পাহাড় থেকে নেমে আসা উজানি ঢলে ও টানা বৃষ্টিতে সিলেটের পর এবার সুনামগঞ্জ, বংপুর, মৌলিভীবাজারের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হচ্ছে। পানি বেড়ে এসব জেলায় লাখ লাখ মানুষ এখন পানিবন্দি অবস্থায় আছেন। রংপুরের প্রধান নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে; মৌলভীবাজারের ছয় উপজেলার ৩৭ ইউনিয়নের ৩৩২টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এরইমধ্যে কাউনিয়া পয়েন্টে তিস্তা নদীর পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করছে। এদিকে কক্সবাজারের টেকনাফ-সেন্টমার্টিনসহ ৫টি ইউনিয়নের প্রায় ২০ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।
সুনামগঞ্জ : বুধবার সকাল থেকে বৃষ্টি হওয়ায় আবারও বাড়ছে পানি। ঢলের পানিতে ডুবছে শহর ও লোকালয়। সুনামগঞ্জ শহরের সাত হাজার বসতঘরের নিচতলায় বানের পানি ঢুকেছে। এদিকে, আগামী আরও ছয় দিন ভারী বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা আছে বলে জানিয়েছেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী। বুধবার সকালের ভারী বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে হু হু করে বাড়ছে নদী ও হাওরের পানি। গত ২৪ ঘণ্টায় ১০০ মিলিমিটার বৃষ্টি রেকর্ড করেছে পাউবো। সুরমা নদীর পানি বিপৎসীমার ৪০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। দিরাই ও ছাতক পয়েন্টে সুরমা নদীর পানি বিপৎসীমার ওপরে রয়েছে।
দেখার হাওর ও সুরমা নদীর পানি বেড়ে সুনামগঞ্জ পৌরসভার ৯টি ওয়ার্ড পানিতে নিমজ্জিত হয়ে আছে। সরকারি বেসরকারি অফিসের নিচতলা নিমজ্জিত হয়ে আছে। শহরের হাজীপাড়া এলাকায় পুলিশ সুপারের কার্যালয়, গণপূর্ত অধিদফতর বিএডিসি সেচ অফিস প্লাবিত হয়েছে। শহরের নুতনপাড়া, শান্তিবাগ, মরাটিলা, ষোলঘর, হাজিপাড়া, মল্লিকপুর কালীপুর বিলপাড়সহ পুরো শহরের নিম্নাঞ্চলের বাসাবাড়ি নিচতলায় পানিতে ডুবে আছে। বৃষ্টিপাত চলছে।
খাসিয়ামারা, চলতি পিয়াইন রক্তি, সোনালি চেলা, সোমেশ্বরী, পাটলাই নদীসহ আট সীমান্ত নদী দিয়ে পাহাড়ি ঢলের পানি প্রবাহিত হচ্ছে। জেলার সুনামগঞ্জ সদর, দোয়ায়ারাবাজার, ছাতক, বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার বন্যা পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে। সুনামগঞ্জ সদর, ছাতক দোয়ারাবাজার সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। জেলায় ৫১৬টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। শুকনো খাবার ও রান্না করা খাবার বিতরণ করা হচ্ছে আশ্রয়কেন্দ্রে।
রংপুর : উজান থেকে নেমে আসা ঢলে রংপুরের প্রধান নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। এরইমধ্যে কাউনিয়া পয়েন্টে তিস্তা নদীর পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করছে। অন্য নদ-নদীর পানি বেড়েই চলেছে।
এতে নদ-নদীর তীরবর্তী নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। এছাড়া আগামী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে রংপুরের নিম্নাঞ্চলে স্বল্পমেয়াদি বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে বলে জানিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) বন্যার পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র।
এদিকে পানি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে জেলার কাউনিয়া, পীরগাছা ও গঙ্গাচড়া উপজেলার তিস্তা অববাহিকার বেশ কয়েকটি এলাকায় ভাঙন শুরু হয়েছে। পাউবো কোনো প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা না নেওয়ায় ভাঙনকবলিত পরিবারগুলোর অনেকে নিরুপায় হয়ে বসতি সরিয়ে নিচ্ছে। বেশ কিছু চরাঞ্চলের বাড়িঘরের চারপাশে পানি প্রবেশ করার খবর পাওয়া গেছে।
তলিয়ে গেছে গ্রামীণ সড়ক। ডুবে গেছে ওইসব এলাকার সবজিক্ষেত। ভাঙনের কিনারে নিরুপায় দিনযাপন করছে অনেক দিনমজুর পরিবার। জরুরি ভিত্তিতে ভাঙন প্রতিরোধের ব্যবস্থা নেওয়া না হলে তারা সর্বস্বান্ত হয়ে পড়বে বলে জানিয়েছে ভুক্তভোগী পরিবারগুলো।
পাউবোর নিয়ন্ত্রণকক্ষ জানায়, রংপুর জেলার সব নদ-নদীর পানি বাড়ছে। মঙ্গলবার রাত থেকে বুধবার সকাল ৯টা পর্যন্ত গত ২৪ ঘণ্টায় রংপুর অঞ্চলে ২২১ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। বুধবার সকাল নয়টায় তিস্তার কাউনিয়া পয়েন্টে শূন্য দশমিক ২০ সেন্টিমিটার পানি প্রবাহ বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। এর আগে ভোর ছয়টায় ওই পয়েন্টে পানি প্রবাহ বিপৎসীমার ১৫ সেন্টিমিটার ওপরে ছিল। কাউনিয়া পয়েন্টে বিপৎসীমা ২৮ দশমিক ৭৫ সেন্টিমিটার ধরা হয়।
