ব্যর্থতা থেকে সফলতার গল্প আছে, ব্যর্থতা থেকে সফলতার অনেক উক্তি আছে, ব্যর্থতা থেকে সফলতার উপায় আছে। তবুও মানুষ ব্যর্থ হয় কেন? মানুষ ব্যর্থ হয় তার যোগ্যতা নেই বলে নয়, সে যোগ্যতা অর্জন করতে চায় না বলে। কারণ যোগ্যতা অর্জন করতে কঠোর পরিশ্রম লাগে, সে সেই কঠোর পরিশ্রম করতে চায় না।
মানুষকে উঠে দাঁড়াতে একসময় পাঁচ লক্ষ বছর লেগেছিল, এখনকার কালে একটি শিশুর উঠে দাঁড়াতে একবছর লাগে, কিন্তু পশুরা জন্মের সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়ায়। মানুষও তাই চায়, সে জন্মের সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়াক। সে পড়াশোনার পিছনে সময় দিতে চায় না। সে বাহুবলে ত্রিপাদভূমি জয় করতে চায়, মনোবলে নয়। সে টাকা দিয়ে চাকরি কিনতে চায়, কারণ প্রতিযোগিতার জন্য পরিশ্রম আর মনোবলের প্রয়োজন হয়। সে সমাজে কোনো অবদান রাখতে চায় না, শুধু অনুদান পেলেই সে খুশি। সে জানে এখন মগজের শক্তির চেয়ে পেশির শক্তিকেই লোকে পুজো করে। জাদুকরদের মতো পাঁচ মিনিটে গাছ তৈরি করে ফল ফলায়। শূন্য বাক্স ভরে ওঠে।
তবু বলব, কঠোর পরিশ্রম করার এখনই ঠিক সময়। কারণ, সত্যিকারের কলাগাছ একবছর বাঁচলেও তার জন্ম বৃথা নয়, কারণ সে অন্তত একবার ফল দিয়ে মারা যায়। আঙুল ফুলে যে কলাগাছ হয়, তাতে একবারও ফল হয় না। আপনার সন্তানদের ফেলুদা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে ইতিহাস ও জীবনী পড়তে দিন। না পড়তে চাইলে আপনি মুখে মুখে তাদের শোনান। জন্মগত প্রতিভা থাকলেও তার বিকাশের জন্য স্ব-উদ্যোগ লাগে। আর উদ্যোগ মানে পরিশ্রম, কঠোর পরিশ্রম। চারপাশে পেশির আস্ফালন দেখে বিচলিত হবেন না। টাকার ঝংকার কে নুপুরের নিক্কণ বলে মনে করবেন না। শুধু ভোগ দেখার জন্য মলে যাবেন না। রোগ দেখার জন্যও অভিজাতদের নার্সিংহোমগুলোতে যান। এতদিন যারা ক্লাব, বার, পাঁচতারা রেস্তরাঁ আলো করে থাকতেন, আজ তারাই এই সব পাঁচতারা নার্সিংহোম আলো করে শুয়ে আছেন।
বাংলার ইতিহাস অনেক পতন অভ্যুদয় দেখেছে। সপ্তম শতকে শশাঙ্ক মারা গেলে ১০০ বছর ধরে বাংলায় কোনো আইনের শাসন ছিল না। বিনাপরিশ্রমে সবাই ধনী ও প্রভাবশালী হয়ে উঠেছিল। এক একজন একমাসের জন্যও রাজা হয়েছিল। কেউ হয়েছিল ছ’মাসের জন্য। স্থায়ী সরকার না হলে দেশ যে রসাতলে যায়, বাংলা একশো বছর ধরে দেখেছে। কিন্তু যোগ্য উত্তরাধিকারীর অভাবে না। ৪০০ বছর রাজত্ব করেও পালেরা শেষ হয়ে গেল। ধর্মপাল ও দেবপালের সময় বাংলা অর্ধেক ভারতের অধিপতি হয়েছিল। সেই পাল সাম্রাজ্য কর্ণাটক থেকে আসা সেনেদের হাতে চলে গেল কেন? তুর্কিরা ভারত অধিকার করতে পারল জয়চন্দ্রের বিশ্বাসঘাতকতায়। কিন্তু বখতিয়ার খলজির বাংলা দখলের পিছনে কারো বিশ্বাসঘাতকতা ছিল না। ছিল শিথিল প্রশাসন, জনগণের সঙ্গে রাজার দূরত্ব, আর বুদ্ধিজীবীদের নেতিবাচক ভূমিকা। তুর্কিরা আসছে শুনেই নবদ্বীপের পণ্ডিতেরা পালিয়ে যেতে শুরু করেছিলেন, অথচ নিরীহ দলিত ও গরিব মানুষদের তারাই ঘৃণা করতেন। সমাজকে নানা ফতোয়া দিতেন। তুর্কি আর মোগলরা সারা ভারতকে ধর্মান্তরিত করতে চেয়েছিল। প্রায় সাতশো বছর ধরে চেষ্টা করেও পারেনি।
ইতিহাস ও দেশের রাজনীতি নিজের পথ ধরে চলে। কিন্তু ইতিহাস একটি দেয়াল। এই দেয়ালে লেখা- ‘রাজা হোক, প্রজা হোক, যে যেমন পরিশ্রম করবে, তেমনি ফল পাবে।’ তবে পরিকল্পিত পরিশ্রম চাই। খুন করেও বহু লোক বিনাপরিশ্রমে রাজা হয়েছেন। অসংখ্য রাজার নাম ইতিহাসে নেই। কিন্তু অসংখ্য সাধারণ মানুষের জন্য আলাদা ইতিহাস লেখা হয়েছে, যারা শূন্য থেকে শিখরে উঠেছেন নিজের যোগ্যতায়, কঠোর পরিশ্রমে, আন্তরিক নিষ্ঠায়। এদের ইতিহাস স্কুলে পড়াবে না, আপনাকেই পড়াতে হবে। ইতিহাসে লেখা না হলেও আপনি যে এক সৎ পরিশ্রমী খেটে খাওয়া মানুষ, এই কথা আপনার পারিবারিক ইতিহাসে বড়ো বড়ো করে লিখে যান। আপনার বংশধরেরা সরকারের কাছে চট করে হাত পাততে লজ্জা পাবে। যদি তার সুস্থ দুটি হাত থাকে।
লেখক : আওয়ামী লীগ নেতা ও চেয়ারম্যান, শের-ই-বাংলা ফাউন্ডেশন