রাজা চার্লস ও প্রিন্সেস ডায়নার লিগ্যাসি এখনো বৃটিশ রাজপরিবারে বহমান। তাদের সন্তান প্রিন্স উইলিয়াম ও প্রিন্স হ্যারি প্রয়াত মা ডায়না ও দাদি রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা প্রকাশের এক অনন্য নজির দেখিয়েছেন। বাবা-মায়ের বিচ্ছেদের পরেও কোথাও কোনোভাবেই উপেক্ষিত হয়নি শ্রদ্ধা-ভালোবাসার এ দিকটি।
প্রিন্সেস ডায়না ১৯৯৭ সালে তার মৃত্যুর পরেও তিনি একটি মহান উত্তরাধিকার রেখে গেছেন। ডায়না ১৯৮১ সালের জুলাইয়ে ইংল্যান্ডের রাজপরিবারে বিয়ে করেন। রাজা চার্লস (তখন প্রিন্স চার্লস)-ডায়না দম্পতির কোলজুড়ে ১৯৮২ সালে প্রিন্স উইলিয়াম ও দু’বছর পরে প্রিন্স হ্যারির জন্মলাভে বৃটিশ রাজ সিংহাসনে উত্তরাধিকার পাকাপোক্ত হয়। ডায়ানা ১৯৮২ সালে প্রিন্স উইলিয়াম এবং দুই বছর পর প্রিন্স হ্যারিকে জন্ম দেন। চার্লস-ডায়নার ১৫ বছরের দাম্পত্য কলহে পারস্পরিক অবিশ্বাস ও অবিশ্বস্ততা ছিল বলেই ১৯৯২ সালে ডিসেম্বরে বিচ্ছেদ ঘটে তাদের যৌথ জীবনাচরণের।
ডায়না-চার্লসের বিয়ে-বিচ্ছেদ ১৯৯৬ সালের আগস্টে চূড়ান্ত হয়। ডায়না ডোডি ফায়েদের সঙ্গে চলে যান। ফটোগ্রাফারদের তাড়ায় প্যারিসে গাড়ি দুর্ঘটনায় ১৯৯৭ সালের ৩১ আগস্টে ডায়নার মৃত্যু হয়। ফায়েদ ও গাড়িরচালক হেনরি পলও নিহত হন। তখন উইলিয়ামের বয়স ছিল ১৫ বছর, হ্যারি ১২ বছরের। ডায়নার মৃত্যু হলেও তার লিগ্যাসি জীবিত। উভয় রাজকুমারই রাজকন্যাদের নাম রেখেছেন তাদের প্রয়াত মায়ের নামানুসারে। একই সঙ্গে তারা তাদের দাদি রানি এলিজাবেথের নামও যুক্ত করতে ভোলেননি। উইলিয়াম-কেট দম্পতি তাদের কন্যার নাম রাখেন শার্লট এলিজাবেথ ডায়না। হ্যারি-মেগান দম্পতি তাদের কন্যার নাম রাখেন ‘লিলি’ ডায়ানা। উইলিয়াম-হ্যারির দাদি রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের ডাকনাম ছিল লিলিবেট। একই সঙ্গে তারা তাদের মা ও দাদির প্রতি সম্মান দেখিয়েছেন।
(ডায়নার মৃত্যু হলেও তার লিগ্যাসি জীবিত। উভয় রাজকুমারই রাজকন্যাদের নাম রেখেছেন তাদের প্রয়াত মায়ের নামানুসারে। একই সঙ্গে তারা তাদের দাদি রানি এলিজাবেথের নামও যুক্ত করতে ভোলেননি। উইলিয়াম-কেট দম্পতি তাদের কন্যার নাম রাখেন শার্লট এলিজাবেথ ডায়না। হ্যারি-মেগান দম্পতি তাদের কন্যার নাম রাখেন ‘লিলি’ ডায়ানা। উইলিয়াম-হ্যারির দাদি রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের ডাকনাম ছিল লিলিবেট। একই সঙ্গে তারা তাদের মা ও দাদির প্রতি সম্মান দেখিয়েছেন)
ডায়নার জন্ম ১৯৬১ সালের পহেলা জুলাই স্যান্ড্রিংহামে। বাবা জন ও মা ফ্রান্সেস স্পেন্সারের কোলে দ্যুতি নিয়ে জন্মেন এ ক্ষণজন্মা নারী। বড় বোন সারা ও জেন, ভাই চার্লস ও জনসহ পাঁচ সন্তানের মধ্যে ডায়না ছিলেন চতুর্থ। সবচেয়ে ছোটটি শিশুকালেই মারা যায়। রাজ পরিবারে যাওয়ার আগে সত্তর দশকে ডায়না কিন্ডারগার্টেন স্কুলে শিক্ষা সহকারী হিসেবে কাজ করতেন। ১৯৭৭ সালের নভেম্বরে ডায়না সঙ্গে প্রথমবারে চার্লসের সঙ্গে দেখা হয়। সে সময় তার বয়স ছিল ষোল। এ সময় চার্লস ডায়নার বোন সারার সঙ্গে ডেটিং করছিলেন। ১৯৮০ সালে ডায়নার প্রতি আগ্রহী হন চার্লস। এ সময় ডায়না তাকে পোলো খেলতে দেখেছিলেন। তারা শীঘ্রই তাদের সম্পর্ক শুরু করেন।
