বঙ্গোপসাগরের প্রবল ঘূর্ণিঝড় রেমাল উপকূলে আঘাত হেনেছে। রোববার (২৬ মে) রাত ৮টার দিকে ঘূর্ণিঝড়টির কেন্দ্র মোংলার দক্ষিণপশ্চিম দিক দিয়ে পশ্চিমবঙ্গ উপকূল ও বাংলাদেশের খেপুপাড়া উপকূল অতিক্রম শুরু করেছে। আবহাওয়া অধিদপ্তরের ঘূর্ণিঝড় সতর্কীকরণ কেন্দ্রের উপপরিচালক শামীম আহসান এক ব্রিফিংয়ে এসব তথ্য জানিয়েছেন।
এদিকে এ পর্যন্ত দুইজন নিহত হয়েছে বলে জানিয়েছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মহিববুর রহমান। রোববার (২৬ মে) রাত সাড়ে ৯টায় আবহাওয়া অধিদপ্তরে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি এ কথা বলেন।
প্রতিমন্ত্রী বলেন, উপকূলীয় এলাকার মানুষজন বিপদের মধ্যে আছেন। লাখ লাখ মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছেন। আশ্রয় কেন্দ্রে মানুষজন যেন সঠিকভাবে খাবার পায় সে বিষয়গুলো আমরা মনিটরিং করছি।
তলিয়ে গেছে সুন্দরবন :
ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাবে সুন্দরবন উপকূলসহ মোংলায় ১০ নম্বর বিপদ সংকেত এখনও বহাল রয়েছে। এরইমধ্যে বৃষ্টিসহ দমকা বাতাস বইতে শুরু করেছে উপকূলীয় এলাকায়। জলোচ্ছ্বাসে পানি বেড়ে তলিয়ে গেছে পুরো সুন্দরবন।
পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের করমজল বন্যপ্রাণী প্রজনন কেন্দ্র ও পর্যটন স্পটের ওসি আজাদ কবির রোববার বিকালে জানান, ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাবে স্বাভাবিকের চেয়ে ৪ ফুট পানি বেড়ে সুন্দরবন তলিয়ে গেছে। পানির চাপ আরও বাড়বে। তবে বণ্যপ্রাণির কোনো ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা নেই বলে উল্লেখ করেন তিনি।
পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) জানিয়েছে, উপকূলীয় অঞ্চলের নদ-নদীর পানি বিপৎসীমার ওপরে রয়েছে। জোয়ারে নদীর পানি বাড়ায় তীরবর্তী বিভিন্ন নিম্নাঞ্চল ও লোকালয়ে পানি ঢুকতে শুরু করেছে। পানিতে সুন্দরবন প্লাবিত হয়েছে। করমজলসহ বনের উঁচু এলাকাগুলোও পানিতে তলিয়েছে। তবে এখনো বন্যপ্রাণির ক্ষতির কোনো খবর পাওয়া যায়নি।
বাঁধ ভেঙে পটুয়াখালীর মির্জাগঞ্জ চার গ্রাম প্লাবিত :
পটুয়াখালীর মির্জাগঞ্জ উপজেলায় ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে পায়রা ও শ্রীমন্ত নদের পানি স্বাভাবিকের চেয়ে পাঁচ-ছয় ফুট বেশি বেড়েছে। জোয়ারের পানির তোড়ে বেড়িবাঁধ ভেঙে পানি ঢুকেছে। এতে চার গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। রিমালের প্রভাবে আজ রোববার দুপুরের দিকে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি ও ঝোড়ো হাওয়া বইতে থাকে।
উপজেলার দেউলী সুবিদখালী ইউনিয়নের মেহেন্দিয়াবাদ গ্রামের বেড়িবাঁধ ভেঙে প্লাবিত হয় মেহেন্দিয়াবাদ, চরখালী, গোলখালী, রানীপুর গ্রাম। তবে সন্ধ্যার দিকে ভাটার টানে পানি নেমে গেছে। তবে ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে গোলখালী বেড়িবাঁধ। জোয়ারের পানি বেড়ে সুবিদখালী বাজার, কাঁঠালতলী বাজারসহ নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। তলিয়ে গেছে পায়রাকুঞ্জ ফেরিঘাটের পন্টুনের গ্যাংওয়ে। এতে ভোগান্তিতে পড়েছেন যাত্রীরা।
ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে পায়রা নদীতে জোয়ারের পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় নদীবেষ্টিত মির্জাগঞ্জ ইউনিয়নের সুন্দ্রা কালিকাপুর, ভিকাখালী, রামপুর, পিঁপড়াখালী, কপালভেড়া এবং দেউলী সুবিদখালী ইউনিয়নের গোলখালী, মেহেন্দীয়াবাদ, চরখালী, রানীপুর, কাঁকড়াবুনিয়া ইউনিয়নের ভয়াং ও কাকড়াবুনিয়া গ্রামের মানুষ আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটিয়েছেন।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. তরিকুল ইসলাম বলেন, ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে শ্রীমন্ত নদের পানি বৃদ্ধির কারণে পায়রা নদীবেষ্টিত তিনটি পয়েন্টে বেড়িবাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
কক্সবাজারে প্লাবিত ২১ গ্রাম :
ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে সাগর উত্তাল রয়েছে। সন্ধ্যা ছয়টা থেকে কক্সবাজার স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি উচ্চতার জোয়ারের পানিতে প্লাবিত হয়েছে পৌরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ডের নাজিরাটেক, কুতুবদিয়াপাড়া, সমিতিপাড়া, ২ নম্বর ওয়ার্ডের উত্তর নুনিয়াছটাসহ অন্তত ২১টি গ্রাম। এসব গ্রামের হাজারো মানুষ গৃহপালিত প্রাণী, প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম, কাপড়চোপড় নিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে শহরের দিকে ছুটছে। উপকূলের মানুষের আশ্রয়ের জন্য শহরের কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, পাবলিক হল ও কিছু হোটেল খুলে দেওয়া হয়েছে।
