প্রত্যেক শিশু জন্মগ্রহণের পর একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত তার পিতা-মাতার কোলেই বেড়ে ওঠে। এ অর্থে শিশুর প্রথম স্কুল হলো তার পরিবার, যেটি বাবা-মায়ের কোল ঘিরেই প্রতিষ্ঠিত হয়ে থাকে। পরিবার নামক এ স্কুল থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে করতে প্রত্যেক বাবা-মাই তার সন্তানের সুন্দর ভবিশ্যত গড়তে পার্শ্ববর্তী কোন স্কুলে ভর্তি করে থাকেন। এ অর্থে স্কুল হলো শিশুদের সামগ্রিক কল্যাণ ও বিকাশের এক অনন্য বিদ্যাপীঠ। স্কুল শিশুদের বিকাশে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তাদের জ্ঞানীয়, সামাজিক ও মানসিক বৃদ্ধিকে সুসংগঠিত করে এবং তাদের সামগ্রিক সুস্থতার জন্য একটি পুষ্টিকর পরিবেশ প্রদান করে। একাডেমিক শিক্ষা থেকে শুরু করে সামাজিক দক্ষতা বৃদ্ধি ও শিশুর সামগ্রিক বিকাশে স্কুলের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। শিশুদের ভবিষ্যত বিনির্মাণ ও তাদের সামগ্রিক বিকাশে স্কুলের ভূমিকা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
শিশুর বিকাশ বলতে জন্ম থেকে বয়ঃসন্ধিকাল পর্যন্ত শিশুদের মধ্যে বৃদ্ধি ও পরিপক্কতার প্রক্রিয়াকে বোঝায়। যেহেতু শিশুরা বছরের পর বছর বড় হয় সেহেতু, এটি শারীরিক, জ্ঞানীয়, মানসিক এবং সামাজিক দিকসহ বিভিন্ন ডোমেনে ঘটে যাওয়া ক্রমবর্ধমান পরিবর্তনকে অন্তর্ভুক্ত করে। জেনেটিক্স, পরিবেশ এবং অভিজ্ঞতাÑ এ তিনটি ক্ষেত্র শিশুদের সক্ষমতা, দক্ষতা এবং আচরণ গঠনের জন্য একত্রে কাজ করে। শিশু তার শৈশবকালে যে পরিবেশ এবং অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে পারে, তাতে স্কুল এবং তাদের শিক্ষকমণ্ডলী একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। শিশু বিকাশের যে সকল ক্ষেত্রে স্কুলের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রয়েছে, সে বিষয়ে একটি সংক্ষিপ্ত আলোচনা নিম্নে পেশ করছি।
জ্ঞান এবং একাডেমিক উন্নয়ন : শিশুদের জ্ঞানীয় এবং একাডেমিক বিকাশে স্কুলের অবদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। স্কুলের প্রাথমিক লক্ষ্য হলো শিশুদের শিক্ষাগত যোগ্যতার প্রতি দৃষ্টি প্রদান করা। এক্ষেত্রে স্কুল একটি কাঠামোগত এবং সংগঠিত শিক্ষার পরিবেশের সাথে বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশকে উৎসাহিত করে, যেখানে শিশুরা জ্ঞান অর্জন করতে পারে, জ্ঞানীয় দক্ষতা বিকাশ করতে পারে এবং তাদের একাডেমিক কর্মক্ষমতা বাড়াতে পারে। শিক্ষকরা কার্যকর নির্দেশনা প্রদান করে শেখার অভিজ্ঞতা সহজতর করে এবং শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন চাহিদা মেটাতে স্বতন্ত্র সহায়তা প্রদান করে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকেন। বিশেষত, স্কুল একটি পরিপাটি পাঠ্যক্রম, সিলেবাস এবং মূল্যায়ন পদ্ধতি অফার করে, যা শিশুদের একাডেমিকভাবে উন্নতি করতে এবং ভবিষ্যতের শিক্ষাগত সাধনার জন্য প্রস্তুত করতে সহায়তা করে। বহুভাষিক বিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে, শিশুরা ছোটবেলা থেকেই একাধিক ভাষার সংস্পর্শে আসে, যা ভাষা অর্জন এবং দক্ষতাকে উন্নীত করে।
সামাজিক এবং মানসিক বিকাশ : স্কুল এমন একটি কাঠামোগত পরিবেশ প্রদান করে যেখানে শিশুরা সমবয়সীদের সাথে মিথস্ক্রিয়া করতে পারে এবং একে অন্যের সাথে তারা ভাবের আদান-প্রদান করতে পারে। স্কুল শিশুদের সামাজিক এবং মানসিক বিকাশের উপর একটি উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলে। সামাজিক দক্ষতা, পারস্পরিক সহানুভূতি এবং দলবদ্ধভাবে কাজ করার অভিজ্ঞতা তৈরি করে। এছাড়াও, গ্রুপ প্রজেক্ট, খেলাধুলা, শিল্পকলা, সঙ্গীত, নাটক এবং ক্লাবের মতো পাঠ্যক্রম বহির্ভূত ক্রিয়াকলাপগুলোর মাধ্যমে স্কুল শিশুদের মধ্যে আত্মসচেতনতা, একে অন্যের সহযোগিতা, নেতৃত্ব এবং আত্মপ্রকাশের গুণাবলি অর্জন করতে সাহায্য করে।