চার্লস-ডায়নার ১৩ বছরের বয়সের পার্থক্য সত্ত্বেও ১৯৮১ সালের ফেব্রুয়ারিতে ডায়ানকে প্রস্তাব দেন চার্লস। এ জুটি ১৯৮১ সালের জুলাই মাসে সেন্ট পলস ক্যাথেড্রালে তাদের গাঁটছড়া বাঁধেন। ডায়না তার প্রথম গর্ভাবস্থার ঘোষণা করেন ১৯৮১ সালের নভেম্বরে। প্রিন্স উইলিয়াম ১৯৮২ সালের জুন মাসে জন্মগ্রহণ করেন। ডায়ানা সেন্ট মেরিস হাসপাতালে তার বাচ্চা ছেলেকে বিশ্বের সামনে তুলে ধরেন। উইলিয়ামের স্ত্রী প্রিন্সেস কেট পরে ডায়নার পদাঙ্ক অনুসরণ করে প্রিন্স জর্জ, প্রিন্সেস শার্লট ও প্রিন্স লুইসকে এভাবে স্বাগত জানান।
চার্লস-ডায়না দম্পতি ১৯৮৩ সালে তাদের বিয়ের প্রথম দিকে নয় মাসের নবজাতক উইলিয়ামকে নিয়ে অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডে ভ্রমণে যান। এই পদক্ষেপটি সেই সময়ে রাজপরিবারে বিতর্কিত কাজ ছিল। কিন্তু রাজপরিবারের পরবর্তী প্রজন্মের জন্য এটি আরও স্বাভাবিক কাজ হয়ে উঠেছে। প্রিন্স হ্যারি ১৯৮৪ সালের সেপ্টেম্বরে জন্মগ্রহণ করেন। ডায়না হাসপাতালে উইলিয়ামকে যেভাবে দেখিয়েছেন, এ দেখানোর ক্ষেত্রে প্রিন্স হ্যারির বেলায়ও একই দৃশ্য দেখা গেছে। ডায়না এক্ষেত্রেও কোনো ব্যত্যয় ঘটাননি।
ডায়না খুব অনানুষ্ঠানিক ছিলেন, সত্যিই হাসি-মজা উপভোগ করতেন। উইলিয়ামের ২০১৭ সালে প্রকাশিত ‘ডায়ানা, আওয়ার মাদার : হার লাইফ অ্যান্ড লিগ্যাসি’তে এ দিকটি প্রতিফলিত হয়েছে। উইলিয়য়াম তার মা সম্পর্কে অকপটে মন্তব্য করেন,‘তিনি একজন অন্যতম দুষ্টু মা ছিলেন। অবশেষে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন- প্রাসাদের দেয়ালের বাইরেও একটি বাস্তব জীবন রয়েছে।’
ডায়না-চার্লসের বিচ্ছেদ ১৯৯২ সালের ডিসেম্বরে জনসম্মুখে প্রকাশ পায়। ২০১৮ সালের বই ‘চার্লস অ্যাট সেভেন্টি : থটস, হোপস অ্যান্ড ড্রিম ’ দাবি করেছে রাজপুত্র চার্লস ‘মরিয়া হয়ে’ এ সম্পর্ক ছেড়ে যেতে চেয়েছিলেন; তিনি আবিষ্কার করলেন ঠিক কতটা ভয়ঙ্কর ছিল তার ভবিষ্যৎ, ডায়ানাকে আগে থেকে জানার আর কোনো সুযোগ ছিল না। ডায়না তার সন্তানদের স্বাভাবিক লালন-পালনের চেষ্টা করেছিলেন। ডায়না ১৯৯৩ সালের এপ্রিলে রাজকুমারদের সঙ্গে থর্প পার্ক পরিদর্শন করেন। রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ তাদের বিচ্ছেদকে অনুমোদন দেওয়ার পর চার্লস-ডায়না ১৯৯৬ সালের আগস্টে তাদের বিয়ে-বিচ্ছেদ চূড়ান্ত করেন। ডায়না তার বিচ্ছেদের পরে চ্যারিটেবল কাজের প্রতি তার প্রতিশ্রুতি বজায় রেখেছিলেন। তিনি ১৯৯৭ সালের জানুয়ারিতে অ্যাঙ্গোলার খনি এলাকাগুলোতে চ্যারিটেবল কাজের জন্য বহু পথ হেঁটেছেন। হ্যারি তার প্রয়াত মায়ের কাছ থেকে অনুপ্রেরণা পাওয়ার এ দিকটি রপ্ত করেছেন। তিনি ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে মিরর (যুক্তরাজ্য) পত্রিকায় বলেন, ‘এটি সমান গুরুত্বপূর্ণ, যদি নাও হয়, তাহলেও পর্দার আড়ালে কাজ করা। আমার মা অনেক কাজ করেছেন যা থেকে শেখার, অভিজ্ঞতা লাভ করা এবং মানুষের জীবণাচরণ থেকে সত্যকে অনুধাবন করার দিক রয়েছে।’
ডায়না ১৯৯৭ সালের ৩১ আগস্ট প্যারিসে গাড়ি দুর্ঘটনায় মারা যান। বলা হয়ে থাকে, প্যারিসে পাপারাজ্জিকে এড়ানোর চেষ্টা করতে গিয়ে তার গাড়ি দুর্ঘটনায় কবলিত হয় । তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া ৬ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত হয়। ডায়নার মৃত্যুতে বিশ্বে আবেগ ও ভালবাসার এক করুণ বহিঃপ্রকাশ ঘটে। হ্যারি ২০১৭ সালে বলেছিলেন, এই দৃশ্য একই সময়ে সুন্দর ছিল। এখন এটির দিকে ফিরে তাকানোও আশ্চর্যজনক। আমি মনে করি, মায়ের বিশ্বের এত মানুষের উপর বড় ধরনের প্রভাব ছিল।
(উইলিয়য়াম তার মা সম্পর্কে অকপটে মন্তব্য করেন, ‘তিনি একজন অন্যতম দুষ্টু মা ছিলেন। অবশেষে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন- প্রাসাদের দেয়ালের বাইরেও একটি বাস্তব জীবন রয়েছে’)
ডায়নার মৃত্যুর প্রায় চব্বিশ বছর পর ২০২১ সালের পহেলা জুলাই কেনসিংটন প্যালেসের সানকেন গার্ডেনে তার একটি ভাস্কর্য স্থাপনের মধ্য দিয়ে তাকে অমরত্ব দেওয়া হয়। ডায়ানার দুই ছেলে উইলিয়াম ও হ্যারি তার ষাটতম জন্মদিনে তাদের মাকে শ্রদ্ধা জানাতে লন্ডনে একত্রিত হন। যৌথ বিবৃতিতে তারা দুই ভাই বলেন, আমরা তার ভালবাসা, শক্তি ও সত্তার কথা স্মরণ করি। সারাবিশ্বের কল্যাণের জন্য মায়ের গুণাবলী তার মধ্যে একটি শক্তির সঞ্চার করেছে যা অগণিত মানুষের জীবনকে পরিবর্তনের মাধ্যমে উন্নত করেছে। আমরা মনে করি, তিনি এখনও আমাদের সঙ্গে আছেন। আমাদের আশা- এই ভাস্কর্য চিরকাল তার জীবন এবং তার উত্তরাধিকারের প্রতীক হিসেবে দেখা হবে।
(ডায়নার চিঠিগুলোর একটিতে লেখা ছিল- ‘আমি আমার স্বাধীনতা পেয়ে বেশি খুশি। আমি মনে করি, দ্বিতীয় সুযোগ পেয়ে আমি খুবই ভাগ্যবান। আমার পথে এসেছে অনেক সুন্দর জিনিস; এটা মজার… কে ভেবেছিল!’)
২০২৩ সালে হ্যারি স্মৃতিকথা ‘স্পেয়ার’-এ উল্লেখ করেন, তার মা তার স্ত্রী মেঘানের প্রথম গর্ভাবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে ডায়না আবারও শিরোনামে উঠে। বন্ধু সুসি ও তারেক কাসেমকে লেখা তার চিঠির সংগ্রহ নিলামে বিক্রি হয়। ডায়নার সেই চিঠিগুলোর বিক্রির অর্থও মানবতার কল্যাণে ব্যয় হয়। ডায়নার চিঠিগুলোর একটিতে লেখা ছিল- ‘আমি আমার স্বাধীনতা পেয়ে বেশি খুশি। আমি মনে করি, দ্বিতীয় সুযোগ পেয়ে আমি খুবই ভাগ্যবান। আমার পথে এসেছে অনেক সুন্দর জিনিস; এটা মজার… কে ভেবেছিল!’
সূত্র : বিদেশি ইংরেজি পত্রিকা থেকে, অনুবাদ : ইমামুল ইসলাম