জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম জীবনের শেষদিন পর্যন্ত যে কেবিনে চিকিৎসাধীন ছিলেন বিদ্রোহী কবির স্মৃতিধন্য সেই ঐতিহাসিক ১১৭ নম্বর কেবিন সংরক্ষণের যে উদ্যোগ গ্রহণ করেছি তা আগামী দিনে নতুন প্রজন্মের জন্য আমাদের জাতীয় কবিকে জানতে ও জাতীয় কবির স্মৃতি সংরক্ষণে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। আজ ১১ জ্যৈষ্ঠ, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অন্যতম প্রাণপুরুষ, আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্মদিন। বাঙালির আবেগ, অনুভূতিতে জড়িয়ে থাকা চিরবিদ্রোহী এ কবির ১২৪তম জন্মজয়ন্তী আজ। কবি বেঁচেছিলেন ৭৭ বছর। জন্মের পর থেকে মাত্র ৪৩ বছর বয়স পর্যন্ত স্বাভাবিক জীবন কাটিয়েছেন। এর মধ্যে সাহিত্য রচনার কাল ছিলো মাত্র ২৪ বছর। তারপরও বাঙালির জীবনে নজরুলের দিগন্ত বিস্তারি প্রভাব। মানবতাবাদী কবি নজরুল একুশ শতকে এসে হয়ে উঠেছেন মনুষ্যত্বের কবি। যখন দেশে দেশে সাম্প্রদায়িকতা, জঙ্গিবাদ, ধর্মীয় কুসংস্কার বাড়ছে তখন তার বিপরীতে অসাম্প্রদায়িক ও মানবতার কবি নজরুল চর্চার বিকল্প নেই।
কাজী নজরুল ইসলাম ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বাবার নাম কাজী ফকির আহমেদ, মা জাহেদা খাতুন। দরিদ্র পরিবারে জন্মের পর দুঃখ-দারিদ্র্য ছিল তাঁর নিত্যসঙ্গী। তার ডাকনাম ছিলো দুখু মিয়া। বাবার অকালমৃত্যুতে পরিবারের ভরণ-পোষণের জন্য তিনি শিশুবয়সেই মক্তবে শিক্ষকতা, হাজি পালোয়ানের মাজারে খাদেম, মসজিদে মুয়াজ্জিনের কাজ করেন। তবে নিজের দুঃখ নিয়ে নয়, তিনি জাতির দুঃখ-ক্লেশ, দৈন্য-লজ্জা ঘোচানোর জন্য ভাবতেন সব সময়।
কাজী নজরুল ইসলাম বিশ শতকের বিশ ও ত্রিশের দশকে উপমহাদেশের অবিভক্ত বাংলার সাংস্কৃতিক জগতে সবচেয়ে বর্ণাঢ্য ব্যক্তিত্ব। তিনিই রবীন্দ্র-উত্তর বাংলা সাহিত্যে আধুনিকতার পথিকৃৎ। নজরুল তার কবিতা, গান ও উপন্যাসে পরাধীন ভারতে বিশেষ করে অবিভক্ত বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতা, সামন্তবাদ, সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম কবি, ঔপন্যাসিক, নাট্যকর, সাংবাদিক ও সঙ্গীতজ্ঞ হিসেবে অনন্য অবদানে বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি সমৃদ্ধ করেছেন তিনি। মাত্র ২৩ বছর বয়সে রচনা েেকছন অমর কবিতা ‘বিদ্রোহী’, যেখানে নিজেকে প্রকাশ করেছিলেন, ‘আমি চির বিদ্রোহী বীর-আমি বিশ্ব ছাড়ায়ে উঠিয়াছি একা চির-উন্নত শির’। অত্যাচারী ও উৎপীড়কের বিরুদ্ধে, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন বিদ্রোহী। একইসঙ্গে কৃষক-শ্রমিক, মেহনতী মানুষের কল্যাণ ও মঙ্গলে নিবেদিত। বাংলাদেশের মহান মুক্তিসংগ্রামে তিনি ছিলেন প্রেরণা। মুক্তিযোদ্ধারা মহান এ কবির ‘জয় বাংলা’ ধ্বনিতে আকাশ বাতাস মুখরিত করে নির্ভয়ে এগিয়ে যেতো রণাঙ্গণে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে পরাজিত করে বিজয় কেতন ওড়াতে, কন্ঠে তাঁদের প্রেরণাদায়ী গান-চল চল চল…। তাঁর জন্মদিনটিকেই বেছে নেওয়া হয়েছিলো স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের আনুষ্ঠানিক সূচনার দিন হিসেবে। ১৯৪২ সালে জাতীয় কবির নিউরো ডিসঅর্ডার জনিত জটিল ব্যাধি ধরা পড়ে। এ ভয়ংকর রোগের কারণে ৩৪ বছরের বেশি সাহিত্য ও সঙ্গীতজগৎ কর্ম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লেও ধূমকেতু, ভাঙার গান ও অগ্নিবীণার স্রষ্টা এ মহান কবির সাম্য-সম্প্রীতি-মানবতার বাণী আমাদের চিরকালের প্রেরণা।
