শিক্ষার্থীদের মুক্তচিন্তা, ভাব ও ইচ্ছার স্বাধীনতা প্রদানের মধ্য দিয়ে শিক্ষাগ্রহণ সুযোগ সৃষ্টিই হচ্ছে রবীন্দ্রনাথের শিক্ষা দর্শনের মূল বক্তব্য। সর্বজনীন শিক্ষা বা সবার জন্য শিক্ষা প্রবর্তনেও রবীন্দ্রনাথ অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেন। মানব সংস্কৃতির বিকাশ, প্রসার ও উন্নয়নে অগ্রগামী পন্থা হিসেবে উপযুক্ত শিক্ষা ব্যবস্থা নির্ধারণকেই মনে করতেন রবীন্দ্রনাথ। প্রচলিত শিক্ষার আয়োজনকে তিনি কখনো আদর্শ শিক্ষার আয়োজন হিসেবে স্বীকৃতি দেননি। রবীন্দ্রনাথ ব্যক্তিগত জীবনে অর্থাৎ শৈশবকালের শিক্ষা গ্রহণের কষ্টকর অভিজ্ঞতার বেদনা তাঁর অনেক প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন। এই অভিজ্ঞতা থেকে বিভিন্ন দেশের শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষাদর্শন সম্পর্কে পড়াশোনা করেন। এবং এসব জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার সঙ্গে আত্মদর্শন, বৈজ্ঞানিক ও নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গির গবেষণায় রচিত করেছেন শিক্ষাদর্শনের ভিত্তি।
রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাদর্শন : রবীন্দ্রনাথ শিক্ষা গ্রহণে শিক্ষার্থীদের স্বাধীন ইচ্ছা প্রকাশের উপর ভীষণ গুরুত্ব দিয়েছেন। বিশেষ করে শিক্ষা গ্রহণের পরিবেশ বা শিক্ষার আয়োজন হবে শিক্ষার্থীদের নিকট আনন্দদায়ক, মনোমুগ্ধকর। শিক্ষার্থী যাতে শিক্ষা গ্রহণের বিষয়টিকে বাধ্য মনে না করে। রবীন্দ্রনাথের মতে বাহ্যিক শক্তির প্রয়োগ কিংবা বাধ্য প্রক্রিয়া শিক্ষা গ্রহণ হয় না। শিক্ষাকে সহজাত প্রক্রিয়ায় শিক্ষার্থীদের নিকট উপস্থাপন করতে হবে। শিক্ষার্থীর মাতৃভাষার মাধ্যমে মুক্ত প্রাকৃতিক পরিবেশে শিক্ষাদান করতে হবে। অর্থাৎ সকল শিক্ষার্থীর নিজস্ব মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের কথা বলেছেন। যাতে শিক্ষার্থী চাপমুক্ত হয়ে নিজস্ব ভাষায় স্বাধীন প্রক্রিয়ায় জ্ঞান চর্চা করতে আগ্রহী হয়ে উড়তে পারে। পাশাপাশি শিক্ষার্থীর খেলা ও শারীর চর্চার উপর গুরুত্ব তৈরির কথাও উল্লেখ করেছেন। শিক্ষার্থীর খেলা ও শারীর চর্চাকেও শিক্ষার বিশেষ অংশ হিসেবে রবীন্দ্রনাথ তুলে ধরেছেন। রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাস করতেন মুক্ত পরিবেশে শিক্ষা গ্রহণ পদ্ধতি শিক্ষার্থীর মনের ও ব্যক্তিত্বের পূর্ণ বিকাশ এবং সচল করতে সাহায্য করে।