অপরদিকে দেশের বৃহত্তম সেচ প্রকল্প তিস্তা ব্যারেজের ডালিয়া পয়েন্টে বুধবার সকাল নয়টায় পানি প্রবাহ রেকর্ড করা হয় ৫১ দশমিক ৯২ সেন্টিমিটার, যা বিপৎসীমার শূন্য দশমিক ২৩ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হয়। সকাল ৬টায় যা রেকর্ড করা হয় ৫১ দশমিক ৯৫ সেন্টিমিটার। এ পয়েন্টে ৫২ দশমিক ১৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হলে বিপৎসীমা অতিক্রম করে। সূত্র বলছে, গত ২৪ ঘণ্টায় ডালিয়া পয়েন্টে ১২০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। তিস্তার পানি বেড়ে ক্রমশ বিপৎসীমার পথে রয়েছে।
এদিকে তিস্তাসহ অন্যান্য নদ-নদীর পানি বৃদ্ধির কারণে লালমনিরহাট সদর, জেলার পাটগ্রাম, হাতিবান্ধা, কালিগঞ্জ, আদিতমারী, নীলফামারীর ডিমলা, জলঢাকা, রংপুরের গঙ্গাচড়া, কাউনিয়া, পীরগাছা, কুড়িগ্রামের রাজারহাট, উলিপুর এবং গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার তিস্তা অববাহিকার চরাঞ্চল ও নিম্নাঞ্চল পানিতে নিমজ্জিত হচ্ছে। কিছু কিছু এলাকায় বাদাম, শাক-সবজিসহ বিভিন্ন ফসল পানিতে তলিয়েছে।
রংপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী রবিউল ইসলাম বলেন, উজানের ঢল আর গত কয়েকদিন ধরে বৃষ্টিপাতের কারণে ডালিয়া ও কাউনিয়া পয়েন্টে তিস্তায় পানি বাড়তে শুরু করেছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে ডালিয়া ব্যারেজের সবকটি গেইট খুলে রাখা হয়েছে। কাউনিয়া পয়েন্টে কিছুটা বাড়ছে পানি প্রবাহ। এছাড়া ভাটির অঞ্চলে সার্বক্ষণিক নদীপাড়ের পরিস্থিতির খোঁজখবর রাখা হচ্ছে।
রংপুরের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মোবাশ্বের হাসান বলেন, বন্যা মোকাবিলায় মাঠ পর্যায়ে উপজেলা প্রশাসনকে প্রস্তুত রাখা হয়েছে। সম্ভাব্য সব ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। নদী তীরবর্তী নিম্নাঞ্চল ও চরে থাকা মানুষজনকে নিরাপদে থাকার জন্য পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
মৌলভীবাজার : মৌলভীবাজারের ছয় উপজেলার ৩৭ ইউনিয়নের ৩৩২টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এতে এক লাখ ৯৩ হাজার ৯৯০ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত উপজেলাগুলোর মধ্যে বড়লেখার ১০টি, জুড়ীর ছয়টি, কুলাউড়ার ছয়টি, সদরের চারটি ও রাজনগর উপজেলার ছয়টি ইউনিয়ন, শ্রীমঙ্গল পাঁচটি ইউনিয়ন প্লাবিত হয়।
মৌলভীবাজার জেলা প্রশাসক উর্মি বিনতে সালাম বুধবার (১৯ জুন) সকালে জানিয়েছেন, জেলার ৬টি উপজেলায় মোট ৯৮টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে। এরমধ্যে ৫৭১টি পরিবার আশ্রয় নিয়েছেন। ৫৬টি মেডিক্যাল টিম প্রস্তুত রয়েছে।
গত ২৪ ঘণ্টায় পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় পানিবন্দি লোকদের উদ্ধারের লক্ষ্যে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ হতে প্রয়োজনীয় তৎপরতা চালানো হচ্ছে। বন্যার সার্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের জন্য জেলা প্রশাসকের কার্যালয় এবং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কার্যালয়গুলোতে কন্ট্রোলরুম স্থাপন করা হয়েছে।
মৌলভীবাজার পওর বিভাগ, বাপাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী জাবেদ ইকবাল জানান, বুধবার সকাল ৯টায় ধলাই নদী (রেলওয়ে ব্রিজ) এলাকায় পানি বিপৎসীমার ২৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। আর মনু নদী (চাঁদনীঘাট) এলাকায় পানি বিপৎসীমার আট সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে ও জুড়ী নদীর পানি বিপদসীমার ১৯৯ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। কুশিয়ারা নদীর (শেরপুর) পানি বিপদসীমার ১২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
টেকনাফ-সেন্টমার্টিন : কক্সবাজারের টেকনাফ-সেন্টমার্টিনসহ ৫টি ইউনিয়নের প্রায় ২০ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। তলিয়ে গেছে চিংড়ি ঘের, লবণ মাঠ, খেতের জমি। বুধবার (১৯ জুন) বিষয়টি জানিয়েছেন সিপিপির টেকনাফ উপজেলা টিম লিডার কাইসার উদ্দিন চৌধুরী।