আমেরিকান সমাজবিজ্ঞানী চার্লস হোর্টন কুলি ১৯০২ সালে প্রকাশিত তাঁর ‘Human Nature and the Social Order’ গ্রন্থে ‘লুকিং গ্লাস সেল্ফ’ তত্ত্ব প্রদান করেন। এই তত্ত্ব অনুসারে, আমরা অন্যদের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে নিজেদের সম্পর্কে ধারণা গঠন করি। আমরা নিজেদেরকে এমনভাবে দেখি যেমন অন্যরা আমাদের দেখে বলে মনে করি। এই তত্ত্ব সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের উপর গভীর প্রভাব ফেলেছে, কারণ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম আমাদের অন্যদের সাথে যোগাযোগ করার এবং তাদের প্রতিক্রিয়া পাবার একটি নতুন মাধ্যম সরবরাহ করে।
সমাজবিজ্ঞানী কুলি’র ‘লুকিং গ্লাস সেল্ফ তত্ত্বে’র মূল ধারণা হলো, আমাদের নিজ সম্পর্কে ধারণা তৈরি হয় তিনটি ধাপে : প্রথমত, আমরা অন্যদের দ্বারা আমাদের প্রতিফলন অনুধাবন করি। আমরা অন্যদের আচরণ, মন্তব্য এবং প্রতিক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করি এবং ধারণা করি তারা আমাদের সম্পর্কে কী ভাবছে।
দ্বিতীয়ত, আমরা এই প্রতিফলনগুলোকে আমাদের নিজস্ব ধারণার সাথে তুলনা করি। আমরা অন্যদের ধারণাগুলোকে আমাদের নিজস্ব মূল্যবোধ, বিশ্বাস এবং আত্মসম্মানের সাথে মিলিয়ে দেখি।
তৃতীয়ত, আমরা এই তুলনার উপর ভিত্তি করে আমাদেও নিজ সম্পর্কে ধারণা গঠন করি। আমরা অন্যদের কাছে কেমন দেখাচ্ছি তার উপর ভিত্তি করে আমরা নিজেদের সম্পর্কে ইতিবাচক বা নেতিবাচক ধারণা গড়ে তুলি।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম হলো এমন অনলাইন প্ল্যাটফর্ম এবং অ্যাপ্লিকেশন যা ব্যবহারকারীদের একে অপরের সাথে সংযোগ স্থাপন, যোগাযোগ, তথ্য ভাগাভাগি এবং ধারণা বিনিময় করতে সাহায্য করে।
এই মাধ্যমগুলোর বিভিন্ন ফর্ম রয়েছে যেমন, সামাজিক নেটওয়ার্কিং সাইট- ফেসবুক, টুইটার, ইনস্টাগ্রাম এবং লিঙ্কএডইন, যেখানে ব্যবহারকারীরা প্রোফাইল তৈরি করতে পারে, বন্ধু এবং অনুসারীদের সাথে সংযোগ স্থাপন করতে পারে, পোস্ট শেয়ার করতে পারে এবং একে অপরের সাথে যোগাযোগ করতে পারে।
মেসেজিং অ্যাপ্লিকেশন যেমন হোয়াটসঅ্যাপ, মেসেঞ্জার ও ভাইবার, যেখানে ব্যবহারকারীরা পাঠ্যবার্তা, ভয়েস কল এবং ভিডিও কলের মাধ্যমে ব্যক্তিগতভাবে বা গোষ্ঠীগতভাবে যোগাযোগ করতে পারে। ফোরাম এবং ব্লগ যেখানে ব্যবহারকারীরা নির্দিষ্ট বিষয়গুলি নিয়ে আলোচনা করতে, প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করতে এবং উত্তর দিতে পারে।
ভিডিও শেয়ারিং প্ল্যাটফর্ম যেমন YouTube, যেখানে ব্যবহারকারীরা ভিডিও আপলোড করতে, দেখতে এবং শেয়ার করতে পারে। ব্লগিং প্ল্যাটফর্ম যেমন WordPress ও Blogger, যেখানে ব্যবহারকারীরা নিজস্ব ওয়েবসাইট তৈরি করতে এবং তাদের চিন্তাভাবনা, অনুভূতি এবং অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে পারে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বন্ধু, পরিবার এবং সহকর্মীদের সাথে সংযোগ স্থাপন এবং বজায় রাখার একটি সহজ উপায়। এটি নতুন লোকেদের সাথে দেখা করতে এবং একই আগ্রহ ভাগ করে নেওয়া লোকেদের সাথে সম্প্রদায় তৈরি করতেও ব্যবহার করা যেতে পারে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সংবাদ, তথ্য এবং ধারণা দ্রুত এবং সহজেই শেয়ার করার একটি দুর্দান্ত উপায়। এটি শিক্ষাগত উদ্দেশ্যে এবং সচেতনতা বৃদ্ধির জন্যও ব্যবহার করা যেতে পারে। ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের পণ্য এবং পরিষেবা প্রচার করতে, গ্রাহকদের সাথে সংযোগ স্থাপন করতে এবং বিক্রয় বাড়াতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করতে পারে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম গেম খেলা, ভিডিও দেখা, সঙ্গীত শোনা এবং অন্যান্য বিনোদনমূলক কার্যকলাপের জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে।
