‘একবার পরীক্ষায় কয়েকটা বিষয়ে আমি ফেল করেছিলাম; কিন্তু আমার বন্ধু সব বিষয়েই পাস করে। এখন সে মাইক্রোসফটের একজন ইঞ্জিনিয়ার আর আমি মাইক্রোসফট-এর প্রতিষ্ঠাতা’- (বিল গেট)। মাইক্রোসফটের প্রতিষ্ঠাতার এই উক্তিই প্রমাণ করে পরীক্ষায় খারাপ ফল মানেই সব শেষ নয়। ক্লাসে ব্যাকবেঞ্চাররা কর্মজীবনে ভালো সাফল্য দেখায় এমন অসংখ্য প্রমাণ রয়েছে। গত ১২ মে এসএসসি, দাখিল ও সমমানের পরীক্ষাযর ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে। পাশের গড় হার ৮৩.৪ শতাংশ। জানা গেছে, এবার ২৯ হাজার ৮৬১টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ২০ লাখ ২৪ হাজার ১৯২ জন শিক্ষার্থী এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষা দেয়। তাদের মধ্যে পাশ করেছে ১৬ লাখ ৭২ হাজার ১৫৩ জন। জিপিএ-৫ পেয়েছে ১ লাখ ৮২ হাজার ১২৯ জন শিক্ষার্থী। পাশের হারের দিক থেকে যশোর বোর্ড শ্রেষ্ঠ এবং সর্বনিম্ন পাশের হার সিলেটে। রেজাল্ট প্রকাশের পর একদিকে ভালো রেজাল্ট করা শিক্ষার্থীদের মধ্যে আনন্দ-উল্লাস, পত্রিকার পাতায় জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীদের উল্লাসের ছবি ছাপা হয়েছে। অন্যদিকে বেদনার চিত্র। পরীক্ষায় যারা পাস করতে পারে নি তারা ‘সব শেষ’ এমন হতাশায় নিমজ্জিত। ফেল করা ছাত্রছাত্রীদের চেয়ে বেশি হতাশ তাদের মা-বাবা, ভাই-বোন, পরিবার-পরিজন। পরিবারের গালমন্দ এবং নানা কটূক্তির কারণে এই ফেল করা ছাত্র-ছাত্রীদের কেউ কেউ গ্লানি, ক্ষোভে আত্মহত্যা করছে। সংবাদমাধ্যমে খবর এসেছে এখন পর্যন্ত ৮ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে। এদের মধ্যে ৬ জন ছাত্রী ও দুই জন ছাত্র। পাবলিক পরীক্ষায় সাফল্য পেতে ব্যর্থ হয়ে শিক্ষার্থীদের এই আত্মহত্যার ট্রাজেডির দায় কার? শিক্ষার্থীরাই কি শুধু দায়ী? সমাজ, শিক্ষাব্যবস্থা কি এর দায় এড়াতেপারে? খারাপ ফলাফল করা ছাত্রছাত্রীর কেন ফেল করল তা নিয়ে কী কোনো গবেষণা হয়েছে?
এখানে একজন শিক্ষার্থী যতই জানুক না কেন সে যদি জিপিএ ফাইভ না পায় তবে তার কোন মূল্য থাকে না। পিতা-মাতা সন্তানদের একটা প্রতিযোগিতার মধ্যে ঠেলে দেয় এবং সন্তানরা এই প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে না পারলে ভাবে মা-বাবাকে মুখ দেখাব কীভাবে? এই যে পারিবারিক সলিডারিটি বা ইন্টিগ্রেশন এটার অভাবে শিক্ষার্থীরা এই পথ বেছে নেয়। এছাড়াও আমাদের সমাজে এক ধরনের মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তন ঘটে গেছে। পড়াশুনা-রেজাল্ট এর বাইরে অনেক তুচ্ছ কারণে এ যুগের বাচ্চারা আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। শিক্ষার্থীদের বোঝাতে হবে যে তুমি যদি মোটামুটিভাবে সততার সাথে জীবনযাপন করো তাহলে তুমি আজ না হয় কাল সফল হবেই। একজন সাধারণ শ্রমজীবী মানুষও কিন্তু সফল। সফলতা কি সেটা নিয়ে আমাদেরকে চিন্তা করতে হবে। মানুষ তার নিজের কাজ নিজে কতটা এনজয় করতে পারছে সেখানেই তার সফলতার পরিচয়। এছাড়া কারো নিজের অবস্থানের চেয়ে খারাপ অবস্থানে থাকা মানুষটার দিকে তাকিয়ে তার মাঝে এই উপলব্ধিটা যদি জাগ্রত করা যায় যে, সে আসলে তার চেয়ে সফল, তবেই আত্মহত্যা প্রতিরোধ করা সম্ভব। মূলকথা কারো মাঝে যদি বাবা-মা ও এই সমাজের প্রতি ভালোবাসা জাগ্রত করা যায় তবেই তাকে এই পথ থেকে ফেরানো সম্ভব। কৈশোর-তারুণ্যে ছেলেমেয়েদের মন থাকে উর্বর। উর্বর মস্তিষ্কে যেন রঙিন চশমা চোখে দিয়ে আকাশ-পাতাল স্বপ্ন দেখে; তেমনি যখন তখন যেকোনো অপ্রীতিকর, ভয়ংকর সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। পরীক্ষায় প্রত্যাশিত রেজাল্ট করতে না পারার ব্যর্থতার হতাশা, গ্লানি, ক্ষোভ থেকে তারা আত্মহত্যাকে জীবনের সমস্যার সমাধান হিসেবে বেছে নিচ্ছে। ফলে অভিভাবক, শিক্ষক এবং সমাজের বড়দের অনেক দায়িত্ব হতাশাগ্রস্ত এই কিশোর-কিশোরীদের পাশে দাঁড়ানো। বাবা-মা ও পরিবারকে আমার ছেলেমেয়ে ক্লাসে ফার্স্ট হবে এবং পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করবে এমন মানসিকতার পাশাপাশি সন্তানরা যাতে মানুষ হয় সে চিন্তা করা উচিত। একইসঙ্গে সন্তান পরীক্ষায় প্রত্যাশিত রেজাল্ট করতে ব্যর্থ হলে তাকে সান্ত্বনা দেয়া উচিত
জীবন হচ্ছে সফলতা-ব্যর্থতার পালাবদলের এক অবিরাম ধারা। কোনো একটি কাজে ব্যর্থ হওয়া মানে শেষ হয়ে যাওয়া নয়। এজন্য আত্মহত্যার পথ বেছে নেওয়া বোকামি। পরীক্ষায় ব্যর্থতা বা যেকোনো ব্যর্থতার পর কেউ ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে, কেউ তীব্র নেতিবাচক আবেগে বিস্ফোরিত হয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করে, আবার কেউ সাময়িক আপসেট থাকে মাত্র। কে কোন ধরনের আবেগের প্রতিক্রিয়া দেখাবে, তা অনেক দেহ-মন-সামাজিক কারণের উপর নির্ভর করে। ক্লাসের সবাই পড়েন কিন্তু সব শিক্ষার্থীর মেধা সমান হয় না। যারা পরীক্ষায় খারাপ ফলাফল করছে তাদের মধ্যেও সুপ্ত মেধা লুকিয়ে রয়েছে। সেই মেধাকে বের করে আনাই শিক্ষক ও শিক্ষা বিশারদদের কাজ। যে ফেল করেছে তার কষ্ট। বাবা-মা, পরিবার-পরিজন, আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী, সমাজ তাকে কেন আরো কষ্ট দেবে? মনের কষ্টে অনেক সময় এসব কোমলমতি শিক্ষার্থীরা দুর্ঘটনা ঘটিয়ে ফেলে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের প্রফেসর ডক্টর এ কে এম করিম বলেন, এখনকার অনেক ছেলেমেয়ের সাথে পরিবারের সম্পর্ক ভালো না। পারিবারিক বন্ধনের অভাবে ছেলেমেয়েরা তাদের সমস্যা শেয়ার করে বাইরে বন্ধুদের সাথে। ফলে খুব স্বাভাবিকভাবেই তাদের অনেক সমস্যার কথা বাইরে ছড়িয়ে পড়ে এবং শেষ পর্যন্ত তা তাদেরকে আত্মহত্যার দিকে ধাবিত করে। কারণ মানসিক এমন পর্যায়ে শিক্ষার্থীরা সবকিছু থেকে মুক্তি চায়। আর এ পথকেই তারা মুক্তি হিসেবে দেখে। সুতরাং আত্মহত্যার হার হ্রাসের জন্য অবশ্যই পারিবারিক সম্পর্ক জোর দিতে হবে।
টমাস আলভা এডিসনের গল্পটা দিয়ে আজকের নিবন্ধটা শেষ করতে চাই। টমাস আলভা এডিসনকে বলা হয় এ শতাব্দীর সেরা বিজ্ঞানী। তিনি এত বেশি আবিষ্কার করেছেন যে বিশ্বসভ্যতাকে একাই পরিবর্তন করে দিয়েছেন। আজকে সারাবিশ্ব আধুনিক যা কিছু ব্যবহার করছে, তার পিছনে টমাস আলভা এডিসনের কৃতিত্ব সিংহভাগ। তিনি যখন প্রাইমারীতে পড়তেন তখন তিনি খুবই বোকাসোকা ছাত্র ছিলেন। তখন টমাসের শ্রেণি শিক্ষক তাঁর মাকে একটা চিঠি লিখলেনÑ ‘মহোদয়া, আপনার সন্তানটি অতিশয় গর্দভ, তাকে আমাদের স্কুলে রাখলে স্কুলের বদনাম হবে। আপনি মেহেরবানি করে তাকে অন্য কোন স্কুলে ভর্তি করুন। টমাস আলভা শিক্ষকের দেয়া চিঠিটা নিয়ে তাঁর মাকে দিলে চিঠিটা পড়ে তিনি কান্না শুরু করলেন। টমাস জিজ্ঞাসা করলেন, মা তুমি কেন কান্না করছ? তখন তিনি বলেন, বাবা, তুমি এতই মেধাবী যে তোমার শিক্ষা দেওয়ার মতো ওই স্কুলে কোন শিক্ষক নেই। আমি দেখেছি আশেপাশে কোনো স্কুলেও এত ভালো শিক্ষক নেই। তাই ভাবছি আজ থেকে আমিই তোমাকে পড়াব। পরবর্তীতে টমাস আলভা এডিসন শতাব্দীর সেরা বিজ্ঞানী হয়েছেন। বহুবছর পর একদিন গ্রামে ফিরে পুরান আলমারিতে রাখা চিঠিগুলো খুলে পড়তে যেয়ে দেখেন ওই শিক্ষকের দেওয়া চিঠিটা, যেটাতে লেখা ছিলো টমাস আলভা এডিসন একটা অতিশয় গর্দভ ছাত্র। টমাস তাঁর শেষজীবনে আত্মজীবনীতে লিখেছেন, টমাস আলভা এডিসন একজন গর্দভ ছাত্র ছিলেন কিন্তু তাঁর মিথ্যাবাদী মা তাকে জগদ্বিখ্যাত বিজ্ঞানী বানিয়েছেন।
লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট