মরিচের দাম বেড়েছে, বেড়েছে পেঁয়াজের দাম। টমেটো আকাশ ছোঁয়া। অথচ এই বিলাসী আমরা ড্রাগন ফল চাষ করছি বিঘা বিঘা। চাষ করছি টগর আর ঝাউ-৮০ টাকা দাম ছোট একটা লাউ। আমরা কি বুঝতেই পারি না, এই সীমিত ভূমির বিপুল জনসংখ্যার দেশে কোন ফসল আমাদের জন্য জরুরি, কোনটা অগ্রাধিকার?
আমরা বিঘায় বিঘায় জমিতে ড্রাগন ফলের চাষ করছি। আমরা বিঘায় বিঘায় জমি অনাবাদি পতিত ফেলে রাখছি। কাঁচামরিচ, গাজর, টমেটো, পেঁয়াজসহ বেশ কিছু মসলা ও সবজি জাতীয় ফসল সারাবছর চীন আর ভারত থেকে ডলার দিয়ে কিনে এনে প্রয়োজনীয় ও বিলাসী চাহিদা মেটাই। ক্যাকটাস জাতীয়, ১.৫ থেকে ২.৫ মিটার লম্বা পাতাবিহীন ড্রাগনের আমাদের দেশেও ব্যাপক জনপ্রিয়তা আছে। উচ্চ পুষ্টিগুণ সেই সাথে উচ্চ মূল্যের এই বিলাসী বিদেশি ফল আপনি শেষ কবে খেয়েছেন? একদিকে আমরা চাষ করছি ফুল ও সুদৃশ্য গাছের, অপরদিকে চাষ করছি আক্ষেপের, এই ভেবে যে, কেনো চালের দাম বাড়ছে, কেনো সবজির দাম বাড়ছে হা হুতাশ করছি।
বাংলাদেশের ভূমিরূপ, মৃত্তিকা, পানি ও কৃষি জলবায়ুগত বৈশিষ্ট্য অনুসারে যে ৩০টি অঞ্চলে ভাগ করা কৃষি পরিবেশ অঞ্চলের মাটিতে একটা আম খেয়ে বীজ আঁটি যত্রতত্র ফেলে রাখলেও অঙ্কুরোদগম হয়। অযত্নে অবহেলায় বেড়ে ওঠা গাছগুলো একটা সময় ফল দেয়। এমন উর্বর মাটি, আবহাওয়া- জলবায়ু আর কয়টা দেশে আছে বলুন তো? অপরিকল্পিতভাবে হাজার হাজার বিঘায় ড্রাগন ও মাল্টা চাষ দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করায় কতটা গুরুত্ব বহন করবে আর পরিকল্পিত দানা জাতীয় ফসল চাষ দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করায় কতটা গুরুত্ব বহন করবে তা ভাবার সময় এসেছে।
পৃথিবীর সবচেয়ে পুরনো বিজ্ঞান এই কৃষিকে শখের বিলাসিতা করে ফেলছি আমরা। শখের ছাদ বাগান করি বিলাসিতার বসে, শুধুই ফুল ও সুদৃশ্য গাছের। এমন কিছু গাছ যেগুলোতে ফুল নেই, ফল নেই, ডাল নেই, লতা নেই। বিশ্বের অন্যান্য দেশ থেকে আধুনিক কৃষি প্রযুক্তিতে পিছিয়ে থাকা বাংলাদেশে এমন ফসলের চারা রোপণ করুন, এমন ফসলের বীজ বপন করুন, যাতে আপনার চাহিদা আছে, দেশের অর্থনীতিতে কাজে আসবে, দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করার পেছনে আপনার ভূমিকা থাকবে।
খাদ্যদ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধির সাথে সাথেই সরকারকে দোষারোপ বন্ধ করে ভেবে দেখুন আপনি কয়টা আলু, বেগুন, টমেটো, মরিচ বা পেঁয়াজ গাছ রোপণ করেছেন? কতটুকু জমিতে চাষ করেছেন, কতটুকু জমি অনাবাদি ফেলে রেখেছেন? নিজের অলসতার ভারে ফেলে রাখা আপনার পতিত জমিতে দানা বপন করেছেন কয়টি, হোক মাঠ ফসল কিংবা উদ্যান ফসল?
