রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে তসলিমা নাসরিন-এর কবিতা

: কালস্রোত ডেস্ক
প্রকাশ: ৮ মাস আগে

ধরা যাক রবীন্দ্রনাথ বেঁচে আছেন,

অসুখ বিসুখ নেই, শয্যাশায়ী নন,

দিব্যি লিখছেন, গাইছেন, ভাবছেন, ভ্রমণ করছেন।

বেঁচে থাকলে আমার চিঠির জবাব দিতেন তিনি,

লিখতেন, ‘তোমার সরলতা আর সততার কথা যখন বললে,

এক মুহূর্তে আমার স্নেহ অধিকার করে নিলে তুমি।

যদি চিঠি লিখতে দেরি হয়, লিখতে যদি নাও পারি,

তাতেই বা এমন কী দুঃখ!

তোমাকে যখন স্নেহ করি তখন চিঠির চেয়েও

আমার মন তোমার ঢের বেশি কাছে আছে।’

অনেকদিন না লিখলে বলতেন, ‘ছোট হোক মন্দ হোক,

একটা করে চিঠি আমায় রোজ লেখো না কেন বলো?’

আমাকে জোড়াসাঁকোর বাড়িতে ডাকতেন,

কখনও শান্তিনিকেতনে,

সোনাঝুরি বনে হাঁটতে হাঁটতে বলতেন বিন্দুর মতো যেন না হই, যেন বাঁচি,

যেন মৃণালের মতো হই, অথবা মৃণালের চেয়েও সাহসী।

আমার দুঃখগুলো প্রেমকাঁটা তুলে ফেলার মতো

আমার মন থেকে একটি একটি করে তুলে ফেলতেন।

শিলং পাহাড়ে বেড়াতে নিয়ে ছাব্বিশের যুবক হয়ে উঠতেন,

শেষের কবিতার অমিত হয়ে উঠতেন,

হাতে হাত ধরে হাঁটতেন সুঠাম সুদর্শন,

তাঁর স্পর্শের উষ্ণতা আমার বরফ-শীতল একাকীত্বকে নিমেষে

ঝর্ণার উচ্ছল জল করে দিত।

গোটা বাংলা থেকে আমার আজীবন নির্বাসন,

আমার গৃহবন্দিত্ব,

আমার পায়ে পায়ে নিষেধাজ্ঞা,

আমার মাথার মূল্য,

পায়ের নিচে মাটি না থাকা,

শুধু সমতা চেয়েছি বলে,

শুধু সভ্য সুস্থ সমাজ চেয়েছি বলে,

শুধু লিখেছি বলে,

কবিতা বা গল্প প্রবন্ধ লিখেছি বলে;

রবীন্দ্রনাথ যদি বেঁচে থাকতেন, আমি নিশ্চিত,

দেখে প্রাণ বড় কাঁদতো তাঁর।

তিনি ভর্ৎসনা করতেন শাসকদের,

সভ্যতার সংকট দেখে আতঙ্কে কুঁকড়ে থাকতেন।

আমি তাঁর পিঠে মনে মনে  আলতো হাত রেখে তাঁর দুশ্চিন্তাগুলো

একটু একটু করে উড়িয়ে দিতে চাইতাম,

 কপালে তিনি চুম্বন করতেন আমার।

একদিন  বলতেনই, ‘বোটে করে চলো শিলাইদহে যাই।

আমার সারা মন তিরতির করে কাঁপতো আনন্দে,

তাঁর গভীর চোখ সেই আনন্দকে দেখতে পেতো

তাঁর আঙুল সেই আনন্দকে স্পর্শ করতে পারতো,

আমাকে স্বদেশের জল মাটির স্বাদ গন্ধ  দিতে তিনি  শিলাইদহে নিতেন।

বোটে শুয়ে আকাশে তাকিয়ে তাকিয়ে  সন্ধ্যার মেঘমালা দেখতেন,

আমি  আধশোয়া হয়ে  আকাশ নয়, তাঁকেই দেখতাম অপলক।

তখন আমার অমল ধবল মনে মন্দ মধুর হাওয়া,

তখন চারদিক থেকে নির্জনতা তার জলতরঙ্গ বাজিয়ে যেতো,

তখন তিনি গেয়ে উঠতেন, ‘আমি কান পেতে রই…’

গান শেষে, হেসে, আরও কাছে ডেকে  বলতেন,

‘এই তারাময় আকাশের নিচে

আবার কি কখনও জন্ম নেবো?

