জন কীটসের রোম্যান্টিসিজম ও বাংলাদেশের বিশ্বকাপ ভাবনা

: শায়েখ আরেফিন
প্রকাশ: ৬ মাস আগে

ইংরেজ কবি জন কীটস (১৭৯৫-১৮২১) বাংলায়ও বেশ পরিচিত। তিনি রোম্যান্টিক ধারার শীর্ষস্থানীয় কবিদের একজন। একটু বলে নেওয়া দরকার, সাধারণভাবে একটি ধারণা প্রচলিত আছে যে রোম্যান্টিসিজম (romanticism) মানেই তার সাথে প্রণয়ঘটিত কোনো ব্যাপার জড়িত। ব্যাপারটা তেমন নয়। শিল্প-সাহিত্যে রোম্যান্টিসিজমের অনেক বৈশিষ্ট্য রয়েছে- উচ্চ কল্পনা বা দূর কল্পনা, প্রকৃতির প্রতি অনুরাগ, সুন্দরের প্রতি আকর্ষণ, মণ্ময়তা, স্বাতন্ত্র্যবোধ, অতিপ্রাকৃতবাদ, স্বাধীনচেতা মনোভাব, অতীতের প্রতি মোহময়তা ইত্যাদি।  কীটসের একটি কবিতা ‘Ode on a Grecian Urn’, বাংলায় বলা যায় ‘গ্রিসীয় ভস্মাধার নিয়ে স্তুতিগান’। কবিতাটি আমাদের তেমন পরিচিত না হলেও এর পংক্তি বেশ পরিচিত। ঘরে বাঁধাই করা সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্যে বা দেওয়ালপঞ্জির পাতায় ইংরেজিতে লেখা দেখা যায়- ‘Beauty is truth, truth beauty’ (সত্যই সুন্দর, সুন্দরই সত্য); এটা ওই কবিতার পঙ্ক্তি। 

প্রাচীন গ্রীসে মৃতদেহের ভস্ম সংরক্ষণে ব্যবহৃত বড় কলসি আকৃতির এক ধরনের পাত্র হচ্ছে আর্ন (urn) বা ভস্মাধার। সেই পাত্রের চারপাশে উৎকীর্ণ থাকতো বিভিন্ন চিত্র, কাহিনি, ঘটনা, ছবি, গল্প, দেব-দেবী, কিংবদন্তি। সেই ভস্মাধারকে উপজীব্য করে কীটস কবিতাটি লিখেন।

কবি দেখতে পান ভস্মাধারের গায়ে খোদিত রয়েছে পত্রপল্লবসমৃদ্ধ সতেজ একটি গাছ। বাস্তবে গাছের পাতা ঝরে পড়লেও, কবির কল্পনায়, ভস্মাধারে খোঁদিত ওই গাছের পাতা কোনোদিন ঝ’রে পড়বে না। তাই গাছটি থাকবে চিরসবুজ। ভস্মাধারের গায়ের চিত্রে দেখা যায়, একটি গাভি নিয়ে গ্রামবাসী দেবতার উদ্দেশ্য উৎসর্গের জন্য সমবেত হয়েছে। কবি কল্পনা করেন, ওই মানুষগুলোর আর ঘরে ফেরা হবে না, তাদের ঘরগুলো খালি প’ড়ে থাকবে চিরকাল, আর তারাও এভাবে আনন্দ করতে থাকবে। কবি আরও দেখতে পান, প্রেমিক প্রেয়সীকে চুম্বনে উদ্যত রয়েছে। বাস্তবে, চুম্বন শেষে আকাঙ্ক্ষার সমাপ্তি ঘটে। কিন্তু ভস্মাধারের গায়ে চিত্রিত যুগল কখনো চুম্বনে লিপ্ত হতে পারবে না। ফলে তাদের চুম্বনাকাঙ্ক্ষা চিরকাল একইরকম রয়ে যাবে। কবি ভাবছেন, এতে তাদের দুঃখিত হওয়ার কারণ নেই, কেননা তারাও এরকম চিরতরুণ থাকবে। কবি দেখতে পান এক বাঁশিওয়ালা বাঁশি বাজাচ্ছে, কিন্তু সে বাঁশির সুর তিনি শুনতে পাচ্ছেন না। কবির কল্পনায় সেই অশ্রুত সুর যেন আরও সুন্দর! এ পর্যায়ে আরেকটি অমর বাক্য সৃষ্টি করেছেন কবি- Heard melodies are sweet, but those unheard are sweeter (শ্রুত সুর মধুর, কিন্তু অশ্রুত সুর মধুরতর)। কবিতায় কবি প্রকাশ করেছেন বাস্তবের চেয়ে কল্পনার জগত অধিক সুন্দর ও স্থায়ী; মানুষের জীবন ক্ষনস্থায়ী, কিন্তু সৌন্দর্য ও শিল্পকলা চিরন্তন।