তবে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারের কিছু সম্ভাব্য অসুবিধাও রয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অতিরিক্ত ব্যবহার সময় এবং ব্যক্তিগত সম্পর্ক, কাজ এবং শিক্ষার উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম প্ল্যাটফর্ম ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহ করে এবং এটি বিজ্ঞাপনকারীদের কাছে বিক্রি করতে পারে বা ডেটা লিক হতে পারে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম অন্যদেরকে হয়রানি বা হয়রানি করার জন্য একটি প্ল্যাটফর্ম হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে, যা মানসিক স্বাস্থ্যের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভুল তথ্য এবং বিভ্রান্তি ছড়িয়ে দেওয়া সহজ, যা জনমতকে প্রভাবিত করতে এবং সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টি করতে পারে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রায়শই মানুষের জীবনের অতিরিক্ত আদর্শীকৃত চিত্র তুলে ধরা হয়, যা শারীরিক চেহারা, সম্পর্ক এবং সাফল্য সম্পর্কে অবাস্তব প্রত্যাশার দিকে নিয়ে যেতে পারে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারের সাথে বিষণ্নতা, উদ্বেগ এবং আত্মসম্মানের সমস্যাগুলির মধ্যে একটি লিঙ্ক রয়েছে।
লুকিং গ্লাস সেল্ফ তত্ত্ব সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের উপর বেশ কিছু প্রভাব ফেলেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম আমাদের অন্যদের কাছ থেকে প্রতিক্রিয়া পাবার জন্য নতুন সুযোগ তৈরি করে। আমরা আমাদের পোস্ট, ছবি এবং মতামত শেয়ার করতে পারি এবং অন্যদের লাইক, কমেন্ট এবং শেয়ারের মাধ্যমে তাদের প্রতিক্রিয়া পেতে পারি।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম আমাদের বিভিন্ন ধরনের প্রতিফলন পেতে দেয়। আমরা বন্ধু, পরিবার, সহকর্মী, এবং এমনকি সম্পূর্ণ অপরিচিতদের কাছ থেকেও প্রতিক্রিয়া পেতে পারি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে, আমরা অন্যদের কাছে কীভাবে উপস্থাপিত হই তা নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা কম। অন্যরা আমাদের পোস্ট শেয়ার করতে পারে, আমাদের সম্পর্কে মন্তব্য করতে পারে, এমনকি আমাদের অনুমতি ছাড়াই আমাদের ছবি পোস্ট করতে পারে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া, যেমন লাইক, কমেন্ট এবং শেয়ারের মাধ্যমে আত্ম-সম্মান বৃদ্ধি করতে পারে। যখন আমরা অন্যদের কাছ থেকে ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া পাই, তখন এটি আমাদের নিজস্ব মূল্য এবং দক্ষতা সম্পর্কে আমাদের বিশ্বাসকে শক্তিশালী করতে পারে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম আমাদের একই আগ্রহ এবং মূল্যবোধ ভাগ করে নেওয়া ও অন্যদের সাথে সংযোগ করতে সাহায্য করতে পারে। এর ফলে একটি সম্প্রদায়ের অনুভূতি তৈরি হতে পারে যা আমাদের নিজস্ব পরিচয় এবং মূল্যবোধের অনুভূতি প্রদান করতে পারে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম আমাদের নিজেদেরকে বিভিন্ন উপায়ে প্রকাশ করার সুযোগ করে দেয়। আমরা আমাদের চিন্তাভাবনা, অনুভূতি এবং অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে পারি, যা আমাদের নিজেদের আরও ভালভাবে বুঝতে এবং অন্যদের সাথে আরও গভীরভাবে সংযোগ স্থাপন করতে সাহায্য করতে পারে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সামাজিক পরিবর্তনের জন্য একটি শক্তিশালী হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করা যেতে পারে। আমরা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে, অন্যদের সাথে সংহতি প্রকাশ করতে এবং ইতিবাচক পরিবর্তনকে উৎসাহিত করতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করতে পারি।