ব্যক্তিত্ব ও আত্মমর্যাদাবোধের সৃষ্টি : স্কুলগুলো বিভিন্ন কার্যকলাপের মাধ্যমে শিশুদের ব্যক্তিত্ব বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। স্কুল শিশুদের জন্য তাদের আগ্রহ, প্রতিভা এবং আবেগ অন্বেষণ করার সুযোগ করে দেয়, যা বিদ্যমান থাকতে পারে এমন অসংখ্য বহির্মুখী ক্রিয়াকলাপগুলির সাথে আত্ম-আবিষ্কার এবং ব্যক্তিগত বৃদ্ধির অনুভূতিকে উৎসাহিত করে। অধিকন্তু, শিক্ষক, সহকর্মী এবং বিভিন্ন সামাজিক পরিবেশের সাথে মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে স্কুল শিশুদের সামাজিক দক্ষতা, মূল্যবোধ এবং নৈতিকতা গঠন করে, যা তাদের চরিত্র, আচরণিক দক্ষতা এবং সহানুভূতিশীল ক্ষমতার বিকাশকে প্রভাবিত করে। শিশুদের উন্নত ব্যক্তিত্ব গঠন, তাদের আত্মবিশ্বাসী, দায়িত্বশীল এবং ভাল মানুষে পরিণত করতে স্কুলগুলির অনন্য ভূমিকা রয়েছে।
নৈতিক ও সাংস্কৃতিক উন্নতি : শিশুদের নৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিকাশে স্কুল একটি উল্লেখযোগ্য প্রভাব রয়েছে। তারা বিভিন্ন মূল্যবোধ, বিশ্বাস এবং দৃষ্টিভঙ্গি শেখার এবং বোঝার জন্য একটি প্ল্যাটফর্ম প্রদান করে। ক্রিয়াকলাপভিত্তিক শিক্ষার মাধ্যমে বিভিন্ন সংস্কৃতির সংস্পর্শে এনে এবং সহানুভূতিপূর্ণ অনুভূতি জাগিয়ে তুলে, স্কুল শিশুদের একটি শক্তিশালী নৈতিক কম্পাস, অন্যদের প্রতি শ্রদ্ধা এবং সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের জন্য উপলব্ধি গড়ে তুলতে সাহায্য করে। স্কুল শিশুদেরকে তাদের নিজস্ব সংস্কৃতির পাশাপাশি অন্যদের সংস্কৃতি সম্পর্কে শেখার সুযোগও করে দেয়। বিভিন্ন পটভূমির সহকর্মীদের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া করার মাধ্যমে শিশুরা একটি বিস্তৃত দৃষ্টিভঙ্গি অর্জন করে, আন্তঃসাংস্কৃতিক যোগাযোগের দক্ষতা বিকাশ করে এবং আরও খোলা মনের হয়ে বেড়ে ওঠে।
আধুনিক প্রযুক্তির সংস্পর্শ : চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের এ যুগে আধুনিক তথ্য-প্রযুক্তির ব্যবহার স্কুলের নিত্য-নৈমিত্তিক কার্যক্রমের অংশ। শিশুরা তাদের শৈশব শিক্ষার মাধ্যমে অল্প বয়স থেকেই উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার শিখতে পারে। রোবটিক্স, কোডিং, ইন্টারনেট ব্রাউজিং, গেমিং এবং অনলাইন শিক্ষার অধিকাংশ উপকরণের সাথে পরিচিতি লাভ করে। শৈশবকাল থেকে আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির সংস্পর্শ শিশুদের মাঝে একটি বিশেষ অনুপ্রেরণা সৃষ্টি করে এবং তাদের মধ্যে একটি উদ্ভাবনী শক্তির উদ্রেক হয়। ফলে তারা যেকোন প্রতিযোগিতায় অংশ গ্রহনের জন্য প্রস্তুতি গ্রহনের সাহস সঞ্চার করতে পারে। বর্তমানে বহুল আলোচিত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স) ব্যবহারের মাধ্যমে স্কুলগুলি শিশুদেরকে আধুনিক প্রযুক্তির প্রয়োগ সম্পর্কে নিশ্চিত জ্ঞানলাভ করতে সাহায্য করে।
সুতরাং এটি নিশ্চিত করে বলা যায় যে, স্কুল শিশুর সামগ্রিক বিকাশের একটি অন্যতম মাধ্যম। স্কুল সবসময় একটি পুষ্টিকর পরিবেশ প্রদান করে, জ্ঞান অর্জনকে উৎসাহিত করে, দক্ষতা বিকাশ করে এবং ব্যক্তিত্ব গঠনের অনুশীলন করে। পিতামাতার সমর্থন এবং স্কুলের প্রভাব শিশুদের সামগ্রিক বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে।
লেখক : প্রিন্সিপাল, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, ঢাকা