শিক্ষার ক্ষেত্রে স্বাধীনতা : রবীন্দ্রনাথ শিক্ষা ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের জন্য স্বাধীন পরিবেশ নিশ্চিতে গুরুত্ব দিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথের মতে শিক্ষার্থী যখন স্বাধীন পরিবেশের স্পর্শ পাই, স্বাধীনতার লক্ষ্যে শিক্ষার্থী আত্মকর্তৃত্ব অর্জন করে। যার ফলে শিক্ষার্থীর হৃদয়ে সৃষ্টির প্রতি প্রেরণা জাগিয়ে তুলতে পারে। তবে রবীন্দ্রনাথ এটিও পরিষ্কার করেছেন স্বাধীনতার অর্থ অবশ্যই শৃঙ্খলহীন জীবন যাপন নয়। স্বাধীনতার শৃঙ্খল ও সঠিক পদ্ধতির চর্চাকেই অনুশীলনের অংশ হিসেবে গুরুত্ব দিয়েছেন। অর্থাৎ সীমা আর অসীম, বন্ধন আর মুক্তি এ দুয়ের মাধ্যমে সত্যিকারের মনুষ্যত্বের বিকাশ সম্ভব। রবীন্দ্রনাথ তাই তার প্রতিষ্ঠিত শান্তি নিকেতনে শিক্ষার্থীদের একদিকে যেমন কঠোর নিয়ম শৃঙ্খলা মেনে চলতে হতো, অপর দিকে তাদের জন্য যথেষ্ট স্বাধীনতা ভোগ ও দায়িত্ব পালনের সুযোগ দেযা হতো।
শিক্ষাক্ষেত্রে বিজ্ঞান : রবীন্দ্রনাথ মতে বিজ্ঞান শিক্ষার মধ্য দিয়ে বিশ্বপ্রকৃতি ও বস্তু প্রকৃতি সম্বন্ধে জ্ঞান অর্জন করে বিচিত্র প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য উপলব্ধি করা যায়। আর সেই উপলব্ধিকে অনুভব করার একমাত্র মাধ্যম হলো বিজ্ঞান শিক্ষা অর্জন। তাই রবীন্দ্রনাথ শিক্ষায় বিজ্ঞান শিক্ষাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ মতে বিজ্ঞান শিক্ষার মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থী সৃষ্টি সম্পর্কে অবগত হয়, এবং উদ্ভাবিত মনন শিক্ষার্থীর ভেতর জাগ্রত হয়। শিক্ষার্থীকে প্রকৃতি ও বস্তুর সাথে মনোবৈজ্ঞানিক সম্পর্ক তৈরি করে দেয় বিজ্ঞান শিক্ষা। রবীন্দ্রনাথ শৈশব থেকে বিজ্ঞান শিক্ষার সাথে জড়িত ছিল । বারো বছর বয়সে লিখেছিলেন প্রথম বিজ্ঞান বিষয়ক রচনা ‘ভারতবর্ষীয় জ্যোতিষশাস্ত্র’। রবীন্দ্রনাথের অগ্রজ সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পত্নী জ্ঞানদানন্দিনী দেবী ঠাকুরবাড়ি থেকে শিশু-কিশোরদের জন্য ‘বালক’ নামে একটি পত্রিকা সম্পাদনা করতেন। রবীন্দ্রনাথ সে পত্রিকায় পদার্থবিদ্যা, জ্যোর্তিবিদ্যা ও ভূবিদ্যা প্রভৃতি বিজ্ঞান বিষয়ে শিশু-কিশোর উপযোগী লেখা দিতেন।
