আজ পহেলা জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্মদিন। এক অর্থে বলা যায় বাংলাদেশেরও জন্মদিন। কারণ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় না হলে বাংলাদেশ হতো কিনা সন্দেহ আছে। বাংলাদেশের জন্মের প্রধান বুদ্ধিবৃত্তিক মন্ত্রক এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরাই স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের প্রথমসারির স্বপ্নদ্রষ্টা। এই বিশ্ববিদ্যালয়ই ভিত্তি দিয়েছিল- ‘জ্ঞান যেখানে সীমাবদ্ধ, বুদ্ধি সেখানে আড়ষ্ট, মুক্তি সেখানে অসম্ভব।’ সময় গড়ায়। অনেক বিশ্ববিদ্যালয় এখন দেশে। আগের মতো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হয়তো সেই জৌলুস নেই। কিন্তু এখনো দেশের বুদ্ধিভিত্তিক চিন্তনের প্রধান বাতিঘর এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
দুঃখজনক হচ্ছে, আজ এই দিনেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়, তাদের সকল শিক্ষকবৃন্দ অনির্দিষ্টকালের কর্মবিরতিতে! কেন কর্মবিরতি? ২০১৫ সালের শিক্ষকদের প্রতি একটি বৈষম্যমূলক পে-স্কেলের পর আবারো একটি বৈষম্যমূলক পেনশন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে যার নাম ’প্রত্যয়’। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক সজীব হোসেন দেখিয়েছেন কীভাবে নতুন পেনশনব্যবস্থা আর্থিক বৈষম্য সৃষ্টি করে এবং সুবিধা কমিয়ে দেয়। তাঁর হিসাবে বিদ্যমান পেনশন ব্যবস্থা থেকে নতুন পেনশনব্যবস্থায় গেলে একজন শিক্ষককের আনুমানিক মোট ক্ষতি হবে ১ কোটি ৩২ লক্ষ টাকা। এটা বৈষম্যমূলক এবং অন্যায্য শুধু আর্থিকভাবে নয় , সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে। কারণ একই স্কেল একই রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে বেতন তুলে একেকজন একেকরকম পেনশন পেতে পারেন না। বরঞ্চ শিক্ষকদের বেতন হওয়া উচিত অন্যদের চেয়ে বেশি এবং আলাদা। যোগ্যতা বিশ্বমানের হোক তাতে কোনো আপত্তি নাই। কিন্তু যোগ্যতা চাইবেন বিশ্বমানের, সুযোগ-সুবিধা বিশ্বে সবচেয়ে কম এটাতো স্রেফ বৈষম্য এবং অন্যায্য।
অনেকেই প্রশ্ন করেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা কেন নতুন পেনশন স্কিমের বিরুদ্ধে? প্রথম কথা হচ্ছে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী, সর্বজনীন পেনশনব্যবস্থা তো তাদের জন্য প্রযোজ্য যারা বর্তমানে কোন পেনশন পলিসিতে নাই। যারা সরকারি পেনশন পেতেন না তাদের জন্যই মূলত চারটি পেনশন স্কিম চালু করা হয়- প্রবাস (প্রবাসী বাংলাদেশীদের জন্য); প্রগতি (বেসরকারি কর্মচারী/প্রতিষ্ঠানের জন্য); সুরক্ষা (স্বকর্ম ও অ-প্রাতিষ্ঠানিক কর্মীদের জন্য); এবং সমতা (স্বল্প-আয়ের ব্যক্তিদের জন্য)। কিন্তু হঠাৎ করে চলে আসল সর্বজনীন ‘প্রত্যয়’। নাম সর্বজনীন, অথচ তা প্রযোজ্য স্বায়ত্তশাসিত ,বা এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের উপর। সর্বজনীনই যদি হয় তাহলে বিদ্যমান ব্যবস্থার মতো যারা সরকারি কোষাগার থেকে বেতন পান তাদের সবার জন্য এক যোগে হল না কেন? যদি একবছর পর সবার জন্যও হয়, তাহলে এখানে এক বছর আগে কেন? সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডারদের (যেমন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক) সঙ্গে কোনো আলোচনা না করে চাপিয়ে দেওয়া হলো কেন? এটা কি গিনিপিগ ট্রায়ালের মতো হয়ে যায় না!
