দুর্নীতি প্রতিরোধের উপায়

: মো. বজলুর রশিদ
প্রকাশ: ৬ মাস আগে

দুর্নীতি বাংলাদেশের জন্য একটি গুরুতর সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। যা দেশের সামগ্রিক সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক অবকাঠামোকে প্রভাবিত করছে। দুর্নীতি সমাজের মূল ভিত্তি নষ্ট করে এবং জনগণের আস্থা ক্ষুণ্ণ করে। দুর্নীতি একটি বহুমুখী সমস্যা যা বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে একটি বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রশাসন ও পুলিশ বাহিনীতে দুর্নীতি সমাজের নিরাপত্তা, ন্যায়বিচার ও সুশাসন প্রতিষ্ঠায় প্রধান অন্তরায়।

প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে দুর্নীতির উপস্থিতি একটি সাধারণ ঘটনা। সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে ঘুষগ্রহণ, ক্ষমতার অপব্যবহার, টেন্ডার ও প্রকল্পে অনিয়ম, পদোন্নতি ও নিয়োগ প্রক্রিয়ায় স্বজনপ্রীতি ইত্যাদি দুর্নীতির প্রধান ধরন। সরকারি সেবা প্রাপ্তিতে সাধারণ জনগণের দুর্ভোগ পোহাতে হয়, কারণ অনেক ক্ষেত্রে সেবার জন্য ঘুষ প্রদান করতে বাধ্য হয়। এর ফলে, সঠিক সেবা থেকে জনগণ বঞ্চিত হয় এবং সরকারের উপর থেকে আস্থা হারায়।

পুলিশ বাহিনীতে দুর্নীতি বাংলাদেশের আইন-শৃঙ্খলার উপর বিরূপ প্রভাব ফেলেছে। ঘুষ গ্রহণ, প্রভাবশালী ব্যক্তিদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে মামলার তদন্তে অনিয়ম, সাধারণ মানুষের হয়রানি, এবং অপরাধীদের সঙ্গে আঁতাত ইত্যাদি পুলিশ বাহিনীতে দুর্নীতির সাধারণ উদাহরণ। এই দুর্নীতির ফলে আইন-শৃঙ্খলার অবনতি ঘটে এবং জনগণের নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়ে। অপরাধীদের ধরার পরিবর্তে, অনেক সময় পুলিশ দুর্নীতির কারণে অপরাধীদের রক্ষা করে, যা সমাজে অপরাধের বিস্তার ঘটায়।প্রশাসন ও পুলিশ বাহিনীতে দুর্নীতির প্রভাব সমাজের বিভিন্ন স্তরে পড়ে। এর ফলে সাধারণ মানুষের মধ্যে নৈতিকতা ও ন্যায়বিচারের প্রতি আস্থা হ্রাস পায়। সামাজিক অস্থিরতা ও অসন্তোষ বৃদ্ধি পায় এবং অপরাধের হার বেড়ে যায়। অর্থনৈতিকভাবে, দুর্নীতির কারণে সরকারের রাজস্ব হারায় এবং উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর সঠিক বাস্তবায়ন ব্যাহত হয়।

বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় দুর্নীতির ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। শিক্ষক নিয়োগ, পরীক্ষার ফলাফল এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রশাসনিক কার্যক্রমে দুর্নীতির উপস্থিতি শিক্ষার মান কমিয়ে দেয়। শিক্ষার্থীরা যখন দেখেন যে যোগ্যতার ভিত্তিতে নয়, বরং আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে সাফল্য অর্জিত হয়, তখন তারা সঠিক নৈতিকতার শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়। স্বাস্থ্যখাতে দুর্নীতি বাংলাদেশের মানুষের জন্য বিশাল সমস্যা তৈরি করছে। ওষুধ সরবরাহ, হাসপাতালের বেড বরাদ্দ, চিকিৎসা সেবায় অগ্রাধিকার ইত্যাদিতে দুর্নীতির কারণে সাধারণ মানুষের চিকিৎসা সেবা পাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। চিকিৎসা খাতে দুর্নীতি মানুষের স্বাস্থ্য ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয় এবং সমাজে অসাম্য বাড়ায়।

দুর্নীতি অর্থনীতির মেরুদণ্ড ভেঙে দেয়। ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের জন্য সুষ্ঠু প্রতিযোগিতার পরিবেশ নষ্ট হয়, এবং ছোট ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো বড় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারে না। এতে করে বেকারত্ব বাড়ে এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হ্রাস পায়। রাজনীতিতে দুর্নীতি দেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে দুর্বল করে। ভোট কেনাবেচা, প্রভাবশালী ব্যক্তিদের দ্বারা নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপ ইত্যাদি কারণে সঠিক নেতৃত্ব উঠে আসতে পারে না। এর ফলে জনগণের মধ্যে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অসন্তোষ বৃদ্ধি পায়। দুর্নীতি সমাজের নৈতিক মানদণ্ডকে হ্রাস করে। যখন মানুষ দেখে যে দুর্নীতির মাধ্যমে সুবিধা পাওয়া যায়, তখন তারা নৈতিকতা ও সততার পথ থেকে বিচ্যুত হয়। এটি সমাজে একটি নেতিবাচক মানসিকতা তৈরি করে, যেখানে অন্যায়কে সাধারণভাবে মেনে নেয়া হয়।

