কিছু ভাবনা

: চিরঞ্জীব সরকার
প্রকাশ: ৮ মাস আগে

মানুষের সভ্যতা, চিন্তা, চেতনা, জ্ঞান ও বিজ্ঞান দিনে দিনে সমৃদ্ধ হয়। কারণ সময়ের সাথে সাথে অনেক মানুষ তাদের অভিজ্ঞতালদ্ধ জ্ঞান দ্বারা সভ্যতাকে ক্রমাগত সমৃদ্ধ করে। এটা আমরা জীবনের প্রতিটা ক্ষেত্রেই প্রত্যক্ষ করতে পারি। সনাতন কৃষিপদ্ধতি ছেড়ে মানুষ যান্ত্রিক কৃষিকে আলিঙ্গন করেছে, খর-পাতার কুটির পরিত্যাগ করে ইট-পাথরের দালানে আশ্রয় নিচ্ছে, পায়ে হাঁটা মানুষ এখন পথ অতিক্রম করছে যন্ত্রযানে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকেও এখন সামিল করা হচ্ছে জটিল কতকিছুর সহজ সমাধান করার জন্য।

কিন্তু এত কিছু করা বা ঘটার পরও কি আমাদের জীবনে বা মানুষের জীবনে সুখ-শান্তি বা স্বস্তি এসেছে? এটা নিয়েও পৃথিবীতে বহু গবেষণা হয়েছে এবং গবেষণার ফল কিন্তু খুবই হতাশাজনক। বিশ্বজুড়ে আত্মহত্যার প্রবণতা, মানসিক রোগ, হতাশা, বঞ্চনা, গৃহহীনতা, সম্পদের অসম বণ্টন, যুদ্ধ ও অস্ত্রের জন্য ব্যয়, জীবনযাত্রার পদ্ধতিগত কারণে সৃষ্ট অসুখ (Life-Style Disease), নিপীড়ন, নির্যাতন এগুলো বেড়েই চলেছে। এ থেকে মুক্ত হবার জন্য জাতিসংঘসহ অনেক সংস্থা চেষ্টা করে যাচ্ছে কিন্তু কার্যকরী ফল তেমন একটা দেখা যাচ্ছে না।

আসলে অসুখটা যে কোথায় সেটা কেউ সুনির্দিষ্ট করে ধরতে পারছে না।পৃথিবীর তথা মানুষের অসুখ অনেক গভীরে। আরও পরিস্কার করে বলতে গেলে এ অসুখ অন্তরে। অতিলোভ ও আধিপত্য বিস্তারের আকাক্সক্ষাই এ অসুখের মূল। সেটাই ব্যক্তি থেকে সমাজ এবং সমাজ থেকে রাষ্ট্র ব্যবস্থায় যখন সংক্রমিত হয়ে পড়ে তখন এর অভিঘাত থেকে কেউই রেহাই পায় না। প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা শুধু অর্জনের জন্য ছাত্রছাত্রীদের তাড়িত করে অথচ বর্জনের জন্য কোনো তাগিদ দেয় না। ঘোড়দৌড়ে ছেড়ে দেয় অথচ আহত হলে কোলে তুলে নেয় না।

(এই পৃথিবীতে আসলে নিজেকে নিজেকেই ভালবাসতে হবে। এক্ষেত্রে প্রকৃতি আমাদেরকে কখনো হতাশ করবে না। এ  আকাশ, বাতাস, রৌদ্র, রংধনু, বুনো ফড়িং, মাছরাঙা, মেঘ, কঙ্কাবতীর ঢেউ, হিমালয়ের শুভ্র বরফ কখনো বলবে না তুই এমন করলি কেন, তোকে আমি এখন শাস্তি দেব)

কিন্তু আমরা কি তাহলে একবুক হতাশা নিয়েই একদিন এ পৃথিবী থেকে বিদায় নেব? মোটেই না। পৃথিবীর সমস্ত ভূমি আবৃত করতে আমরা অক্ষম হলেও আমরা একজোড়া পাদুকা দিয়ে। কিন্তু আমাদের পদতলের ভূমিটুকু আবৃত করতে সক্ষম। পুস্পহীন বিশাল জঙ্গলের অসংখ্য বৃক্ষের মধ্যে আমরা কিন্তু একটি সুগন্ধী পুষ্পবৃক্ষ বপন করতে সক্ষম যেটি সমস্ত বনরাজিতে সৌরভ বিলাতে পারবে। আমরা যদি অন্তর থেকে অতিলোভ ও অন্যের উপর আধিপত্য বিস্তারের বিকৃত চাহিদা থেকে নিজেদেরকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারি তখন কিন্তু আমরা একটু একটু করে আনন্দ ও পূর্ণতার উপলদ্ধি অনুভব করতে শুরু করব।

