যত দিন বাঁচি ততদিন শিখি। কেউ শেখার জন্যই বাঁচেন। কেউ যতদিন বাঁচেন ততদিন শিখিয়ে যান। কিন্তু প্রতিটি মানুষের জীবন অন্যের কাছে শিক্ষা। প্রত্যেকটি জীবনই একটি উপন্যাস অথবা প্রচুর ছোটগল্পের সংকলন। জীবনে জীবন গড়াই উপন্যাস। তাতে লেখকের মনের মাধুরী এসে মেশে। এই মাধুরীই হল সাহিত্য। কিন্তু তার মূল উপাদান সেই মানুষ। আর মানুষটি হল তার ব্যর্থতা, মূর্খতা অহংকার, বিনয়, লাভ, ক্ষতি, লোভ, সংযম, মহত্ব ক্ষুদ্রত্ব সবকিছু নিয়ে।
আমি মনে করি, ঈশ্বরকে পাওয়ার জন্য যেমন সাধককে তপস্যা করতে হয়, তেমনি হাতের কাছে, ঘরের পাশে চলমান দৃশ্যমান মানুষের অন্তরদর্শনের জন্য সাধনা করতে হয়। বাইনাকুলার দিয়ে পাখিদেখা পক্ষীবিদদের হবি। আমার হবি মানুষ দেখা। জঞ্জাল কুড়ুনিদের কাছে সমস্ত ফেলে দেওয়া জঞ্জাল সম্পদ। আমার কাছে ব্যর্থ মানুষ, ভেঙে পড়া হতাশ মানুষ, পদভারে অহংকারী মানুষ, নীচ মানুষ, খল মানুষ, ষড়যন্ত্রী মানুষ, কামুক, লোভী, জটিল মানুষ; সৎ নিরহংকারী উদার, মহান মানুষের মতোই মূল্যমান। কারণ ঈশ্বরকে জানার আমার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। পশুর অরণ্যকে আমি জানতে চাই না। আমি জনারণ্যের মানুষদের হৃদয়স্পন্দন অনুভব করার জন্য কান পেতে রই।
কয়েক বছর আগে চেন্নাইয়ের ক্রোকোডাইল পার্কে গিয়ে একটি বন্ধ ঘরের সামনে ঢোকার মুখে একটি লেখা দেখে ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। সেখানে লেখাÑ ‘এখানে সবচেয়ে হিংস্র প্রাণীরা বাস করে।’ ভেজানো দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই চোখে পড়ল একটি আয়না। আর তাতে আমার নিজের মুখ ভেসে উঠল।
আমি সমস্ত মানুষের কাছে একটি অদৃশ্য ম্যাজিক আয়না নিয়ে ঘুরে বেড়াই। নিজেকে যেমন দেখি অন্যকেও তেমনি দেখি। আমার মায়া দর্পণ কিন্তু সব মানুষকে হিংস্র দেখায় না। শুধু দেখায় তাদের যাদের মধ্যে বিবর্তন হতে হতে থেমে গেছে। তাই অপরিমিত সম্পদ তার বিত্তবাসনা রোধ করতে পারেনি। প্রতিভা তাকে সংযমী করতে পারেনি। অপরিমেয় বিদ্যা তাকে বিনয়ী করতে পারেনি। কামনা তার মনে বাসনার লেলিহান শিখা জ্বালিয়েছে, ক্ষমতা তাকে মদমত্ত করে তুলেছে। সেই আদিম যুগ কিছু মানুষের অন্তরের গুহায় আজও গুহাবাসী।
তবু আমি শুধু দেব মানুষের সন্ধান না করে সেই আদিম মানুষের সন্ধান করি। কারণ তারা সবাই উত্তরাধিকার সূত্রে যে সব নৈতিক মূল্যবোধ নিয়ে জন্মেছে তাদের বদলাবার শিক্ষা তারা পায়নি। সমাজ তাদের ভালো পোশাক পরতে শিখিয়েছে। ভালো মন তৈরি করতে শেখায়নি। স্কুল কলেজ ভালো নম্বর পেতে শিখিয়েছে ভালো মানুষ হতে শেখায়নি। রাজনীতি শুধু নিতে শিখিয়েছে। কিছু দিতে শেখায়নি। আজ স্বাধীনতার এত বছর পরে আমরা নিঃসন্দেহে আরো শিক্ষিত আরো সমৃদ্ধ আরো ভূখণ্ডের বুকে দাঁড়িয়ে আছি। কিন্তু সেই সঙ্গে নৈতিকভাবে ভেঙে পড়া, শূন্যতার হাহাকার আমাদের সমস্ত উন্নয়নকে বার বার আচ্ছন্নকরে তুলেছে। আমাদের প্রত্যাশা বেড়েছে কিন্তু পুরণের জন্য অন্তরের শক্তি বাড়েনি। আমাদের মন পড়ে আছে সেই গুহায়।
মানুষকে দেবতা করার জন্য কত পরিকল্পনা হল। কত মন্দির ভাঙা হল, মসজিদও ভাঙা হল। কত কলকারখানা, বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি হল। কিন্তু মানুষ দেবতা হওয়া দূরে থাক মানুষই হল না। কারণ মানুষ হবার রোলমডেলই এখন নেই। মহাপুরুষের সংখ্যা কম পড়েনি, কম পড়েছে মনুষ্যত্ব। এটি স্কুলে শেখানো যায় না। সমাজের প্রতিটি মানুষ একে অপরের কাছ থেকে শেখে। দেশে অসংখ্য ভালো মানুষ আজও আছে। কিন্তু তারা শাপলা ফুলের মতো ফুটে নেই। গভীর সমুদ্রে মুক্তোর মতো ডুবে আছে। তাদের তুলে এনে সুন্দরীর কণ্ঠলগ্ন করা যেতে পারে কিন্তু দেশ চায় শুধু মানুষ। যে মানুষ ওই ম্যাজিক আয়নায় নিজেকে দেখে নিজেই নিজেকে বদলাবার কথা ভেবেছে।
লেখক : সমাজকর্মী ও বিশ্লেষক