কক্সবাজারে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকলেও ভারী বৃষ্টিপাত হয়নি, সারা দিন থেমে থেমে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি ও দমকা হাওয়া বইতে থাকে। সকাল থেকে লোকজনকে নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে এলাকায় প্রচারণা চালানো হলেও তেমন সাড়া মেলেনি। তবে বিকেল চারটার পর থেকে উপকূলের লোকজন আশ্রয়কেন্দ্রের উদ্দেশে বাড়িঘর ছাড়তে শুরু করে। সন্ধ্যা ছয়টা থেকে আশ্রয়কেন্দ্রের দিকে ছুটে চলা মানুষের সংখ্যা বাড়তে থাকে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের সর্বশেষ বুলেটিনে কক্সবাজার উপকূলকে ৯ নম্বর মহাবিপৎসংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে। ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে সমুদ্রের পানির উচ্চতা সর্বোচ্চ ১২ ফুট বৃদ্ধি পেয়ে এলাকা প্লাবিত হতে পারে। দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে কক্সবাজার বিমানবন্দরে উড়োজাহাজের ওঠানামা সারাদিনের জন্য বন্ধ রাখা হয়।
নাজিরারটেক উপকূলে শুঁটকি উৎপাদনের মহাল রয়েছে প্রায় ৭০০টি। জোয়ারের পানিতে ইতিমধ্যে ৩০০টির বেশি মহাল পানিতে ডুবে গেছে। বাসিন্যাপাড়া, মোস্তাইক্যাপাড়া, বন্দরপাড়া, কুতুবদিয়াপাড়া, খুদিয়ারটেক পাড়া, সমিতিপাড়ার শত শত ঘরবাড়ি পানিতে প্লাবিত হচ্ছে। এসব ঘরবাড়ির লোকজন নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যাচ্ছে।
জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, সাগরদ্বীপ কুতুবদিয়া, মহেশখালী, সেন্টমার্টিন দ্বীপসহ অন্যান্য উপকূলের লোকজনও বিকেল চারটা থেকে আশ্রয়কেন্দ্রে ছুটছে। পুলিশ, র্যাবসহ বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা মাঠে রয়েছেন। জরুরি সেবা কার্যক্রমে অংশ নিতে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ছুটিও বাতিল করা হয়েছে।
জেলা প্রশাসক মুহম্মদ শাহীন ইমরান বলেন, সন্ধ্যা ছয়টার দিকে সাগরে জোয়ার শুরু হওয়ায় ঝুঁকি বাড়ছে। নাজিরারটেক উপকূলসহ জেলার বিভিন্ন নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হওয়ার খবর পাওয়া যাচ্ছে। ওই সব এলাকার মানুষ ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্রে ছুটছে। ৬৩৮টি ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র ও শতাধিক বহুতল ভবনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা রাখা হয়েছে। আশ্রিতদের জন্য শুকনো খাবার, খাওয়ার পানি, ওষুধের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। দুর্যোগ মোকাবিলায় সিপিপি ও রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির ১০ হাজার ৮০০ জন স্বেচ্ছাসেবী মাঠে তৎপর রয়েছেন।
২৫ লাখ গ্রাহকের বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ :
উপকূলের বিভিন্ন এলাকার ২৫ লাখ গ্রাহকের বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রয়েছে। উপকূলীয় অঞ্চলগুলোতে ঝড়ো বাতাসে গাছ পড়ে দুর্ঘটনা যাতে না ঘটে, সেজন্য ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলোতে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রেখেছে পল্লী বিদ্যুৎ সমিতিগুলো।
বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের (বিআরইবি) এক পরিচালক নাম প্রকাশ না শর্তে বলেন, ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে দুর্ঘটনা এড়াতে ১৪টি পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির ২৫ লাখ ৬৯ হাজার ৫০০ গ্রাহকের বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রয়েছে। উপকূলীয় অঞ্চলগুলোর বিদ্যুৎকর্মীদের ছুটি বাতিল করা হয়েছে। ঘূর্ণিঝড় শেষ হওয়ার পরপরই যাতে দ্রুত বিদ্যুৎ পরিস্থিতি স্বাভাবিক করা যায়, সেই লক্ষ্যে প্রত্যেকটি সমিতির কর্মীরা প্রস্তুত রয়েছেন। পটুয়াখালীতে ছয় লাখ গ্রাহকের বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রাখা হয়েছে। তাছাড়া বাগেরহাটে ৪ লাখ ৫০ হাজার ও ভোলায় ৪ লাখ ২৫ হাজার গ্রাহকের বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রয়েছে।