রাশিয়া ও ইউক্রেন যুদ্ধের পর সারা বিশ্বে যখন মূল্যস্ফীতি বাড়ছিল, তখন প্রায় সব কেন্দ্রীয় ব্যাংকই সুদহার বৃদ্ধির মাধ্যমে তা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চালায়। এতে করে বিশ্বের বেশির ভাগ দেশই সফল হয়। তবে বাংলাদেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতির দেখা মিললেও বাংলাদেশ ব্যাংক তখন কোনো পদক্ষেপই নেয়নি। প্রায় সব দেশ যখন উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সফলতা পেতে শুরু করে, তখনো বাংলাদেশ ব্যাংক বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ রক্ষায় আমদানি সীমিত করে আনে। এতে করে উচ্চ মূল্যস্ফীতি দীর্ঘ সময় ধরে বহাল রয়েছে।
মূল্যস্ফীতি হল দামের ধারাবাহিক বৃদ্ধি। কোনও একটি বা দুটি পণ্যের নয়, এক জন গড় ক্রেতার প্রয়োজন, এমন সব পণ্যের সম্মিলিত ‘বাস্কেট’ এর দামের বৃদ্ধি। মূল্যস্ফীতি সমস্যা তৈরি করে। মূল্যস্ফীতির ফলে প্রতিদিনের কেনাকাটার খরচ বাড়ে। সাধারণত বাজারে মূল্যস্ফীতি ঘটলে চাকরিদাতা সংস্থা কর্মীদের বেতন বাড়ায়, যাতে এই বাড়তি দামের কারণে বেড়ে যাওয়া খরচ সামলানো যায়। কিন্তু, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, বেতন যতটুকু আর যতটুকু বাড়ল, তা মূল্যস্ফীতির বোঝা সামলানোর জন্য যথেষ্ট নয়। অনেকের ক্ষেত্রে তো বেতন আদৌ বাড়ে না- দুর্ভাগ্যক্রমে, দরিদ্রতম শ্রমিকরাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এই দলে থাকেন। ফলে মূল্যস্ফীতি হলে গরীব মানুষের পক্ষে খাবারের মতো নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস কেনাও কঠিনতর হয়। অন্য ভাষায় বললে, মূল্যস্ফীতি নীরবে গরীব মানুষের টাকা লুট করে। তাই মূল্যস্ফীতিকে প্রায়শই একটি কর হিসাবে দেখা হয়।
মূল্যস্ফীতির ফলে কি অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বিপাকে পড়ে? হ্যাঁ, মূল্যস্ফীতির ফলে ব্যবসাও সমস্যায় পড়ে। ধরা যাক, খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি ঘটল কাজেই, খাবার কিনতে হলে একটা মাঝারি আর্থিক সামর্থ্য সম্পন্ন পরিবারকে অন্য কোনও খাতে খরচ কমাতে হবে। আবার বেশি অপরিহার্য নয়, এমন জিনিস কেনাকাটায় কাঁটছাট করতে হয়। যেমন প্রসাধনীসামগ্রীসমূহ শ্যাম্পু বা সাবান ফলে, এই জাতীয় কোম্পানীগুলো বিপাকে পড়ে। সব মিলিয়ে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড গতি হারায়।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) তথ্য মোতাবেক, এপ্রিল-২০২৪ গড় মূল্যস্ফীতি দাঁড়ায় ৯ দশমিক ৭৪ শতাংশ । মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ৭৪ শতাংশ বলতে বোঝায় ২০২৩ সালের এপ্রিলে যে পণ্য ১০০ টাকায় কেনা সম্ভব হয়েছিল ২০২৪ সালের এপ্রিলে তা কিনতে হয়েছে ১০৯ টাকা ৭৪ পয়সায়।