ফিরে আসি ইংল্যান্ড থেকে বাংলায়, অষ্টাদশ শতক থেকে একবিংশ শতকে, কবিতা থেকে ক্রিকেটে, কীটস থেকে পাপনে। দীর্ঘসময় ধ’রে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের সভাপতির দায়িত্বে আছেন নাজমুল হাসান পাপন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তার একটা কথা ঘুরে বেড়াতে দেখি- ‘আপনাদের বুঝতে হবে, সবসময় আমাদের টার্গেট কিন্তু নেক্সট ওয়ার্ল্ডকাপ, নট দিস ওয়ার্ল্ডকাপ।’ গত (২০২৩) বিশ্বকাপে দল ব্যর্থ হওয়ার পর তিনি কথাটি বলেছিলেন। তার এ কথার মাহাত্ম্য বোঝার চেষ্টা করছি একটু পরে।

২৫ বছর চলছে ক্রিকেটে বাংলাদেশ টেস্ট মর্যাদা পেয়েছে। তারও ৪/৫ বছর আগে থেকে ক্রিকেট এদেশে জনপ্রিয় হতে থাকে। বাংলাদেশের টেস্ট মর্যাদা পাওয়ার সময় ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড বিরোধিতা করেছিল। এদেশের মানুষ তখন ওদের বর্ণবাদী আখ্যা দিয়েছিল। যাহোক, বলতে গেলে জগমোহন ডালমিয়ার প্রভাব ও অকুণ্ঠ সমর্থনে ২০০০ সালে বাংলাদেশ টেস্ট মর্যাদা পায়।

পরবর্তী ৪/৫ বছর ছিল এদেশের ক্রিকেটের জন্য ভয়াবহ বিব্রতকর। অপেশাদার দলগুলোর সাথেও পরাজিত হওয়া ছিল নিয়মিত ঘটনা। এরপর ডেভ হোয়াটমোর কোচ হয়ে এলেন, অবস্হার কিছুটা পরিবর্তন হলো। পরিবর্তন বলতে বড় কিছু জয় ক’রে ফেলা নয়, বড় দল হয়ে ওঠা নয়, বড়জোর জিম্বাবুয়ে কেনিয়ার সাথে কিছু জয়, আর কালেভদ্রে বড় দলগুলোর বিরুদ্ধে একটা জয়- এই।

এরপর ক্রিকেটে টি-টোয়েন্টি ফরম্যাট যুক্ত হলো। আগে বলা হতো বাংলাদেশের খেলোয়াড়দের ধৈর্য কম, তারা মেরে খেলতে পছন্দ করে, তাই তাড়াতাড়ি ব্যাটসম্যানেরা আউট হয়ে যায়, টি-টোয়েন্টিতে বাংলাদেশ ভালো করবে। এ আশাও ভুল প্রমাণিত হতে থাকে। সবশেষ এবারের (২০২৪) টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে সবচেয়ে বেশি (৩টি) জয় পেয়েছে ঠিক, কিন্তু এবারই বাংলাদেশ সবচেয়ে কলঙ্কজনক, কাণ্ডজ্ঞানহীন, ভীরু, অপেশাদারী ক্রিকেটের প্রদর্শনী উপস্থাপন করলো। সিকি শতাব্দীর অভিজ্ঞতাসম্পন্ন বাংলাদেশ দল নবীনতম দল আফগানিস্তানের সামনে ৭৩ বলে ১১৬ রান তাড়া করার সাহস করলো না!-যেখানে আবার ছিল প্রথমবারের মতো সেমিফাইনালে ওঠার হাতছানি! দেশের ক্রিকেটপ্রেমীরা তো বটেই, বিদেশি সংবাদমাধ্যম, খেলোয়াড়, বিশ্লেষকেরাও বিস্মিত হয়েছেন, এবং বাংলাদেশের সমালোচনায় অপমানজনক শব্দ ব্যবহার করেছেন। এতে আমাদের প্রতিক্রিয়া দেখানোর উপায়ও নেই। আমরা কী ব’লে এর প্রতিবাদ করবো?

