বাংলাদেশ থেকেই হত্যার পরিকল্পনা করা হয় এমপি আনোয়ারুল আজিম আনারের। খুনিরাও একই সময়ে ভারতে গেলেও তারা একসঙ্গে যাননি। কিলিং মিশনের প্রধান মোকাররম এমপি আজিমের পরিচিত। অন্যদিকে হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী জনৈক আক্তারুজ্জামান ওরফে শাহীনও ঘটনার সময় ভারতে ছিলেন। এরপর পরই তিনি দেশে ফেরেন এবং দুবাই হয়ে যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান। হত্যাকাণ্ডের সময় সঞ্জিবা অ্যাপার্টমেন্টের ঐ ফ্ল্যাটে ছয় জন ছিলেন। এর মধ্যে তিন জন বাংলাদেশি বলে নিশ্চিত হয়েছে। মোকাররম, সিনথিয়া ও মারুফ নামে তিন জনকে আটক করেছে বাংলাদেশের পুলিশ। এর মধ্যে মোকাররম পুরো হত্যাকাণ্ডের ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন গোয়েন্দা পুলিশের কাছে।
কমপক্ষে এক মাস আগে ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীমকে (আনার) খুনের পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি শুরু হয়। এতে জড়িত অন্তত তিনজন ঘটনার ১৩ দিন আগে বাংলাদেশ থেকে ভারতের কলকাতায় যান। তারও আগে যান দুজন। আনোয়ারুলকে হত্যার জন্যই সেখানে একটি ফ্ল্যাট ভাড়া করা হয়।
খুনিদের ভাড়া করা ফ্ল্যাটে ১৩ মে রাতে খুন করা হয় আনোয়ারুলকে। তদন্ত-সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, স্বর্ণ চোরাচালানের আন্তর্দেশীয় চক্রের দ্বন্দ্বের জেরে পরিকল্পিতভাবে আনোয়ারুলকে ভারতে নিয়ে হত্যা করা হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। এর মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে আক্তারুজ্জামান ওরফে শাহিন নামের এক ব্যক্তিকে চিহ্নিত করা হয়েছে।
যেভাবে এই হত্যাকাণ্ড : গত ১২ মে ভারতে গিয়ে সন্ধ্যা ৭টার দিকে আজিম তার পূর্বপরিচিত বন্ধুসম্পর্কীয় গোপাল বিশ্বাসের বাসায় ওঠেন। পরদিন ১৩ মে বেলা ২টার দিকে তিনি চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার কথা বলে গোপাল বিশ্বাসের বাসা থেকে বের হন। এর মধ্যে আজিমের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করেন সিনথিয়া ও মোকাররম। তাদের সঙ্গেই তিনি সঞ্জিবা অ্যাপার্টমেন্টের ঐ ফ্ল্যাটে যান। সিসিটিভির ফুটেজে দেখা গেছে, আজিমের সঙ্গে তিন জন ভেতরে যাচ্ছেন। এদের এক জন নারী। অন্য দুই জন পুরুষ। ধারণা করা হচ্ছে, এই তিন জন হলেন—মোকাররম, সিনথিয়া ও মারুফ। তবে খুনের সময় ছিলেন ছয় জন। অন্য তিন জনের ব্যাপারে এখনো বিস্তারিত জানতে পারেনি পুলিশ। এদের দুই জন ভারতীয় নাগরিক বলে পুলিশের ধারণা।
ঐ ফ্ল্যাটে আজিমকে হত্যার পর লাশ তিন টুকরো করা হয়। তিনটি ব্যাগে ভরে তিন জনকে ব্যাগগুলো ফেলে দেওয়ার দায়িত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু ব্যাগগুলো তারা কোথায় ফেলেছে, সে ব্যাপারে মোকাররম কিছু বলতে পারেনি। সিসিটিভির ফুটেজ বলছে, ১৩ মে তারা ফ্ল্যাটে ঢুকলেও ঐ দিন কেউ বের হননি। পরে এক জন ১৫ মে, এক জন ১৬ মে, এক জন ১৭ মে বের হন। কিন্তু আজিমকে আর বের হতে দেখা যায়নি। পশ্চিমবঙ্গ সিআইডি ঐ ফ্ল্যাটে রক্তের দাগ পেলেও ফ্ল্যাটের মধ্যে লাশের সন্ধান পাওয়া যায়নি। এখন লাশের সন্ধানে অভিযান চলছে।
গোয়েন্দারা বলছেন, মোকাররম দক্ষিণ ও দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের অন্যতম বড় স্বর্ণ চোরাকারবারি। মারুফ এক সময় ভারতের বাসিন্দা ছিলেন। পরে বাংলাদেশের চুয়াডাঙ্গায় মাইগ্রেট হয়ে চলে আসেন। তিনি স্বর্ণ চোরাকারবারে জড়িত। এরা দুই জনই আজিমের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ।
শাহীনের সঙ্গে আজিমের কেন বিরোধ : মোকাররম গোয়েন্দাদের কাছে স্বীকার করেছেন, শাহীনের সঙ্গে আজিমের বিরোধ দীর্ঘদিনের। আজিমের চিনির ব্যবসা আছে। এছাড়াও তারা দুই জন আরও কিছু ব্যবসায় জড়িত। সেই ব্যবসার ৪ কোটি টাকা আজিম পাবেন শাহীনের কাছে। কেউ বলছেন, এটা হুন্ডির টাকা, আবার কেউ বলছেন, এটা স্বর্ণ চোরাকারবারির টাকা। মোকাররমও নিশ্চিত নন, এই টাকা আসলে কীসের। তবে ৪ কোটি টাকা বিরোধের বিষয়টি তিনি নিশ্চিত। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে শাহীন টাকা দিচ্ছেন না। নির্বাচনের আগে গত অক্টোবরে এ নিয়ে মীমাংসা বৈঠক হয়। বৈঠকে মীমাংসাও হয়। কিন্তু ভেতরে ভেতরে তাদের দ্বন্দ্ব থেকে যায়। কয়েক দিন আগে একে অপরকে হুমকি দিয়েছে। সেখানে শাহীন বলেছে, ‘আমি টাকা দেব না’, আর আজিম বলেছে, ‘কীভাবে টাকা আদায় করতে হয় আমি জানি।’ এরপর বিরোধ আরো বাড়ে।