যদি নিই, আর কি কখনও এমন প্রশান্ত সন্ধ্যাবেলায়

এই নিস্তব্ধ নদীটির ওপর

এমন নিশ্চিন্ত মুগ্ধ মনে

এমন নৌকোর  ওপর বিছানা পেতে থাকবো আবার?’

তাঁর একটি হাত আমার হাতের মুঠোয় নিয়ে বলতাম,

‘আবার কেন জন্ম নিতে হবে!

আপনার এক জন্মই সহস্র জন্মের  সমান।’

সারারাত পূর্ণিমার জলে স্নান করে কবি গা মোছেন আমার আঁচলে,

অস্ফুট কণ্ঠে ভোররাত্তিরে বলেন,

‘শিলাইদহে আমি কেন আসি জানো, প্রকৃতির শুশ্রূষা পাবো বলে আসি।

আজ তোমার শুশ্রূষাও পেলাম।’

কুঠিবাড়ির দিকে যেতে যেতে বলেন,

‘তুমিও তো প্রকৃতি ভালোবাসো।

যাও দেখে এসো গাছপালা নদী হাওর,

এ তোমার সোনার বাংলা,

এ তোমার দেশের মাটি!’

আমি নিশ্চুপ শুনি,

আমার কাঁধে তাঁর ডান হাত,

‘কোনও ভয় নেই, আমার আশীর্বাদ তোমার সঙ্গে আছে।’

আমি তবু নিরুত্তর।

কুঠিবাড়িতে পৌঁছে বলেন, ‘তৈরি হয়ে নাও

 সকালের গাড়িতে তোমাকে আমিই উঠিয়ে দেবো।’

তবুও আমি নতমুখ দাঁড়িয়ে থাকি,

বলি, ‘আমি তো যাবো না কোথাও।

‘কেন, ব্রহ্মপুত্রে সাঁতার কাটবে না?

 দেখবে না তোমার বাড়িঘর, তোমার উঠোন!

উঠোনের ঘাসের ওপর একটি শিশিরবিন্দু!’

‘তার আর দরকার হবে না।’

‘কেন হবে না?’ রবীন্দ্রনাথ বিস্ময়ে থমকে দাঁড়ান।

আমি বলি, ‘ভাষাটিই আমার দেশ,

ভাষাটিই আমার সেই অপরূপ শিশিরবিন্দু,

আপনার গান কবিতাই,

আপনার সুর আর শব্দগুচ্ছই আমার দেশ,

আপনিই, আপনার  স্নেহই  আমার নিরাপদ স্বদেশ।

পদ্মার জলে আমি ব্রহ্মপুত্র দেখে নিয়েছি,

ঈশ্বর বলে কোথাও কিছু নেই, ঈশ্বরে বিশ্বাস নেই আমার।

তার পরও যদি নিভৃতে কেউ থাকে কোথাও,

যদি কেউ থাকে আমার হৃদয়ে,

ঈশ্বরের মতো কেউ,

সে রবীন্দ্রনাথ।’

যদি বেঁচে থাকতেন তিনি,

আমাকে বুকে জড়িয়ে বলতেন,

‘শুধুই কি স্নেহ, তোমাকে তো ভালোওবাসি, সে তুমি জানো?’

হ্যাঁ বা না বলার দরকার হতো না,

তিনি জানতেন যে আমি জানি।

#