জানান। কলকাতার ওই জনসভায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শখ মুজিবুর রহমানের ভাষণে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রসঙ্গ বারবার এসেছে।
বাংলা একাডেমি আয়োজিত ১৯৭২ সালের ৮ মে রবীন্দ্র জন্মবার্ষিকীতে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে লাখ লাখ প্রাণ ও অপরিমেয় ত্যাগের বিনিময়ে। কিন্তু সত্য, শ্রেয়, ন্যায় ও স্বজাত্যের যে চেতনা বাঙালি কবিগুরুর কাছ থেকে লাভ করেছে, আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রামে তাঁরও অবদান অনেকখানি। বাঙালির সংগ্রাম আজ সার্থক হয়েছে। বাঙালির রবীন্দ্র-সম্মাননার চেয়ে বড় কোনো দৃষ্টান্ত আমার জানা নেই।’ ১৯৭৪ সালে বাংলা একাডেমি আয়োজিত আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলন উদ্বোধন করছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সম্মেলনে আমন্ত্রণ জানাতে গিয়েছিলেন একাডেমির কর্মকর্তাবৃন্দ। তিনি তাঁদের বলেছিলেন, ‘আমি রবীন্দ্রনাথ পড়ি, ভালোবাসি তাঁকে-সাহিত্যে আমার পুঁজি তো ওইটুকুই।’
বঙ্গবন্ধুর রবীন্দ্রপ্রীতির কথা বলতে গিয়ে ১৯৭২ সালে বেগম মুজিব দৈনিক বাংলার সাংবাদিককে অত্যন্ত আবেগময় ভাষায় বলেন, ‘কোনো কারণে আমি মনোক্ষুণ্ন হলে অতীতে বঙ্গবন্ধু আমাকে কবিগুরুর কবিতা শোনাবার প্রতিশ্রুতি দিতেন। আজও শত কাজের চাপে ব্যস্ত থাকা সত্ত্বেও এতটুকু সময় পেলেই সন্তানদের নিয়ে তিনি কাব্য আলোচনা করেন, আবৃত্তি শোনান পরিবারের লোকদের। রবীন্দ্র শতবার্ষিকীর সময় একবার একজন বিশ্বস্ত লোককে দিয়ে আমি রবীন্দ্র রচনাবলির পুরো এক সেট কলকাতা থেকে আনিয়েছিলাম। ওর সামনে যখন উপহার হিসাবে বইগুলো উপস্থিত করলাম, খুশির আবেগে তিনি তখন বিহ্বল হয়ে পড়লেন। উজ্জ্বল চোখ দুটো তুলে একবার শুধু তাকালেন। সে চোখে ছিল শিশুর মতো তৃপ্তি আর প্রগাঢ় কৃতজ্ঞতা।’
রবীন্দ্রনাথ ছিলেন এক মহাসমুদ্রের মতো, যেকোনো দিকে তাকালেই যাঁর বিবিধ রূপ সহজেই ধরা পড়ে। তাঁর মহাপ্রয়াণের ঠিক ত্রিশ বছর পর স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম হয়। আর এ দেশে জন্মগ্রহণ করেন এমন আর এক বাঙালি কালের বিবর্তনে যিনি হয়েছেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি। বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসে বঞ্চিত নিপীড়িত মানুষের কত শত সংগ্রামের শীর্ষ যিনি রচনা করেছিলেন, বাংলাকে তাঁর মতো আর কে ভালোবেসেছে? সাংবাদিক যখন তাঁকে প্রশ্ন করেছিলেন ‘হে মহানায়ক, আপনার শক্তি কোথায়? তিনি উত্তর দিয়েছিলেন ‘বাংলার মানুষকে আমি ভালোবাসি, সেই আমার শক্তি।’ সাংবাদিকের আবার প্রশ্ন ‘আর আপনার দুর্বলতা? তাঁর উত্তর ‘বাংলার মানুষকে আমি বড় বেশি ভালোবাসি, সেই আমার দুর্বলতা।’
বাংলাদেশ, বাংলা ভাষা ও বাঙালি সংস্কৃতি যতদিন থাকবে, ততদিন এ দু’জন আমাদের আলোকবর্তিকা হয়ে থাকবেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে লিখেছেন, ‘একজন মানুষ হিসেবে সমগ্র মানবজাতি নিয়েই আমি ভাবি। একজন বাঙালি হিসেবে যা কিছু বাঙালিদের সঙ্গে সম্পর্কিত তাই আমাকে গভীরভাবে ভাবায়। এই নিরন্তর সম্পৃক্তির উৎস ভালোবাসা, অক্ষয় ভালোবাসা, যে ভালোবাসা আমার রাজনীতি এবং অস্তিত্বকে অর্থবহ করে তোলে।’ এক বিশাল পরিপূর্ণ হৃদয় দিয়ে তিনি মানবকল্যাণের প্রতি গভীর মমত্ববোধ তাঁর জীবনবোধের মধ্য দিয়ে প্রস্ফুটিত কওে তুলেছেন।
দেশ-পরিচালনায় জাতির পিতার সুযোগ্য কন্যা একটি অসাম্প্রদায়িক, নিরক্ষরতা-ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত সমৃদ্ধ সোনার বাংলা গড়তে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। তিনি ইতোমধ্যেই আমাদের সামনে ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশের স্বপ্ন তুলে ধরেছেন। তিনি ডিজিটাল বাংলাদেশ থেকে স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে কাজ করছেন। কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে হলে বঙ্গবন্ধুর শিক্ষাদর্শন যথাযথ বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে সর্বস্তরে আলোকিত মানুষ এবং কল্যাণমুখী সমাজের দিকে ধাবিত হতে পারলেই উন্নত ও সমৃদ্ধ রাষ্ট্র গঠন সহজতর হবে। তাই বঙ্গবন্ধু এবং রবীন্দ্রনাথের ভাবনা ও আদর্শকে ধারণ করে বিজ্ঞানভিত্তিক, আধুনিক, উন্নত, সমৃদ্ধ, স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে আমাদের সকলকেই আত্মনিয়োগ করতে হবে।
লেখক : পুলিশ সুপার, নৌ পুলিশ, সিলেট অঞ্চল