এরপর শাহীন এমপি আজিমকে হত্যার পরিকল্পনা করেন। তার এই পরিকল্পনায় যোগ দেন মোকাররম ও মারুফ। সিনথিয়াকে ব্যবহার করে কিলিং মিশন সম্পন্ন করেন তারা। হত্যাকাণ্ডের সময় শাহীনও ভারতে ছিলেন। দুই দিন পরই তিনি দেশে ফিরে আসেন। এর এক দিন পরই দুবাই হয়ে যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান শাহীন। বর্তমানে তিনি সেখানেই আছেন। কলকাতার নিউ টাউনে যে ফ্ল্যাটে সংসদ সদস্যকে হত্যা করা হয়েছে, সেটি এই আক্তারুজ্জামানের ভাড়া করা। তিনি ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুর পৌরসভার মেয়র মো. সহিদুজ্জামানের ছোট ভাই।
কলকাতার পুলিশের একটি সূত্র জানায়, নিউ টাউনের ওই ফ্ল্যাট (ট্রিপলেক্স) নাজিয়া বানু নামের এক নারীর কাছ থেকে ভাড়া নিয়েছিলেন মো. আক্তারুজ্জামান। নাজিয়ার স্বামী সন্দ্বীপ রায় ওই ফ্ল্যাটের প্রকৃত মালিক। তিনি পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের আবগারি দপ্তরের কর্মকর্তা। গত ২৫ এপ্রিল ফ্ল্যাট ভাড়ার চুক্তিপত্র সইয়ের পর ৩০ এপ্রিল আক্তারুজ্জামানকে ফ্ল্যাটটি বুঝিয়ে দেওয়া হয়। এ তথ্য নাজিয়া কলকাতার নিউ টাউন থানা পুলিশকে দিয়েছে।
আক্তারুজ্জামানকে গ্রেপ্তারের জন্য পুলিশ খুঁজছে। তবে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানিয়েছে, তিনি গত সোমবার ঢাকা থেকে একটি ফ্লাইটে দিল্লি হয়ে কাঠমান্ডু চলে গেছেন। এ ঘটনার তদন্তে নেমে বাংলাদেশ ও কলকাতার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এমন তথ্য পেয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) ইতিমধ্যে তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছে; যাঁরা ঘটনার পর ভারত থেকে দেশে ফিরেছিলেন। ঢাকায় ডিবির সূত্র জানায়, গ্রেপ্তার তিনজন প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করছেন যে তাঁরা সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীমকে হত্যায় সরাসরি জড়িত।
পুলিশ জানতে পারে, আক্তারুজ্জামান ও আনোয়ারুল আজীম পুরানো বন্ধু। আক্তারুজ্জামানের গ্রামের বাড়ি ঝিনাইদহে। ঢাকায় গুলশানে আক্তারুজ্জামানের বাসা রয়েছে। তাঁর যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব রয়েছে। নিউইয়র্কের ব্রুকলিনে তাঁর বাসা। হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত কলকাতার ওই ফ্ল্যাট ভাড়া নেওয়ার সময় আক্তারুজ্জামান যুক্তরাষ্ট্রের পাসপোর্ট ব্যবহার করেছিলেন; যা ভাড়ার চুক্তিপত্রেও উল্লেখ আছে।
গোয়েন্দা সূত্রগুলো বলছে, ১২ মে কলকাতায় যাওয়ার পর আনোয়ারুলকে কৌশলে ওই ভাড়া করা ফ্ল্যাটে নেওয়া হয়। ওই দিনই সেখানে আনোয়ারুলকে হত্যা করা হয়। পরে লাশ কয়েক টুকরা করে ব্যাগে ভরে সরানো হয়।
তদন্ত-সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, আনোয়ারুলকে খুনের পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও স্বজনদের বিভ্রান্ত করতে নানা কৌশল অবলম্বন করেন খুনিরা। তাঁরা আনোয়ারুলের মুঠোফোন নম্বর থেকে একেক সময় একেক ধরনের তথ্য দিতে থাকেন। এমনকি মুঠোফোন নেটওয়ার্কের অবস্থানও পরিবর্তন করতে থাকেন।
আনোয়ারুল ১৩ মে রাতে খুন হন। অথচ সেই রাতে তাঁর হোয়াটসঅ্যাপ নম্বর থেকে বন্ধু গোপাল বিশ্বাসকে বার্তা পাঠিয়ে জানানো হয়, বিশেষ কাজে তিনি দিল্লি যাচ্ছেন। সেখানে পৌঁছে তিনি ফোন করে গোপাল বিশ্বাসকে জানাবেন, গোপাল বিশ্বাসের ফোন করার দরকার নেই।
এরপর ১৫ মে স্থানীয় সময় বেলা ১১টা ২১ মিনিটে আনোয়ারুল আজীমের নম্বর থেকে হোয়াটসঅ্যাপে আরেকটি বার্তা আসে। তাতে আনোয়ারুল আজীমের দিল্লি পৌঁছানোর কথা জানিয়ে বলা হয়, আমার সঙ্গে ভিআইপিরা আছেন, ফোন করার দরকার নেই।