১৯৭৫ সালের ২২ জুলাই চিকিৎসকদের পরামর্শে বঙ্গবন্ধু ‘কবিভবন’ থেকে কবিকে আমাদের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (তৎকালীন আই পিজি এম আর)-এর ১১৭ নম্বর কেবিনে স্থানান্তর করেন। ১ বছর ১ মাস ৮ দিন এ কেবিনে চিকিৎসক ও নার্সদের নিবিড় যত্ন ও সেবা দেওয়া হয় মানবতার এর কবিকে। বিভিন্ন সময়ে কবির চিকিৎসায় যুক্ত ছিলেন স্বাস্থ্য বিভাগের তৎকালীন মহাপরিচালক ডা. মেজর এ চৌধুরী, পরবর্তী সময়ে জাতীয় অধ্যাপক ডা. নুরুল ইসলাম, ডা. নাজিমুদ্দৌলা, ডা. আশিকুর রহমান খান প্রমুখ। বঙ্গবন্ধুর অনুমতি নিয়ে হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা দেন ডা. বায়েজিদ খান। কবির সার্বক্ষণিক সেবা প্রদানে যুক্ত ছিলেন সেবিকা শামসুন্নাহার ও সেবক ওয়াহিদুল্লঅহ ভুঁইয়া। এই ১১৭ নম্বর কেবিনেই বাঙালির পরম প্রিয় কবির জীবনাবসান ঘটে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদের পাশে শান্ত, সবুজ পরিবেশে সমাহিত করা হয়েছে তাঁকে। সব সুর থেমে যায়, কিন্তু আজও মধুর বাঁশুরী বাজে। তিনি আছেন আমাদের চেতনায়, অন্তরের অন্তঃস্থলে এবং থাকবেনও চিরকাল। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বাংলাদেশ ও বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রবাদপুরুষ। শোষিতের পক্ষে আর শোষকদের বিরুদ্ধে আজন্ম বিদ্রোহী কবি জীবন-সায়াহ্নে এসে এই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। অমর কবির মৃত্যু নেই, কোটি বাঙালির কন্ঠে তিনি চিরকাল বেঁচে থাকবেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়-এর ১১৭ নম্বর কেবিনটি বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের শেষ বিদায়ের স্মৃতিধন্য, বাঙালির স্মরণীয় জায়গা।
শোষিত-বঞ্চিত-নিপীড়িত জনতার কবি, অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী, বিশ্বমানবতার কবি বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম-এর স্মৃতিধন্য কক্ষ ভাইস চ্যান্সেলর হিসেবে আমি ১২ ভাদ্র ১৪২৮ বঙ্গাব্দ, ২৭ আগস্ট ২০২১ইং তারিখে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান বি ব্লকের দ্বিতীয় তলায় ১১৭ নম্বর কেবিনে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম স্মৃতিকক্ষ-এর শুভ উদ্বোধন করি। ঐতিহাসিক এই উদ্বোধন শেষে অত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ ডা. মিল্টন হলে এক মহতী আলোচনার আয়োজন করা হয়। এই মহতী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সে সময়ের সংস্কৃতি বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ এমপি। উদ্বোধক হিসেবে স্মৃতিচারণমূলক মূল্যবান বক্তব্য রাখেন জাতীয় অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম। আলোচক হিসেবে অংশ নেন বাংলা একাডেমির সম্মানিত মহাপরিচালক কবি নুরুল হুদা, নাট্যজন রামেন্দু মজুমদার, সম্মিলিত সাংস্কৃতি জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুস, কলামিস্ট সাংবাদিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও গবেষক সুভাষ সিংহ রায়, নজরুল সঙ্গীত শিল্পী সাদিয়া আফরিন মল্লিক, নজরুল সঙ্গীত শিল্পী খায়রুল আনাম শাকিল এবং আবৃত্তি করেন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব জয়ন্ত চট্টপাধ্যায়। উক্ত এই মহতী অনুষ্ঠানে ভাইস চ্যান্সেলর হিসেবে সভাপতিত্ব করেছিলাম আমি।
সঙ্কট মোচনে, অন্যায় ও অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে চিরকাল প্রেরণা দিবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম এর আদর্শ। বর্তমান সময়েও যেকোনো অশুভ তৎপরতার বিষয়ে আমাদেরকে সতর্ক থেকে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও জাতীয় কবির আদর্শকে ধারণ করে কাজ করে যেতে হবে।
লেখক : সাবেক উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়