দুর্নীতি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর কার্যক্রমকে ব্যাহত করে। পুলিশ ও বিচার বিভাগের মধ্যে দুর্নীতির কারণে অপরাধীরা সহজেই মুক্তি পায়, যা সাধারণ মানুষের নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলে। আইনশৃঙ্খলার অভাবে সমাজে অপরাধের হার বৃদ্ধি পায়।দুর্নীতি একটি সামাজিক ব্যাধি যা কোনো দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতির পথে প্রধান অন্তরায় হিসেবে কাজ করে। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে দুর্নীতির বিস্তার রোধ করা জরুরি। বাংলাদেশে দুর্নীতি একটি বহুমাত্রিক সমস্যা, যা সমাজের প্রতিটি স্তরে প্রভাব ফেলছে। দুর্নীতি প্রতিরোধে সুশাসন প্রতিষ্ঠা, আইন প্রয়োগের শক্তিশালীকরণ এবং জনগণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করা অত্যন্ত জরুরি।

সুশাসন প্রতিষ্ঠা দুর্নীতি প্রতিরোধের জন্য অপরিহার্য। সরকারের প্রতিটি স্তরে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ প্রদান করতে হবে যাতে তারা নৈতিক মানদণ্ডে অটুট থাকতে পারে। দুর্নীতি প্রতিরোধের জন্য কঠোর আইন প্রণয়ন ও কার্যকর বাস্তবায়ন অপরিহার্য। দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির বিধান রেখে আইন সংশোধন করতে হবে এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে শক্তিশালী করতে হবে।

গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা দুর্নীতি প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সাংবাদিকদের সুরক্ষা ও স্বাধীনতা প্রদান করে, দুর্নীতির তথ্য সংগ্রহ ও প্রকাশে উৎসাহিত করতে হবে। তথ্য জানার অধিকার আইন কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। সাধারণ জনগণের কাছে সরকারি কার্যক্রম সম্পর্কে সঠিক ও সময়মত তথ্য সরবরাহ করা হলে দুর্নীতির সম্ভাবনা কমে যায়।

সাধারণ মানুষের মধ্যে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন, এনজিও এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে দুর্নীতিবিরোধী প্রচারণা চালাতে হবে। সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে নৈতিক মানদণ্ড প্রতিষ্ঠা করতে হবে। নিয়োগ প্রক্রিয়া, পদোন্নতি, এবং অন্যান্য প্রশাসনিক কার্যক্রমে স্বচ্ছতা ও ন্যায্যতা নিশ্চিত করতে হবে। সরকারি সেবাপ্রদান প্রক্রিয়া ডিজিটালাইজড করতে হবে যাতে মধ্যস্বত্বভোগীর সংখ্যা কমে যায় এবং দুর্নীতির সুযোগ হ্রাস পায়। ই-গভর্ন্যান্সের মাধ্যমে সরাসরি জনগণের সঙ্গে সরকারি সংস্থাগুলোর সংযোগ স্থাপন করা যায়।

জনসাধারণের অংশগ্রহণ ও সম্পৃক্ততা দুর্নীতি প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ। স্থানীয় সরকার ও সম্প্রদায় ভিত্তিক সংস্থাগুলোর মাধ্যমে জনগণের মতামত ও সুপারিশ গ্রহণ করতে হবে। একটি কার্যকর বিচারব্যবস্থা দুর্নীতি প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বিচার ব্যবস্থার স্বচ্ছতা ও দক্ষতা নিশ্চিত করতে হবে যাতে দ্রুত ও সঠিকভাবে দুর্নীতির অভিযোগের নিষ্পত্তি করা যায়। দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও অংশীদারিত্ব গুরুত্বপূর্ণ। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সঙ্গে মিলে দুর্নীতি প্রতিরোধে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করতে হবে।

দুর্নীতি প্রতিরোধ একটি সমন্বিত প্রচেষ্টা যা সরকারের বিভিন্ন স্তর, সুশীল সমাজ, গণমাধ্যম, এবং সাধারণ জনগণের অংশগ্রহণের মাধ্যমে সম্ভব। উপরের উল্লিখিত উপায়গুলো কার্যকরভাবে বাস্তবায়িত হলে দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গঠন সম্ভব। তাই আমাদের সকলকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে দুর্নীতির বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী অবস্থান নিতে।

লেখক : সহকারী অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, তেজগাঁও কলেজ, ঢাকা

  • দুর্নীতি
  • #