শৈলজারঞ্জনের অদেখা আলোর ভুবন

: মুহম্মদ আকবর
প্রকাশ: ৭ মাস আগে

রবীন্দ্রসংগীতের স্বরলিপিকা, শান্তিনিকেতনের সংগীত ভবনের সাবেক অধ্যক্ষ ছিলেন সঙ্গীতজ্ঞ শৈলজারঞ্জন মজুমদার। তিনি বাংলাদেশের নেত্রকোণা জেলার মোহনগঞ্জ উপজেলার বাহামগ্রামে জন্ম নিলেও তাঁর বিকাশ কলকাতায়। দীর্ঘ বছর তাঁর জন্মভিটা বেদখলে থাকলেও বর্তমানে বৃহত্তর পরিবেশে গড়ে উঠেছে তাঁর নামঙ্কিত সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। ইতোমধ্যে এই সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে স্থানীয় থেকে জাতীয় পর্যায়ের মানুষের আনাগোনায় এটি হয়ে উঠেছে আদরণীয় এবং দর্শনীয় স্থান। শুধু সাংস্কৃতিক আয়োজনেই নয়, ঈদ পার্বণ তথা যেকোনো বিশেষ দিনে পরিবার, স্বজন ও শুভানুধ্যায়ীদের নিয়ে এই সংস্কৃতিকেন্দ্রে যাওয়ার স্বতস্ফূর্ততা মানুষের মধ্যে লক্ষ্য করা যাচ্ছে।

মাতৃভূমি বা জন্মভিটা নিয়ে শৈলজারঞ্জন মজুমদারের  ভালোবাসা ও আক্ষেপের কথা  তাঁর আত্মজীবনী ‘যাত্রাপথের আননন্দগান’-এ পাই ১৯৭৫ সালে তিনি যখন দ্বিতীয়বারের মতো বাংলাদেশে এবং তাঁর জন্মভূমিতে গেলেন তখন গিয়ে দেখলেন তাঁর গ্রামের বাড়িতে (বাহাম) উদ্বাস্তু আর শহরের বাড়িতে (নেত্রকোণায়) মসজিদ হয়েছে। তিনি নিজ থেকে ক্ষোভ প্রকাশ না করলেও মনের মধ্যে একটা চাপা কষ্ট ছিলো তাতো বলার অপেক্ষা রাখে না। তবুও বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আন্তরিকতা এবং বাংলাদেশের শিল্প ও সাহিত্যে অঙ্গনের মানুষের ভালোবাসা তাঁকে মুগদ্ধ করেছিলো। তাঁর আত্মজীবনী যাত্রাপথের আনন্দনগান-এর ১৩৩ পৃষ্ঠায় (কলকাতায়, আনন্দ প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত) উল্লেখ করেছেন, ‘অশ্রুভারাক্রান্ত হৃদয় নিয়ে ফিরে এলাম। ফিরে আসার দিনের কথা মনে পড়ে; ছেলেমেয়েরা (মোহনগঞ্জে) দু’ভাগ হয়ে মাঝখানে আমাকে নিয়ে মিছিল করে হাঁটতে হাঁটতে স্টেশনে এল। স্টেশনে আসতে আসতে সামনের দল বলছে- ‘শৈলজারঞ্জন, শৈলজারঞ্জন!’ পেছনের দল প্রতিধ্বনি করছে, ‘ফিরে এসো, ফিরে এসো!’

বইটির ১৩৪ পৃষ্ঠায় অর্থাৎ শেষ পৃষ্ঠায় তিনি বলেছেন, ‘ইচ্ছে ছিলো আবার জন্মভূমিতে যাবো; কিন্তু বঙ্গবন্ধু মুজিবর (মুজিবুর) রহমানের মৃত্যুতে (ঘাতকের নির্মম আঘাতে নিহত) সে ইচ্ছা বিসর্জন দিতে হয়েছিল। মনে পড়ে, তিনি বারবারই বলেছিলেন থেকে যেতে। বলেছিলেন, ‘আপনারে আর ছাড়ুমই না।’ উত্তরে বলেছিলাম, আমার গ্রামের বাড়িতে উদ্বাস্তু, শহরের বাড়িতে মসজিদ হয়েছে, থাকার জায়গা কোথায় কোথায়? উত্তরে জোর দিয়ে তিনি (বঙ্গবন্ধু) বলেছিলেন, ‘ছাইড়া দ্যান। আমি আপনেড়ে বাড়ি দিমু, গাড়ি দিমু, ডোমিডিস দিমু।’ তিনি বলেছিলেন, ‘আপনার জায়গার অভাব হবে না। সে আমিও আমার অন্তরের অন্তস্তলে উপলব্ধি করেছি।’

