অকথিত এক উপাখ্যান

: মোনালিসা মুজিব মিম
প্রকাশ: ৭ মাস আগে

শব্দ হিসেবে পরিচিত হলেও, খুব বেশি অপ্রচলিত সেই শব্দের ব্যবহার। অপ্রচলিত না বলে ইচ্ছাকৃতভাবে অব্যবহৃত বললেই বেশি যৌক্তিক হবে। অবশ্য এসব আর নতুন কী! সমাজের চোখে যেটা নেতিবাচক, সেটা পর্দার আড়ালে থাকাটাই তো সমীকরণ হিসেবে সহজ। বলছিলাম পতিতাবৃত্তির কথা। রাস্তায় ক্ষতবিক্ষত শরীরের একটা অসুস্থ কুকুর দেখলেও আমরা ততটা নাক সিটকাই না, আমাদের নাক-মুখ যতটা সিটকে যায় পতিতাদের নিয়ে কথা বলার সময়। চুরি-ডাকাতির কোনো ঘটনা বলার সময় উচ্চস্বরে বললেও আমাদের গলার আওয়াজ অনেকটা নিচে নেমে যায় যখন পতিতাবৃত্তি নিয়ে কোনো কথা বলা হয়, যেন এটাই সমাজের সবচেয়ে বড় অপরাধ। ভাবটা এমন- যেন খুব সাবধানে বলতে হবে, যেন কেউ এই শব্দ শুনলেও পাপ।

পতিতাবৃত্তি যদি এত নারকীয় কিছু হয়ে থাকে, তাহলে দেশে পতিতালয় কেন অনুমোদন দেওয়া হল? ১৪টা পতিতালয় যেখানে সরকার কর্তৃক অনুমোদন দেওয়াই হয়েছে, সেখানে পতিতাদের এত ঘৃণিত চোখে কেন দেখা হয়? কেন তাদের জীবনের অবস্থা শোচনীয়? কয়জন মেয়ে স্বেচ্ছায় পতিতালয়ে যায়? কেউ পাচারের শিকার হয়ে পতিতালয়ে, কেউ প্রেমিকের প্রতারণার শিকার হয়ে পতিতালয়ে, কেউ চাকরির প্রলোভনের ফলাফলস্বরুপ পতিতালয়ে। এই মেয়েদের জীবন অনিচ্ছায় শেষ হয়ে গেছে। তারা এখন চাইলেও আর সমাজে স্বাভাবিকভাবে ফিরে আসতে পারবে না। এভাবে পরবর্তীতে আরও নারী হারিয়ে যাবে আমাদের সমাজ থেকে। বাকি জীবন কাটিয়ে দিবে অন্ধকারে, দরজার আড়ালে।

পতিতালয়ের উদ্দেশ্য আসলে কী? কী ভূমিকা রাখছে এই প্রতিষ্ঠান? যদি এটাকে উপার্জনের উৎস হিসেবেই বিবেচনা করা হয়, নিতান্তই একটা শিশুসুলভ উত্তর হবে সেটা। ডিজিটাল বাংলাদেশে শত শত শিল্পকারখানার যুগে পতিতালয়কে কেন উপার্জনের উৎস হিসেবে দাঁড় করানো হবে? এবার আরেকটু দূরদৃষ্টিতে তাকানো যাক। পতিতাদের জীবন তো নষ্ট হয়ে গেছেই। কিন্তু পরবর্তী প্রজন্ম? একটা শিশুর জন্মস্থানের ক্ষেত্রে তার হাত কোথায়? সে কেন বাকি পাঁচটা বাচ্চার মত সুস্থ-সুন্দর পরিবেশে বড় হতে পারবে না? সে কেন শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হবে? সে কেন মেডিকেলে বা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পাবে না? ভোগান্তির সূত্র ধরে কেন শুধু ভোগান্তির শিকলই দীর্ঘ হতে থাকবে? একটা শিশু অধিকার রাখে একটা স্বাভাবিক জীবনের, একটা সুস্থ পরিবেশের। তাহলে অঙ্কুরেই বিনষ্ট হওয়ার এই দায়ভারটা কার?

পতিতাবৃত্তি যদি এতটাই ঘৃণ্য কিছু হয়ে থাকে, তবে দেশের সব পতিতালয় উচ্ছেদ করে দেওয়া হোক। তাদেরকে অন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দেওয়া হোক। আর যদি পতিতালয়ের অনুমোদনই দেওয়া হয়, তবে সেখানে সবার স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা হোক। পতিতাদের জীবনের কষ্টের উপাখ্যান নিয়ে লিখলে হয় তো উপন্যাস হয়ে যাবে, কিন্তু এই কঠোর বাস্তবতার পৃথিবীতে আর আবেগি উপন্যাস মানাচ্ছে না। এখন কংক্রিট কিছু কথা বলার সময়। নতুন প্রজন্মের শিক্ষা, সুরক্ষা এবং স্বাভাবিক জীবন সুনিশ্চিত করা হোক। কারো ভোগবিলাসের কারণে কিংবা কারো জীবনে ঘটে যাওয়া অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনার ফলাফলস্বরূপ আরও ১০ জন ভুগতে পারে না। নিরপরাধ বাচ্চাগুলো দেহব্যবসায় লিপ্ত হতে পারে না। শিশু হয়েও চোরের মতো অন্ধকারে লুকিয়ে বাঁচতে পারে না। একটা দেশকে কতটুকু আধুনিক বলে দাবি করা যাবে, যে দেশের শিশুরা একটা সুস্থ জীবন আর স্বাভাবিক পরিবেশ পাচ্ছে না, শুধুমাত্র তাদের জন্মদাত্রীর সামাজিক অবস্থানের কারণে?

 

লেখক : শিক্ষার্থী, ইংরেজি বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

#