জাতিসংঘ অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদের সদস্যপদ, সিরডাপের গভর্নিং কাউন্সিলের চেয়ার, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলের আঞ্চলিক পরিচালকের পদ, ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম অর্গানাইজেশনের সদস্যপদ, ইউনেস্কোর নির্বাহী বোর্ডের সদস্যপদ এবং কমন ফান্ড ফর কমোডিটিসের (সিএফসি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে আন্তর্জাতিক নির্বাচনে বাংলাদেশ জয়লাভ করেছে। এই নির্বাচনগুলোর মধ্যে রয়েছে। এছাড়াও, বাংলাদেশ অর্গানাইজেশন ফর দ্য প্রহিবিশন অফ কেমিক্যাল ওয়েপন্স এবং জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার কাউন্সিলের নির্বাহী সদস্য নির্বাচিত হয়।
সন্দেহ নেই, আন্তর্জাতিক বিভিন্ন বহুজাতিক সংস্থার এসব নির্বাচনে বাংলাদেশের ধারাবাহিক সাফল্য আমাদের প্রতি বিশ্ব সম্প্রদায়ের আস্থা ও ভরসার প্রতিফলন ঘটায় এবং সমসাময়িক আর্থসামাজিক বিভিন্ন বিষয়ে বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান প্রভাব ও ভূমিকাকে তুলে ধরে। বর্তমানে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি, জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিল এবং ইউএন অফিস ফর প্রজেক্ট সার্ভিসেস এর নির্বাহী বোর্ডের সভাপতি হিসাবে বাংলাদেশ ইতিমধ্যে বৈশ্বিক উন্নয়ন সহযোগিতার ক্ষেত্রে নেতৃত্বে দিচ্ছে যা আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে আমাদের ভূমিকাকে সুদৃঢ় করবে বলেই প্রতীয়মাণ।
জাতিসংঘ অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদের সদস্যপদ : গত ৭ জুন, বাংলাদেশ ২০২৫-২০২৭ মেয়াদে এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের প্রতিনিধিত্বকারী জাতিসংঘের একটি মর্যাদাপূর্ণ ও অপরিহার্য সংস্থা, অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের হল রুমে অনিষ্ঠিত এই নির্বাচনে বাংলাদেশ ১৮৯টি ভোটের মধ্যে ১৮১টি ভোটে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে ইকোসকের এই সদস্যপদ কার্যত হবে। এটি বাংলাদেশকে তার উদ্ভাবনী দারিদ্র্য বিমোচন, স্বাস্থ্যসেবা এবং জলবায়ু স্থিতিস্থাপকতা পদ্ধতির প্রদর্শন করতে সহায়তা করবে।
ইকোসক জাতিসংঘ ব্যবস্থার অন্যতম মূল ভিত্তি এবং উন্নয়ন ব্যবস্থাপনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আশা করা যায় যে, এই সংস্থার সদস্যপদ বাংলাদেশকে ভিশন ২০৪১ বাস্তবায়নে একটি কৌশলগত প্ল্যাটফর্ম প্রদান করবে যার মাধ্যমে বিভিন্ন ফোরাম এবং কমিটিতে বাংলাদেশ সক্রিয়ভাবে নীতি নির্ধারণ করতে পারে এবং বৈশ্বিক উন্নয়ন প্রচেষ্টায় অবদান রাখতে পারে। ইকোসকের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হয়ে বাংলাদেশ এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে অংশীদারিত্ব গড়ে তুলতে পারবে, সম্পদ সংগ্রহ করতে পারবে এবং জাতীয় ও বৈশ্বিক পর্যায়ে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জনের দিকে অগ্রগতি ত্বরান্বিত করতে পারবে।
সিরডাপ : বাংলাদেশ আগামী দুই বছরের জন্য এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের সমন্বিত পল্লী উন্নয়ন কেন্দ্র (সিরডাপ) এর চেয়ারপারসন নির্বাচিত হয়েছে। ৬ জুন ব্যাংককে অনুষ্ঠিত সিরডাপের গভর্নিং কাউন্সিলের ২৪তম বৈঠকে দেশটি এই পদ অর্জন করে। কার্যনির্বাহী কমিটির সভা ৪-৫ই জুন পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হয় এবং আরডিসিডি-র সচিব এতে অংশ নিয়ে সহ-সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
বৈঠকে সদস্য দেশগুলি কেন্দ্রের কার্যকারিতা পর্যালোচনা করে এবং কীভাবে এর লক্ষ্য অর্জন করা যায় তা নিয়ে আলোচনা করে। গভর্নিং কাউন্সিল পরবর্তী চার বছরের জন্য একজন নতুন মহাপরিচালক নিয়োগ করে। ২০২৬ সালে গভর্নিং কাউন্সিলের বৈঠকের আয়োজক দেশ হিসেবেও বাংলাদেশ নির্বাচিত হয়।
ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম অরগানাইজেশন : ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম অরগানাইজেশন (আইওএম) হল জাতিসংঘের একমাত্র বিশেষায়িত সংস্থা যার লক্ষ্য বিশ্বব্যাপী জাহাজ চলাচলের মান নিয়ন্ত্রণ করে যা জাহাজ পরিচালনাকারী রাষ্ট্র, নাবিক, সামুদ্রিক নিরাপত্তা ও নিরাপত্তা এবং সামুদ্রিক দূষণকে দূর করা। গত ১ ডিসেম্বর লন্ডনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বাংলাদেশ ২০২৪-২০২৫ সালের জন্য আই.ও.এম কাউন্সিলের সদস্য নির্বাচিত হয়। বাংলাদেশ ভোটদানকারী ১৬৬টি সদস্য দেশের মধ্যে ১২৮টি ভোট পেয়েছিল। নির্বাচনটি অত্যন্ত প্রতিযোগিতামূলক ছিল, কারণ ২৫টি দেশ ২০টি পদের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিল।
