জ্ঞানের শক্তি আগুনের থেকেও তীব্র, আগুনে হাত দিলে হাত পোড়ে- এটি মানুষের প্রাচীন জ্ঞানসাধনার একটি উল্লেখযোগ্য দিক। মানষ নিজেকে স্বর্ণের মতো পুড়িয়ে পুড়িয়ে খাঁটি করে। পোড়ানোর ধরন মানুষে মানুষে ভিন্ন হতে পারে, কিন্তু জ্ঞানসাধনার দহনে নিজেকে জ্বালিয়ে জ্বালিয়ে, নিজের দহনে নিজেকে পুড়িয়ে নিজেকে ভিন্নভাবে তৈরি করার মধ্যে দিয়ে আত্মানুসন্ধান করা যায়। আর যেমন আগুনে কাঁচামাংস ঝলসে নিলে যে তার স্বাদ বাড়ে এই ব্যবহারিক জ্ঞানও মানবজীবনে নিজস্ব সত্তা বিকাশে, সভ্যতা বিকাশে মুখ্য ভূমিকা রেখেছে। কিন্তু মানুষ আজ ব্যবহারিক জ্ঞান ও তত্ত্বজ্ঞানে মহাজ্ঞানী মহাজন। কিন্তু কিছু কিছু মানুষের আত্মজ্ঞান চর্চা আজও সেই প্রাচীন স্তর অতিক্রম করতে পারল না। মানুষ সুদূরের চাঁদের বুকে হাঁটল, গ্রহ-নক্ষত্রে নজর রাখল কিন্তু মানুষ তার নিজের অন্তর্নীহিত জগৎকে বোঝার চেষ্টা করল না।
অধিকাংশ ছেলেমেয়েদের জিজ্ঞাসা করুন- জীবনের উদ্দেশ্য কী তারা বলতে পারবে না। কেউ কেউ বলবে আমি ডাক্তার হব। কারণ সব সিনেমায় ডাক্তার চরিত্র দেখা যায়। সমাজ তাদের যা শিখিয়েছে সেটিই হতে চায় আমাদের ছেলেমেয়েরা। আর টাকাই জীবনের মূলমন্ত্র মনে করে। টাকা থাকলেই সবাই সবকিছু কিনে নিতে পারে। জীবনের স্বপ্নের জায়গা, আত্মোদর্শনের জায়গা, নিজের অন্তর্নীহিত শক্তির জায়গা আমরা আমাদের ছেলেমেয়েদের মধ্যে, আমাদের প্রজন্মের মধ্যে এখনও আমরা জাগ্রত করতে পারিনি।
মানুষ শৈশব থেকে কিছু প্রবণতা, কিছু প্রতিভা নিয়ে জন্মায়। সেই জন্মগত প্রবণতাকে নিরলস চর্চা ও কঠোর পরিশ্রমের দ্বারা লালিত করে বিকশিত করে তুলতে হয়। নিজের ক্ষমতার সীমা নিজে উপলব্ধি করার ক্ষমতাই আত্মজ্ঞান। আত্মজ্ঞানের অভাবই মানুষকে অহঙ্কারী করে তোলে। কারণ তার যা নেই, লোকের কাছে প্রমাণ করতে চায় তার তা আছে। চারপাশের মানুষকে আমরা নানাভাবে প্রতারিত করি, প্রভাবিত করি। পার্সোনালিটি শব্দটির প্রকৃত অর্থ মুখোশধারণ। পারসোনা ল্যাটিন শব্দটির অর্থ মুখোশ। মুখোশ পরতে পরতে মানুষ তার আসল সত্তা ভুলে যায়, তার সত্যিকারের চেহারা সে নিজেই চিনতে পারে না। এই যে বাইরের আমিটা তা ‘মিথ্যা আমি’। সমাজ আমাকে এভাবে তৈরি করে দিয়েছে। এই মিথ্যা আমির কাজ হচ্ছে লোককে মিথ্যার মোহে ইমপ্রেস করা, প্রতারিত করা। বন্ধুত্ব-প্রেম-চাকরি সবই যেন দাঁড়িয়ে থাকে মিথ্যা-ঠক-বাটপারি-অসততা দ্বারা নির্মিত কোনো ক্ষমতার সিঁড়ির ওপর।
আমরা নিজেরাই জানি না আমরা কী চাই। আমাদের চালাচ্ছে অজানা কেউ, সে কোনো এক সিন্ডিকেট। তারাই আবার চালাচ্ছে ক্ষমতাকেন্দ্রিক সিন্ডিকেটকে।। বুদ্ধিজীবী কিংবা সাধারণ মানুষ- সবই পোষা প্রাণীর মতো। তাদের নেই শক্ত মেরুদণ্ড, নেই সত্য বলার সাহস। কোথাও কোনো ঘূর্ণিপাকে অহর্নিশ ঘোরে এক অজানা মোহ-মায়ায়। যেখানে নেই নিজস্ব সত্তার শক্ত ও কঠিন দৃঢ়তা।
এই মিথ্যা পরিচয়ের গ্লানি যারা বহন করতে চাইবেন না। তাঁরা প্রতিদিন একান্তে বসে একটু নিভৃতে চিন্তা করুন আমি কে? কতটুকু জ্ঞান নিয়ে আমি জন্মেছি। আমার জ্ঞানের সীমা আমি বাড়াতে পেরেছি কিনা। দিনে দিনে আমি আরও যোগ্যতা অর্জন করতে পেরেছি কিনা। আমি কী ক্রমাগত নিজের মনকে উন্নত, বুদ্ধিকে পরিণত এবং চিন্তাকে পরিশীলিত করতে পেরেছি?
আমার অর্থ নেই, বিদ্যাও কম তাহলে আমার কী নিজেকেও কিছু দেবার নেই? আছে। মুখোশটি খুলে অন্তরের আয়নার সামনে এসে নিজেকে আবিষ্কার করুন, অন্তর্জগতে নিরালয় ভ্রমণ করুন। দেখুন, আপনি কী নিয়ে জন্মেছিলেন। কতটা অর্জন করতে পেরেছেন। তার জন্য কতটা পরিশ্রম করেছেন? যেকোনো তুচ্ছ কাজের জন্যও সময় ও পরিশ্রম লাগে।
ব্যবহারিক জ্ঞান ও আত্মজ্ঞানে আমরা আমাদের নিজেদেরকে বিনির্মাণ করি। নিভৃতে বসে নিজের সঙ্গে কথা বলুন। নিজেকে পুরস্কৃত করুন অথবা তিরস্কৃত করুন, নিজেকে নিজে আবিষ্কার করুন। জাপিত জীবনের কোন জায়গায় কতটুকু ত্রুটি আছে। যাপিত জীবনের মুখোশ উন্মোচন করে নিজেকে আবার নতুন করে জন্ম দিন। নতুন নতুন জন্মদিনে নিজেকে জানুন, নিজেকে বুঝুন।
লেখক : বিশ্লেষক ও সমাজকর্মী