আজ শৈলজারঞ্জন মজুমদারের জন্মভিটায় মোহনগঞ্জ উপজেলার বাহামগ্রামে আর উদ্বাস্তু নেই। সেখানে স্থানীয় সংসদ সদস্য জনাব সাজ্জাদুল হাসানের উদ্যোগে এবং সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে উঠেছে নান্দনিক সংস্কৃতি কেন্দ্র। জনাব সাজ্জাদুল হাসান প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব (সিনিয়র সচিব) থাকাকালীন কর্মযজ্ঞ শুরু করেছিলেন পরবর্তীতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভার্চুয়ালি এটির উদ্বোধন করেন। আর গত পহেলা বৈশাখে বর্ষবরণের মধ্য দিয়ে এটির আনুষ্ঠানিক কর্মযাত্রা শুরু হয়েছে।

সম্প্রতি এখানে রবীন্দ্রজয়ন্তী অনুষ্ঠানও অত্যন্ত সফল হয়েছে। দুটি অনুষ্ঠানেই ঢাকা থেকে গুণী মানুষ অতিথি হিসেবে গিয়েছেন। আরও অনেকে যাওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। দৃষ্টিনন্দন ভবন এবং একটি অনুষ্ঠানের ভিডিও ও আলোকচিত্র আমি সম্প্রতি কলকাতায় শৈলজারঞ্জনের ভক্ত-অনুরাগীদের সঙ্গে শেয়ার করেছি। স্ব-শরীরে গিয়ে পশ্চিমবঙ্গের কবি ও সঙ্গীত অনুরাগী কালিকৃষ্ণ গুহকে প্রতিষ্ঠানটির বিশ্বালতা দেখিয়েছি। তিনি এসব দেখে রীতিমোত আপ্লুত হয়েছেন এবং এটির সমৃদ্ধি কামনা করেছেন। পশ্চিমবঙ্গের বিশিষ্ট সমাজসেবী ও রোকেয়া, ঈশ্বচন্দ্র ও রবীন্দ্র গবেষক প্রাণতোষ বন্দ্যোপাধ্যায় শুরু থেকেই জানেন বাংলাদেশে শৈলজারঞ্জন মজুমদার নিয়ে বাংলাদেশে কাজ হচ্ছে। কিন্তু সেই কাজের পরিধি যে এত বড় এবং নান্দনিক তা তাঁর ধারণার বাইরে ছিল। বিস্তারিত জেনে তিনি বলেছিলেন, ‘বড় কাজ হয়েছে। আমরা যা পারিনি তোমরা তা করে দেখিয়েছো।’

অনুমান করি, শৈলজারঞ্জন মজুমদার নিজে এমন কর্মযজ্ঞ দেখে যেতে পারলে কী যে খুশি হতেন! এমন দৃষ্টিনন্দন ভবন এবং যেখানে হবে সঙ্গীত সংস্কৃতি চর্চার ভুবন। তিনি দেখে যেতে না পারলেও তার অদেখা এই আলোর-ভুবন সৃষ্টির মধ্য দিয়ে তাঁকে যে মন-প্রাণ উজার করে সম্মান দেখানো হয়েছে তা যে কেউ স্বীকার করবেন।

উল্লেখ্য, শৈলজারঞ্জনের স্মৃতি রক্ষার্থে কিছু করা দীর্ঘদিনের অভিপ্রায় বা দাবী ছিলো এলাকবাসীর। জমি উদ্ধারের পরিকল্পনা করা, লেখালেখি থেকে শুরু অনেক পরিকল্পনাই করেছিলেন বাংলাদেশের মাননীয় প্রধান বিচারপতি, সাংস্কৃতিক অনুরাগী মানুষ জনাব ওবায়দুল হাসান। যিনি জনাব সাজ্জাদুল হাসান এমপি মহোদয়ের বড় ভাই।

আজ ২৪ মে শৈলজারঞ্জন মজুমদারের প্রয়াণ দিবস। বিগত প্রায় এক যুগের ধারাবাহিকতায় তাঁকে মোহনগঞ্জে স্মরণ করা হবে। তবে উপজেলা নির্বাচনসহ কিছু সীমাবদ্ধতার কারণে এই আয়োজনের পরিধি ছোট করা হয়েছে। শীঘ্রই আরও একটি বড় আয়োজন হওয়ার কথা রয়েছে। আজ সকাল ১০টায় শৈলজারঞ্জন সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে আলোচনা সভা হবে। এতে প্রধান অতিথি হিসেবে থাকবেন শৈলজারঞ্জন কল্যাণ ট্রাস্ট-এর কার্যনির্বাহী কমিটির সভাপতি ও নেত্রকোণা জেলা প্রশাসক শাহেদ পারভেজ। এছাড়াও স্থানীয় সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেবেন বলে জানিয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির ভারপ্রাপ্ত কো-অর্ডিনেটর ও মোহনগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার রেজওয়ানা কবির। এছাড়াও অনেকে লেখালেখি কিংবা ঘরোয়া আয়োজনে শৈলজারঞ্জনের কর্মময় স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করবেন।