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম আমাদের নিজস্ব আচরণ এবং অন্যদের উপর আমাদের প্রভাব সম্পর্কে আরও সচেতন হতে সাহায্য করতে পারে। যখন অন্যরা আমাদের সম্পর্কে কী ভাবছে তা দেখতে পাই, তখন এটি আমাদের নিজস্ব আচরণ প্রতিফলিত করতে এবং ইতিবাচক পরিবর্তন করতে সাহায্য করতে পারে।
তবে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বেশকিছু নেতিবাচক প্রভাব রয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া, যেমন ডিসলাইক, নেতিবাচক মন্তব্য এবং বুলিংয়ের মাধ্যমে আত্ম-সম্মান হ্রাস করতে পারে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে, আমরা প্রায়শই নিজেদেরকে অন্যদের সাথে তুলনা করি, বিশেষ করে যাদের জীবন ‘পরিপূর্ণ’ বলে মনে হয়। এই তুলনাগুলো ঈর্ষা, অসন্তোষ এবং নেতিবাচক আত্মচিত্রের দিকে নিয়ে যেতে পারে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে, মানুষ প্রায়শই তাদের জীবনের সেরা দিকগুলি তুলে ধরে, যা বাস্তবতার একটি বিকৃত চিত্র তৈরি করতে পারে। এটি অন্যদেরকে নেতিবাচক অনুভূতি এবং অসন্তোষের দিকে নিয়ে যেতে পারে।
যদিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কিছু নেতিবাচক প্রভাব রয়েছে, তবে এর ইতিবাচক দিকটিই আমাদের আত্মসম্মান বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখতে পারে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে আত্মসম্মান বৃদ্ধি করতে ইতিবাচক লোকেদের সাথে সংযোগ করা উচিৎ বলে সমাজবিজ্ঞানীরা মনে করেন। এমন লোকেদের সাথে সংযোগ করা যারা কাউকে উৎসাহিত করে এবং প্রেরণা যোগায়। ইতিবাচক বিষয়বস্তু শেয়ার করা এবং নেতিবাচক মন্তব্য এবং বার্তা এড়িয়ে চলা।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গোপনীয়তা সেটিংস নিয়ন্ত্রণ করা যাতে কে কারো পোস্ট দেখতে পারে তা নিয়ন্ত্রণ করতে পারা যায়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারের সময় সীমা নির্ধারণ করা। প্রতিদিন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কত সময় ব্যয় করা উচিত তা নির্ধারণ করা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বাইরে বন্ধুবান্ধব এবং পরিবারের সাথে সময় কাটানো।
মনে রাখা দরকারÑ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বাস্তব জীবন নয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রায়শই লোকেরা তাদের জীবনের সেরা দিকগুলি তুলে ধরে যার সবকিছুই সত্য নয় এবং সবকিছুই সবার জন্য উপযুক্ত নয়। লুকিং গ্লাস সেল্ফ তত্ত্বের সাথে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের একটি একটি শক্তিশালী সংযোগ রয়েছে। তবে, এই তত্ত্বের যেমন সীমাবদ্ধতা ও সমালোচনা রয়েছে তেমনি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেরও সীমাবদ্ধতা ও সমালোচনা রয়েছে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ইতিবাচক এবং নেতিবাচক উভয়ভাবেই আমাদেরকে প্রভাবিত করতে পারে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করার সময় সচেতন হওয়া এবং এটি আমাদের উপর কী প্রভাব ফেলছে তা পর্যবেক্ষণ করা গুরুত্বপূর্ণ। ইতিবাচক প্রভাবগুলিকে সর্বাধিক করা এবং নেতিবাচক প্রভাবগুলি এড়ানোর জন্য পদক্ষেপ নেওয়াও গুরুত্বপূর্ণ।
লেখক : গবেষক ও উন্নয়নকর্মী