সূত্র মতে- ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে মূল্যস্ফীতি ৬ দশমিক ৫ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়। তবে মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশের মধ্যে রাখার সরকারের যে লক্ষ্যমাত্রা তার ধারে কাছেও রাখা সম্ভব হচ্ছে না। খাদ্য মূল্যস্ফীতি বাড়ছে। গত এপ্রিল মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেড়ে ১০ দশমিক ২২ শতাংশ উঠেছে। তবে মূল্যস্ফীতির চাপ সামলাতে শহরের চেয়ে গ্রামের মানুষ বেশি চাপে আছে। একই সঙ্গে যে হারে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে সেভাবে মানুষের আয় বাড়েনি। বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের মুল্য বৃদ্ধির কারণে অনেক দেশে মূল্যস্ফীতি ঘটে। আবার আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের সরবরাহ স্বাভাবিক ও মূল্য হ্রাসের কারণে অনেক দেশে পর্যায়ক্রমে নেমে আসে। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি উল্টো আরও বাড়তে থাকে।
আমাদের মূল্যস্ফীতি তা হলে কীসের উপর নির্ভর করে? আমাদের মূল্যস্ফীতি নির্ভর করে আংশিক আন্তর্জাতিক মূল্যও আংশিক অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার ওপর। গত দুই বছরে বিশ্ববাজারে পণ্যের মূল্য বেড়েছে, ওই সময় দেশেও বেড়েছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে অনেক কমলেও আমাদের মূল্যস্ফীতি বেড়েই চলছে। ফলে বিশ্ববাজারে দাম কমলেই দেশে স্বয়ংক্রিয়ভাবে মূল্যস্ফীতি কমবে সেটি ধরে নেওয়া যায় না। এখন আমরা কতটা পণ্য আমদানি করতে পারছি, ডলারের মজুত কেমন, ঘাটতি বাজেটের জন্য কতটা টাকা প্রয়োজন, মুদ্রানীতি সংকোচন না সম্প্রসারণ দেওয়া হচ্ছে রাজস্বনীতি এসবের ওপর নির্ভর করে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ।
মূল্যস্ফীতির ফলে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করা কঠিনতর হয়। এটা শুধু যে গৃহস্থালির ক্ষেত্রে সত্যি তা নয়, ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের পক্ষে ও সত্যি। ধরা যাক, কোন পরিবার তাদের মাসিক আয় থেকে পরিকল্পনামাফিক টাকা জমাচ্ছেন, যাতে চাকরি অবসরের পর সংসার চালানোর জন্য হাতে যথেষ্ট টাকা থাকে। যে কোন পরিবার এই ধরনের সঞ্চয় করে থাকতে পারে এবং তারা এটাও বোঝেন যে, আজ সংসার চালাতে যে পরিমান টাকা খরচ হচ্ছে ১০ বা ১৫ বছর পর জীবনযাত্রার চলমান মান বজায় রাখতে হলে অনেক বেশি টাকার প্রয়োজন হবে। ফলে তারা মূল্যস্ফীতির একটি নির্দিষ্ট হার ধরে নিয়েই টাকা জমানোর পরিকল্পনা করেন। কিন্তু খুব বেশি হারে মূল্যস্ফীতি ঘটতে থাকলে হিসাব গুলিয়ে যায়। ফলে অবসর গ্রহণের সময় তিনি যদি একটি বাড়ি বা গাড়ি কেনার কথা ভাবেন তখন এই অতিরিক্ত মূল্যস্ফীতির ফলে ক্রয়ক্ষমতা কমে যাবে। ঠিক তেমনিভাবে কোনও সংস্থা যদি আজ একটি কারখানা বা বিমান বন্দর তৈরি করার কথা ভাবে তাহলে তাদের হিসাব করতে হয় যে, আগামী এক-দুই দশকে সেই বিনিয়োগ থেকে কী রকম টাকা আয় করা যেতে পারে এবং কত খরচ হতে পারে। মূল্যস্ফীতির হার যদি স্থিতিশীল না হয়, তবে সেই হিসাব করা মুশকিল হবে। যদি চড়া হারে বা এলোপাতাড়ি মূল্যস্ফীতি ঘটতে থাকে, তবে কোনও সংস্থার পক্ষে এই হিসাব করা কঠিন হবে। ফলে তারা সাবধান হয়ে বিনিয়োগ থেকে হাত গুটিয়ে নিতে পারে। তেমনটা হলে দেশের আর্থিক বৃদ্ধির ক্ষতি হয়।