শিক্ষাক্ষেত্রে সাহিত্য : জ্ঞান আহরণের সাথে হৃদয়ের উৎকর্ষ সাধন ও শিক্ষার অন্যতম লক্ষ। রবীন্দ্রনাথ তাই শিক্ষা ক্ষেত্রে সাহিত্য, শিল্প ও লালিত কলা প্রভৃতি বিষয় অন্তর্ভুক্ত করার কথা বলেছেন। এতে শিক্ষার্থী সংস্কৃতি, ইতিহাস ও শিল্পের সাথে পরিচিত হতে পারে। এবং সেই পরিচিত চিন্তার মাধ্যমে নতুন সময়ে সংস্কৃতি, ইতিহাস ও শিল্প সম্পর্কে বিচার, বিশ্লেষণ করার শক্তি অর্জন করতে পারবে। রবীন্দ্রনাথের মতে এরূপ সমন্বিত শিক্ষা, শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিগত সুখবোধকে পরিবারবোধ, পরিবারবোধকে সমাজবোধ, সমাজবোধকে স্বদেশবোধ এবং স্বদেশবোধকে বিশ্ববোধে রুপান্তর করে। আর এই রুপান্তর প্রক্রিয়ায় শিক্ষার্থী সুষম বিকাশিত হয়।
প্রচলিত শিক্ষা : রবীন্দ্রনাথ প্রচলিত শিক্ষাকে শিক্ষার্থীর সৃষ্টিমূলক সৃজনে রুপান্তর করার জন্য বিশেষ আগ্রহী ছিল। রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন প্রচলিত শিক্ষা তখনই কার্যকর হয় যখন এই প্রচলিত শিক্ষার চর্চা নতুন সম্ভাবনার সৃষ্টি উদ্ভাবন ঘটায়। আর্থিক প্রয়োজনে শিক্ষাকে অপব্যবহার বা বিশেষ উদ্দেশ্য ব্যবহার করার প্রতি ছিলেন বিপক্ষে। রবীন্দ্রনাথের মতে কেবল আর্থিক প্রয়োজনকে কেন্দ্র করে শিক্ষার ব্যবহার অসৎ উদ্দেশ্যের প্রতি অনুগামী করে। শিক্ষার যথাযথ ব্যবহার ব্যাহত হয়। গঠনমূলক কাজ বা শিক্ষার সঠিক ব্যবহারে শিক্ষার্থীর শিক্ষার শক্তি প্রকাশিত হয় অর্থাৎ সৃষ্টির প্রকাশ ঘটে। আর সে সৃষ্টির সাহায্যে স্রষ্টার প্রকাশ ঘটে। এতে দু’টি সম্পর্কের সৃষ্টি ঘটে। একটির সম্পর্ক সমাজের সাথে, অন্যটি হৃদয়ের সাথে।
শিক্ষার উদ্দেশ্য : রবীন্দ্রনাথের মতে শিক্ষার অন্যতম উদ্দেশ্য হচ্ছে শিক্ষার্থীর আত্মবিশ্বাসকে জাগ্রত করা। এবং জাগ্রত আত্মবিশ্বাসের মাধ্যমে সৃষ্টির প্রকাশ ঘটানো। শিক্ষার্থীর সৃষ্টিই শিক্ষার যথাযথ প্রকাশ। শিক্ষার্থী যাতে যথাযথ চর্চা ও অনুশীলন করে নতুন সম্ভাবনার আবিষ্কার ঘটাতে পারে, সে জন্য রবীন্দ্রনাথ শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে বলেছেন “ তুমি কেরানীর চেয়ে বড়, ডেপুটি মুন্সেফের চেয়ে বড়। তুমি যাহা শিক্ষা করিতেছ তাহা হাওয়াইয়ের মতো কোনোক্রমে স্কুলের মাস্টারি পর্যন্ত উড়িয়া, তাহার পর পেনশনভোগী জরাজীর্ণতার মধ্যে ছাই হইয়া মাটিতে আসিয়া পড়িবার জন্য নহে”। অর্থাৎ শিক্ষাকে আহরণ করে স্রষ্টা রূপে সৃষ্টির নতুন প্রকাশ হিসেবে শিক্ষার্থীদের গড়বার জন্য অনুপ্রাণিত করেছেন।
শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর সম্পর্ক : শিক্ষার্থী ও শিক্ষকের সম্পর্কের ক্ষেত্রে আন্তরিক সুসম্পর্ক স্থাপনের উপর শিক্ষাদানের সার্থকতা নির্ভরশীল। এই আন্তরিক সুসম্পর্ক শিক্ষার উপকরণ, এই উপকরণ শিক্ষার্থী ও শিক্ষক উভয়ের নিকট সমান ভাবে নিয়োজিত থাকলেই শিক্ষাদান ও শিক্ষা আহরণ প্রক্রিয়া সুস্থ হয়। শিক্ষককে হৃদয়ের প্রেরণায় শিক্ষাদান করতে হবে, শিক্ষার্থীরাও সমান হৃদয়ের প্রেরণা, শ্রদ্ধা দিয়ে গ্রহণ করতে হবে। রবীন্দ্রনাথ এই পর্যায়ে শূন্য মনন কিংবা উপস্থিত মননের বিপক্ষে। রবীন্দ্রনাথের মতে গুরু-শিষ্যের সম্পর্ক হওয়া উচিত আধ্যাত্মিক। পরস্পরের মনন হবে আপন সাধনার অঙ্গ।
সর্বজনীন শিক্ষা : রবীন্দ্রনাথ সর্বজনীন শিক্ষা বা সবার জন্য শিক্ষার উপর বিশেষ গুরুত্ব ও আকর্ষণ প্রকাশ করেছেন। রবীন্দ্রনাথের মতে দেশের মানুষকে শিশুকাল হইতে মানুষ করিবার সদুপায় যদি নিজে উদ্ভাবন এবং তাহার উদ্যোগ যদি নিজে না করি, তবে আমরা সর্ব প্রকার বিনাশ প্রাপ্ত হইব, অন্যে মরিব, স্বাস্থ্যে মরিব, চরিত্রে মরিব – ইহা নিশ্চয়। অর্থাৎ মানুষ জন্মের পর শিক্ষা তাঁর জন্য প্রযোজ্য একটি অধিকার হিসেবে থাকবে। অর্থাৎ জাত, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সবার জন্য শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। এবং সবার জন্য শিক্ষা নিশ্চিত হলেই বাঁচতে পারা যাবে, না হয় সঙ্কটে সঙ্কটে মৃত্যুবরণ করতে হবে। সুতরাং শিক্ষা ব্যবস্থা থাকলেই হবে না সমস্ত মানুষকে সেই শিক্ষার আয়োজনে সংযুক্ত করতে হবে।
রবীন্দ্রনাথ তাঁর শিক্ষা দর্শনের তত্ত্বীয় জ্ঞানেই সীমাবদ্ধ ছিল না। সেটির বাস্তব রূপের প্রকাশও করেছেন। শান্তিনিকেতনে জীবনের অর্ধশতাব্দী তিনি তাঁর পরিকল্পিত শিক্ষানীতির বাস্তবায়ন করেছেন সাফলতার সাথে। তাই রবীন্দ্রনাথ শিক্ষা দর্শন আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়নে অনুসরণ জরুরি। শিক্ষার এমন সুগঠিত ও গবেষণা মূলক দর্শন শিক্ষাকে শুধু উন্নত করবে না। শিক্ষার পুরো ব্যবস্থাকে পাল্টে দিবে। শিক্ষার্থীরা শিক্ষা গ্রহণের এই প্রক্রিয়ায় সৃষ্টি ও উদ্ভাবনের প্রতি আকর্ষিত হবে। রবীন্দ্রনাথের এই শিক্ষাদর্শন শিক্ষাকে নতুন রূপে আলোকিত করবে। পাশাপাশি শিক্ষার আধুনিকায়নে এই দর্শন অগ্রণী ভূমিকা রাখবে। তাই রবীন্দ্রনাথের সে বাস্তবায়িত দর্শন অনুসরণ করে বর্তমান শিক্ষার উন্নয়ন ও উন্নতি কারণে উদ্যোগ নেওয়া জরুরি।
লেখক : কলামিস্ট