শৈলজারঞ্জনের জন্ম ১৯০০ সালের ১৯ জুলাই, ১৩০৭ বঙ্গাব্দের ৪ শ্রাবণ। পিতা রমণীকিশোর দত্ত মজুমদার, মাতা সরলা সুন্দরী। তিনি নেত্রকোনা দত্ত স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করে চলে যান কলকাতায়। কলকাতার বিদ্যাসাগর কলেজ থেকে আইএ পাস করেন। পরবর্তী সময়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রসায়নে পড়াশোনা করেন। মাস্টার্সে রসায়নে রেকর্ড অর্জন করেন অর্থাৎ ওই বছর তিনি ওই বিভাগে সর্বোচ্চ স্থান (দ্বিতীয় শ্রেণীতে প্রথম) পান। কিছুদিন ওকালতি করেনও। কিন্তু শৈশবে যার ঘরে রবীন্দ্রনাথের গানের রেওয়াজ হতো, হারমুনিয়াম বাজিয়ে দাদিমার সঙ্গে যিনি গান গাইতেন, সেই ব্যক্তিকে কি ওকালতিতে ধরে রাখা যায়? না, সেখানে রাখা যায়নি। তিনি রবীন্দ্রনাথের কাছেই চলে গেলেন। একপর্যায়ে রবীন্দ্রনাথকে মুগ্ধ করলেন এবং রবীন্দ্রনাথ তার ওপর আস্থা রাখলেন। ব্যাপারটা অনেকটা এরকম- ‘আসলেন, দেখলেন, জয় করলেন’।

রবীন্দ্রনাথ তাকে শান্তিনিকেতনের শিশুদের ক্লাস থেকে নিয়ে গেলেন সঙ্গীত ভবনে। সেখানে প্রায় ২২ বছর সংগীত ভবনের দায়িত্ব দিয়ে রাখলেন। রবীন্দ্রনাথের গানের স্বরলিপি করতে বললেন। সেই স্বরলিপিতেও রবীন্দ্রনাথ আস্থা রাখলেন। রবীন্দ্রনাথের গান ও গীতিনৃত্যনাট্য নিয়ে দেশ-বিদেশে ভ্রমণ করলেন। সবচেয়ে বিস্ময়কর বিষয় হলো- শান্তিনিকেতনের বাইরে প্রথম ১৯৩২ সালে নেত্রকোণায় তাঁর কৈশরের স্মৃতি বিজড়িত স্কুল দত্ত স্কুলে অনেক প্রতিবন্ধকতার মধ্য দিয়ে রবীন্দ্রজয়ন্তী পালন করেন। যার ধারাবাহিকতা চলে প্রায় এক যুগ। রবীন্দ্রনাথ এমন খবর পেয়ে চিঠি লিখে তার মুগ্ধতার কথা জানিয়েছিলেন শৈলজারঞ্জন মজুমদারকে। এটাও তো এখন সবার জানা।

রসায়নের ছাত্র সংগীতে আসায় শৈলজারঞ্জন মজুমদারকে ‘মিউজিক্যাল কেমিস্ট্রির’ লোক বলে মজা করতেন রবীন্দ্রনাথ। গানের প্রতিভার জন্য বলতেন ‘গীতাম্বুধি’ (গীত+অম্বুধি) গানের সাগর। রবীন্দ্রনাথের অনুরোধ ছিল তিনি যে কোনো কখনো শান্তিনিকেতন ছেড়ে না যান। রবীন্দ্রনাথের গানের ভার না ছাড়েন। কী এক অজ্ঞাত কারণে তিনি সেখান থেকে চলে আসেন! কেন তার সঙ্গে শান্তিদেব ঘোষের বিরোধ হলো তা আজও অজ্ঞাত! এই লেখার প্রাসঙ্গিকতাও তা নয়।

১৯৯২ সালের ২৪ জুলাই কলকাতার সল্টলেকে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন শৈলজারঞ্জন মজুমদার। আমৃত্যু তিনি রবীন্দ্রনাথে ডুবে ছিলেন। তৈরি করে গেছেন রবীন্দ্রশিক্ষার্থী ও অনুরাগী। তাঁর শিক্ষার্থীদের অমলা বসু, কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, সুচিত্রা মুখোপাধ্যায়, কমলাসেন, অশোকতরু, বাংলাদেশের সনজীদা খাতুন, আবদুল আহাদ প্রমুখ। শুধু তাই নয়, পৃথিবীজুড়ে যাদের কণ্ঠে অপূর্ব মহিমায় শোভা পায় তাঁরা হয় শৈলজারঞ্জনের শিক্ষার্থী কিংবা অনুরাগী। সবার আন্তরিকতায় শৈলজারঞ্জন মজুমদারের অদেখা আলোর ভুবনটি এগিয়ে যাবে তাঁর প্রয়াণ দিবসে এই হোক আমাদের প্রত্যয়।

 লেখক : গবেষক

  • শান্তিনিকেতন
  • শৈলজারঞ্জন মজুমদার
  • #