২০২৪-২৫ সময়কালে কাউন্সিলের সদস্য হিসাবে বাংলাদেশ তার আন্তর্জাতিক বাণিজ্য (যার ৯০ শতাংশ সমুদ্র দ্বারা পরিচালিত হয়), সামুদ্রিক বন্দরগুলোকে সবুজ, ডিজিটালাইজড এবং স্মার্ট বন্দরে রূপান্তর, জাহাজ পুনর্ব্যবহার সম্পর্কিত হংকং কনভেনশন মেনে চলা এবং বাংলাদেশের জাহাজ দ্বারা সবুজ জ্বালানির ব্যবহার, বাংলাদেশের শিপিং ও সামুদ্রিক শিল্পের জন্য অন্যান্য সমালোচনামূলক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলির মধ্যে আলোচনা করবে।
এছাড়াও, যুক্তরাজ্যে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার সাইদা মুনা তাসনিম গত ২৭ নভেম্বর লন্ডনে অনুষ্ঠিত ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম অর্গানাইজেশনের ৩৩তম অধিবেশনের প্রথম সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন। এই প্রথমবার বাংলাদেশ এবং এর একজন কূটনীতিক ১৭৫টি সদস্য রাষ্ট্র নিয়ে গঠিত মর্যাদাপূর্ণ আইএমও সাধারণ পরিষদের সর্বোচ্চ পদে নির্বাচিত হয়েছেন।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্বাচন : সায়মা ওয়াজেদ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আঞ্চলিক পরিচালকের নির্বাচনে জয়ী হয়েছেন। ১ নভেম্বর বাংলাদেশ, ভুটান, ডেমোক্রেটিক পিপলস রিপাবলিক অফ কোরিয়া, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, মালদ্বীপ, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড এবং তিমুর ভোটগ্রহণে অংশগ্রহন করে।
সদস্য দেশগুলোর মধ্যে আটটি দেশ সায়মা ওয়াজেদকে মনোনীত করার পক্ষে ভোট দেয়। দুটি ভোট পান নেপাল মনোনীত ডা. শম্ভু প্রসাদ আচার্য্য। নবনিযুক্ত আঞ্চলিক পরিচালক সায়মা ওয়াজেদ আগামী ১ ফেব্রুয়ারি পাঁচ বছরের মেয়াদে দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং পরবর্তীতে আরেকবার পুনরায় নিয়োগের যোগ্য হবেন। প্রসঙ্গত, সায়মা ওয়াজেদ প্রথম বাংলাদেশি যিনি ১৯৪৮ সালে গঠিত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আঞ্চলিক বিভাগের এই পদে অধিষ্ঠিত হন।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা : বাংলাদেশ সর্বসম্মতভাবে ২০২৪ সালের ১ জুলাই থেকে ২০২৭ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত তিন বছরের জন্য এশিয়া অঞ্চল থেকে টানা দ্বিতীয় মেয়াদে খাদ্য ও কৃষি সংস্থার কাউন্সিলের সদস্য নির্বাচিত হয়েছে। পূর্বে বাংলাদেশর ১ জুলাই ২০২২ থেকে ৩০ জুন, ২০২৪ মেয়াদের জন্য সম্মেলনের ৪২তম অধিবেশনে খাদ্য ও কৃষি সংস্থার সদস্য হিসাবে নির্বাচিত হয়েছিল।
দ্বিতীয় মেয়াদে খাদ্য ও কৃষি সংস্থার কাউন্সিলের সদস্য হিসাবে, অন্যান্য কাউন্সিল সদস্যদের সাথে বাংলাদেশ নীতি ও নির্বাহী উভয় স্তরেই সংগঠনটিকে নেতৃত্ব দেবে। দক্ষিণ এশীয় দেশটি কর্মসূচি ও বাজেট বাস্তবায়ন, নতুন ফলাফল-ভিত্তিক কাঠামোর অধীনে কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ, প্রশাসনিক সিদ্ধান্তের বাস্তবায়ন পর্যবেক্ষণ এবং তিন বছরের জন্য সংস্থার প্রশাসনের তদারকি সম্পর্কিত বিষয়ে সিদ্ধান্ত ও পরামর্শ দেওয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
বিভিন্ন বহুপাক্ষিক পরিষদে নিয়মিত অংশগ্রহণ এবং নতুন সংস্থায় যোগদান ছাড়াও, আন্তর্জাতিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালনকারী এসব সংস্থার নির্বাচনে জয়লাভ ইঙ্গিত দেয় যে বাংলাদেশ তার বৈদেশিক নীতির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অনুযায়ী বৈশ্বিক ফোরামগুলিকে চিহ্নিত করে ও অগ্রাধিকার দেয়। বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও মানবাধিকার নিয়ে পশ্চিমা দেশগুলোর মিথ্যা সমালোচনার মধ্যে এই নির্বাচনি বিজয়গুলো সার্বিক উন্নয়নের অগ্রগতির একটি প্রমাণ। এই জয় আরোও প্রমাণ করে যে, বাংলাদেশের ফরেন পলিসি এবং এজেন্ডা নির্ধারকের ভূমিকা গ্রহণের এক নতুন যুগে প্রবেশ করেছে। শুধু তাই নয়, এসব ফোরামে নির্বাচিত হওয়া প্রমাণ করে যে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় আমাদের প্রচেষ্টাকে লক্ষ্য করছে এবং সে অনুযায়ী কঠোর পরিশ্রমের স্বীকৃতি দিচ্ছে।
লেখক : গবেষক ও কলামিস্ট