কৃষিনির্ভর বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকে চতুর্থ বিষয়ে পঠিত কৃষি বিজ্ঞান বই বাধ্যতামূলক করা হোক। কৃষি বিভাগই দেশকে জীবন্ত রেখেছে। সরকারের সহযোগিতার হাত উন্মুক্ত। বীজ-সারের কোনো সংকট নেই। বাড়ির আঙ্গিনা সহ চারপাশে পতিত সকল জমিতে শাকসবজি চাষে প্রতি বাড়ির ন্যূনতম একজন সদস্যকে প্রশিক্ষণ এর ব্যবস্থা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উদ্যোগে নেয়া হোক। প্রথমে দানাজাতীয়, এরপর শাক-সবজি, মসলা জাতীয় বা উদ্যান জাতীয় ফসলকে গুরুত্ব দিয়ে অন্যান্য ফসল উৎপাদন কৌশল প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা করা হোক।
আপনার বাড়ির পতিত জমিতে নিজ উদ্যোগে সবজি চাষ করুন। এতে পাবেন ভেজালহীন খাদ্য। ভেজালহীন খাদ্য গ্রহণের মাধ্যমে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়বে। শাকসবজি চাষ সংক্রান্ত কৃষি কাজে যে তৃপ্তি পাবেন তা দিবে মানসিক প্রশান্তি।পতিত সকল কৃষিজমিতে মাঠ ফসল, উদ্যান ফসল, তেলজাতীয় ফসল, মসলাজাতীয় ফসল, বছরব্যাপী সূর্য উৎপাদন সম্পর্কে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করা হোক, এই বিষয়ে টেলিভিশন পত্রিকা সহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পরামর্শ প্রদান করা হোক। কৃষিতে পর্যাপ্ত জনবল নিয়োগ দেয়া হোক। কোথাও জমি ফাঁকা না থাকুক। কৃষিতে এবং খাদ্যশস্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হোক বাংলাদেশ। চমৎকার আবহাওয়া, জলবায়ু ও মাটির সমন্বয়ে আমাদের দেশের কৃষির যে ব্যাপক সম্ভাবনা তাকে যথাযথভাবে কাজে লাগিয়ে যুবকদের কৃষি কাজে এগিয়ে নেয়ার সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালানো হোক।
আমাদের দেশ থেকে কৃষি ও কৃষিজাত পণ্য রফতানির বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। শুধু গার্মেন্টস মুখী রপ্তানিতে সন্তুষ্টি না রেখে কিভাবে কৃষি মুখী রপ্তানিতে সন্তুষ্টি অর্জন করা যায় গুরুত্ব দিয়ে ভাবতে হবে। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুারোর (ইপিবি) তথ্যানুযায়ী, ১০ বছর আগেও কৃষিপণ্যের রপ্তানি আয় ছিল মাত্র ৪০ কোটি ডলার। চার বছর ধরে খাতটির রপ্তানি আয় বাড়ছে। অবশ্য করোনার কারণে গত ২০১৯-২০ অর্থবছরে এ খাতের রপ্তানি ৫ শতাংশ কমেছিল। সর্বশেষ ২০২০-২১ অর্থবছরে খাতটির রপ্তানি আয় ১৯ শতাংশ বেড়েছে।
কৃষি তথ্য সার্ভিস এর তথ্যমতে, কৃষি ও কৃষিজাত পণ্য আমদানির তুলনায় রফতানির চিত্র হতাশাজনক। কাজেই রফতানির বাজার সম্প্রসারণের লক্ষ্যে কাজ করার জন্য দরকার প্রশিক্ষিত জনবল যারা আন্তর্জাতিক নিয়মনীতি মেনে পণ্য রফতানি করবেন। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী দেশ হিসেবে Sanitary and Phytosanitary Agreement (SPS Agreement) অনুযায়ী (IPPC) এখন পর্যন্ত যে ৪১টি Standard নির্ধারণ করেছে তা প্রতিপালন করে রফতানির জন্য সুস্পষ্ট গাইডলাইন অনুসরণ করে উদ্ভিজাত পণ্য রফতানি করতে হবে। কিন্তু তা না জানার জন্য আমরা অনেক পণ্য বিদেশে রফতানি করতে পাচ্ছি না। খাদ্যসংকট মোকাবিলায়, দেশের সাধারণ মানুষের চাহিদার সাথে মিল রেখে ফসল উৎপাদন করে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন ছাড়া বিকল্প নেই।
লেখক : প্রভাষক, সফিপুর আইডিয়াল পাবলিক কলেজ, গাজীপুর