সূক্ষ্মভাবে ভাবলে ২০১৫ সালের পে-স্কেল, প্রত্যয় স্কিম এগুলো দেশের শিক্ষাব্যবস্থা বিশেষ করে উচ্চশিক্ষার উন্নতির অন্তরায়। শিক্ষাব্যবস্থাকে বাঁচাতে এবং শিক্ষকদের সম্মান ধরে রাখতেই এই আন্দোলন। বেতন কম, সোশ্যাল সিকিউরিটি কম, ইত্যাদি কারণে মেধাবীদের টানতে পারবে না। ফলে, অর্থের ভিত্তিতে বিভাজিত উচ্চশিক্ষায় আর্থিকভাবে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর ছেলেমেয়েরা উন্নত শিক্ষা পাবে না। এতে পরে যারা নিয়োগপ্রাপ্ত হবে তারাও তুলনামূলক কম মেধাবীদের মধ্য থেকেই নিয়োগ প্রাপ্ত হবে। একটা দুষ্টচক্রে পড়ে যাবে জাতি, শিক্ষা ব্যবস্থা। পাবলিক পড়া ছাত্র-ছাত্রীদের স্বপ্ন হবে বড়জোর তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণির চাকরি করে সন্তুষ্ট থাকা। অলরেডি এই ট্রেন্ড চালু হয়েছে, যখন দেখি পাবলিক এ পড়া একজন ছাত্র ছাত্রী মারাত্মক খুশি হয়ে যায়, ব্যাংকের ক্যাশিয়ার, পুলিশের এসআই অথবা কোন সরকারি প্রতিষ্ঠানের ১৩/১৪ গ্রেডের বেতন পেলে।
ঐতিহাসিকভাবেই যেকোনো দেশ এগিয়ে যায় জ্ঞানের উপর ভিত্তি করে। একথা বঙ্গবন্ধু উপলব্ধি করেছিলেন বলেই ভঙ্গুর অর্থনীতিতেও শিক্ষায় বরাদ্দ দিয়েছিলেন জিডিপির প্রায় ৪ শতাংশ । এখন সেই বরাদ্দ ২ শতাংশের নিচে। এতো সীমাবদ্ধতার পরও বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এগুচ্ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবার ওয়ার্ল্ড র্যাংকিংয়ে ৬০০-এর ভিতরে এসেছে। অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও ভালো করছে। এমনকি অত্যন্ত নবীন বিশ্ববিদ্যালয়, যেমন বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ও শিক্ষা ও গবেষণায় দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। এখানকার বেশিরভাগ শিক্ষকই নিজ যোগ্যতাই দেশের বাইরে থেকে পিএইচডি করছে। কোনো ধরনের সরকারি স্কলারশিপ ছাড়া।
এক গবেষণায় দেখা গেছে- ব্রিটিশদের ৭৫০ বছরের উন্নতির পেছনে শিক্ষার অবদান ৫৯ শতাংশ। এই শিক্ষা হচ্ছে মাধ্যমিক পরবর্তী উচ্চশিক্ষা বা টারশিয়ারি এডুকেশন। শিল্পবিপ্লব পূর্ববর্তী এবং পরবর্তী দুই পিরিয়ডের জন্যই এটা প্রযোজ্য। এই শিক্ষা না থাকার কারণেই আফ্রিকার দেশগুলো সম্পদ থাকার পরেও গরিব! আইভরি কোস্টের খনিজের টাকায় ফ্রান্সের বাজেট হয়, অথচ আইভরি কোস্ট অনাহারে থাকে! জীবনের মৌলিক উপাদান পানি না থাকার পরেও সিঙ্গাপুর ধনী। সিঙ্গাপুরের সাবেক এক অর্থমন্ত্রীকে উন্নতির কারণ জিজ্ঞেস করা হয়েছিল। উত্তরে উনি বললেন, ‘মেরিটোক্রেসি’! বলাবাহুল্য কয়েক বর্গমাইলের একটা রাষ্ট্রে কীভাবে বিশ্বমানের বিশ্ববিদ্যালয়, হাসপাতাল থাকে!
তাই এ ধরনের বৈষম্যমূলক আর্থিক ব্যবস্থা চালু হলে, সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হবে রাষ্ট্রের। সবচেয়ে মেধাবীরা আর শিক্ষকতায় আসবে না। আর বিশ্ববিদ্যালয়ের মান যদি খারাপ হয়, তাহলে কোনো সেক্টরই ভালো কিছু করতে পারবে না। সেটা হোক আমলাতন্ত্র , বিচারবিভাগ বা অন্য কিছু। প্রফেসর নুরক্সের বিখ্যাত উক্তি- ‘A country remains poor because it is poor’ বাস্তবায়িত হবে। কারণ শিক্ষার যে কাসকেডিং ইফেক্ট, এটা অন্য কিছুরই নেই। যে কারণে সবচেয়ে ভালো যারা তাদের এখানে আনা উচিত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ও তার জন্মলগ্নে তা-ই করেছে। নিয়ম ভেঙে বেশি বেতন দিয়ে জগদ্বিখ্যাত প্রফেসর নিয়োগ দিয়েছে। এই কাসকেডিং ইফেক্ট এর কারণেই বলা হয়, First-class people appoint first-class people; second-class people appoint third-class people.
মুকাদ্দিমায় ইবনে খালদুন সাক্ষ্য দেন- কীভাবে শিক্ষাব্যবস্থা কোনো রাষ্ট্রের উন্নতি-অনুন্নতির পরিচয় বহন করে। তার ভাষায়, শিক্ষাব্যবস্থা একটা শিল্প। এই শিল্প হচ্ছে মানুষের মনন সৃষ্টি। তাই দেখা যায়-কোনো রাষ্ট্রের দুরবস্থা তার শিক্ষাব্যবস্থার দুরবস্থার সমান্তরাল। তাই সরকারের উচিত ‘প্রত্যয়’ স্কিম, স্বতন্ত্র বেতন স্কেল ইত্যাদি নিয়ে সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে আলোচনা করা। তাদের যুক্তিগুলো শোনা এবং বুঝতে চেষ্টা করা।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়