গবেষণা সংস্থা সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) তথ্য মোতাবেক, বাংলাদেশ ব্যাংক সুদের হারে নিয়ন্ত্রণ ছেড়ে দেওয়ায় তা বাড়ছে। এটা মূল্যস্ফীতি কমাতে ভূমিকা রাখবে, তবে তা সময় সাপেক্ষ। একদিকে সুদের হার যদি বাড়ে, আরেক দিকে মার্কিন ডলারের দামও বাড়তে থাকে, তাহলে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ সহজ হবে না। কারণ ডলারের দাম বাড়লে পণ্যও কাঁচামালের আমদানি ব্যয় বাড়ে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ভোক্তার চাহিদা হ্রাসের লক্ষ্যে নীতি সুদহার বাড়ানো ও সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি গ্রহণ করা হয়েছে। সুদের হার ক্রমান্বয়ে বাড়ানো হচ্ছে। ইতোমধ্যে ৯ শতাংশ সুদ হারের ক্যাপ তুলে নেওয়া হয়েছে। এ উদ্যোগের ফলে ব্যাংকের তারল্য আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে শুরু করেছে। ফলে বাজারে ভোক্তার চাহিদা হ্রাস পাবে এবং মূল্যস্ফীতি কমাতে সহায়ক হবে। সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির আওতায় সরকারের উন্নয়ন খাতে ঋণ বন্ধ রেখেছে। পাশাপাশি রাষ্ট্রায়াত্ত ব্যাংকগুলো নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি ব্যয় মেটাতে রিজার্ভ থেকে বৈদেশিক মুদ্রা সরবরাহ করছে। মূল্যস্ফীতির আশঙ্কার অন্য কারণ হল আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত তেলের চড়া দাম। চীনের নির্মাণ ক্ষেত্র ফের চাঙ্গা হয়েছে এবং এর ফলে অপরিশোধিত তেলের দাম বেড়ে ব্যারেল প্রতি ৯০ ডলারের কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছে। পশ্চিম এশিয়ার ভূ-রাজনৈতিক সংকটের ফলে তা আরও বাড়ার আশঙ্কা।
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাজ শুধু সুদহার বাড়নোই নয়, নিত্য পণ্যের বাজারে অব্যাহত নজরদারি রাখা ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাজ। দক্ষিণ এশিয়ায় মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে যুগান্তকারী উদাহরণ তৈরি করেছিল শ্রীলঙ্কার কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তাদের মূল্যস্ফীতি যখন ৮০ শতাংশের কাছাকাছি ছিল, তখন সুদহার বাড়িয়েই বসে থাকেনি দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্ণর। খুচরা বাজার থেকে শুরু করে পাইকারি বাজারের প্রত্যেকটি পণ্যে নজরদারি করেছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। প্রতিদিনের পণ্যমুল্যের তথ্য শ্রীলঙ্কার কেন্দ্র্রীয় ব্যাংকের ওয়েবসাইটে প্রদর্শন করা হত।
মূল্যস্ফীতি নিয়ে অর্থমন্ত্রণালয়ের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০০৯-২০২১ সাল পর্যন্ত দেশে গড় মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৬ দশমিক ৫৫ শতাংশ। কিন্তু চলতি বছরে প্রতি মাসে গড় মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের ওপরে বিরাজ করছে। কোভিড মহামারির পর উল্লেখযোগ্য পরিমাণ চাহিদা বৃদ্ধি এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বৈশি^ক সরবরাহ ব্যবস্থায় অস্থিরতা দেখা দেয়। এতে মূল্যস্ফীতি বাড়তে থাকলে এর প্রভাব এসে পড়ে বাংলাদেশের ওপর। তাই মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনতে অর্থনৈতিক কারণগুলো রাজস্ব ও মূদ্রানীতির মাধ্যমে মোকাবিলা করতে হবে। এ জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংককে সতর্ক থাকতে হবে।
লেখক : অর্থনীতি বিশ্লেষক