শ্রীলঙ্কা টেস্ট মর্যাদা পাওয়ার ১৫ বছর (১৯৮১-১৯৯৬) পর বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয়ে যথার্থতা প্রমাণ করেছে। আফগানিস্তান টেস্ট মর্যাদা (২০১৭) পাওয়ার পর থেকে নিজেদের সামর্থ্যের প্রমাণ দিয়ে চলছে। সাত বছরের মাথায় তারা সেমিফাইনাল খেলে ফেললো। কিন্তু বাংলাদেশ পড়ে আছে সেই তিমিরেই; আফগানিস্তানের বিরুদ্ধেও জয়ের সাহস করতে পারছে না, কখনো ‘সম্মানজনক’ পরাজয়ে সন্তুষ্ট থাকছে।

অত্যন্ত নিম্নমানের ঘরোয়া ক্রিকেট, এর ওপর আবার জুয়া-দুর্নীতি-অনিয়ম, ক্রিকেট বোর্ডের স্বেচ্ছাচারিতা ও স্বজনপ্রীতি, অন্তর্কোন্দল, ক্রিকেটারদের অপেশাদারি মনোভাব, খেলার পাশাপাশি ব্যবসা, রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়া ইত্যাদি কারণে দেশের ক্রিকেটে আশাব্যঞ্জক পরিবর্তন ঘটেনি। এত বছরেও বিশ্বকাপ সেমিফাইনালেও খেলা হয়ে ওঠেনি, দূরে থাক শিরোপা! আমরা যাদেরকে বর্ণবাদী বলে গালি দিয়েছিলাম, তারাই সঠিক প্রমাণিত হচ্ছে।

সাকিব আল হাসান তিন জয়ে সন্তুষ্ট- জানিয়েছেন এক সাক্ষাৎকারে। নাজমুল হাসান পাপন যৎপরোনাস্তি খুশি। বিশ্বকাপ মিশন শেষ হওয়ার পর এক বক্তৃতায় তিনি বলেছেন, ‘এই যে আমরা সুপার এইটে উঠলাম, এর আগে তো কখনো পারি নাই। রিশাদ হোসেন বাচ্চা ছেলে, ওর বলই বুঝতে পারে না।’ মনে হচ্ছে যেন অন্য দেশগুলো থেকে বুড়োরা এসে ক্রিকেট খেলছে! অনেকে দেখে থাকবেন, আফগানিস্তান-ম্যাচের শেষদিকে যখন বৃষ্টি খেলা থামিয়ে দিল, তখন ড্রেসিংরুমে খেলোয়াড়েরা হাসিতামাশায় মত্ত!

বিশ্বকাপ-পরবর্তী বক্তৃতায় পাপন সাহেবের ‘টার্গেট সবসময় নেক্সট ওয়ার্ল্ড কাপ’ কথার মাহাত্ম্য ধরা পড়েছে। সময় অনাদি-অনন্ত, তাই ‘নেক্সট বিশ্বকাপ’ও এক অনন্ত ভাবনা। তিনি বুঝেশুনেই কথাটি বলেছিলেন। বাংলার মানুষকে তিনি চিরঅপেক্ষায় রাখতে চান, যেমন কীটস গ্রেশিয়ান আর্নে খুঁজে পেয়েছিলেন চিরন্তনতা। যেখানে অপেক্ষা থাকে সেখানে জেগে থাকে আশাবাদ। ভস্মাধারের প্রেমিক যুগলের চুম্বনাকাঙ্ক্ষা যেমন চিরকালীন, তেমনি পাপন সাহেবও আশাবাদের সদাজাগরণ দেখতে চান বাঙালির মনে। তিনি চান স্বপ্ন জেগে থাকুক- নেক্সট ওয়ার্ল্ড কাপ, আগামীবার হবে, পরেরবার হবে, হবে একদিন। তাই নাজমুল হাসান পাপন আজ একবিংশ শতাব্দীর বাংলায় শ্রেষ্ঠ রোম্যান্টিক কবি!

 লেখক : বিশ্লেষক ও সমালোচক

  • জন কীটস
  • রোমান্টিক কবি
  • #