আমাদের জীবনের সবার জন্য আলাদা প্রশ্নপত্র, আলাদা আলাদা পরীক্ষা কেন্দ্র এবং আলাদা আলাদা সময় বরাদ্দ। তাই অন্যের প্রশ্নপত্রের উত্তর লিখতে গেলে শুধু বিপত্তিই আসবে। এখানে নিজের পরীক্ষাটা দেয়াই উত্তম যেখানে ব্যর্থতা বলতে কিছু নেই। নিজের পরীক্ষার ব্যর্থতা হল অভিজ্ঞতা সঞ্চয় আর অন্যের পরীক্ষায় সাফল্য বলতে কিছু নেই। সেটা কেবল হতাশা অর্জনের এক কষ্টকর হাস্যকর প্রচেষ্টা মাত্র।

এই পৃথিবীতে আসলে নিজেকে নিজেকেই ভালবাসতে হবে। এক্ষেত্রে প্রকৃতি আমাদেরকে কখনো হতাশ করবে না। এ  আকাশ, বাতাস, রৌদ্র, রংধনু, বুনো ফড়িং, মাছরাঙা, মেঘ, কঙ্কাবতীর ঢেউ, হিমালয়ের শুভ্র বরফ কখনো বলবে না তুই এমন করলি কেন, তোকে আমি এখন শাস্তি দেব। আমাদের যত আঘাত শুধু মানুষের কাছ থেকেই। কিন্তু তাই বলে কি মানুষকে বর্জন বা উপেক্ষা করতে হবে? না। মানুষের ভিতরের ভালোটুকু গ্রহণ করলে আমরা সমৃদ্ধ বা লাভবান হব। ভালো-মন্দ মিশিয়েই মানুষ। আমরা যদি মানুষের ভিতর ভালোটুকুর সন্ধান করি তবে আমরা মানুষের কাছ থেকেই আনন্দের অনুসঙ্গ লাভ করতে সক্ষম হব যেমনটি করে প্রজাপতি ও মৌমাছি ফুলে ফুলে বিচরণ করে।

(আরও একটি কথা মনকে বেশ আলোড়িত করেছে। একজন ইয়াং বিজ্ঞানীর একটি পডকাষ্টের অনুষ্ঠান শুনছিলাম। সে বলল মানুষের ডিএনএ নাকি শক্তি সংরক্ষণে প্রকৃত শান্তি পায়, শক্তি ব্যয়ে নয়)

এখানেই আসে ম্যাচুরিটি বা প্রাজ্ঞতার পরিচয়। একজন প্রাজ্ঞ ব্যক্তি জানে ছোট্ট এ মানবজীবনে অল্পের ভিতর থেকে স্বল্প জিনিসে ও স্থিতিতে জীবনকে ধরে রাখতে পারলে জীবনটি সুখে ও আনন্দে কেটে যায়। জানালা বন্ধ করে রাখলে বাহিরের আলোর সমুদ্রে আমরা অবগাহন করতে পারব না। জানালাটি খুলবার আগ্রহ থাকতে হবে নতুবা অন্ধকার কুঠুরিতেই জীবনের নির্বাসন ঘটবে।

এ বছর সঞ্চয় সম্বন্ধে একটি চমৎকার সংজ্ঞা শুনলাম। সঞ্চয় বলতে আমরা সাধারণত অর্থকে ব্যয় না করে ধরে রাখতে বুঝি। কিন্তু একজন বলল যথাসময়ে যথাস্থানে ব্যয় করাই হল উপযুক্ত সঞ্চয়। বিষয়টি নিয়ে ভেবে দেখলাম আসলেই কথাটার ভিতর গভীর সত্যতা লুকিয়ে আছে। অসুখ হলে যদি আমি সঞ্চিত অর্থ ব্যয় না করি তবে সে সঞ্চয় তো আমার প্রাণ সংহারের কারণ হবে। শিক্ষার জন্য যদি আমি ব্যয় না করি তবে সেতো সর্বনাশকে ডেকে আনার নামান্তর মাত্র। অসহায় মানুষদের জন্য যদি আমরা দান না করি তবে তা আত্মগ্লানির সঞ্চয় মাত্র।

আরও একটি কথা মনকে বেশ আলোড়িত করেছে। একজন ইয়াং বিজ্ঞানীর একটি পডকাষ্টের অনুষ্ঠান শুনছিলাম। সে বলল মানুষের ডিএনএ নাকি শক্তি সংরক্ষণে প্রকৃত শান্তি পায়, শক্তি ব্যয়ে নয়। আসলে উড়োজাহাজে চড়া শেষ করে মানুষ যখন গৃহে ফিরে দেহখানিকে বিশ্রাম দেয় তখনি শান্তির নিদ্রা দুচোখে আশ্রয় নেয়। দিগন্তের পাখিরা যখন নীড়ে ফিরে আসে উড়ন্ত ডানার ব্যয় করা শক্তি লতাপাতায় জড়িত সে আশ্রয়ে শান্তিতে পরিণত হয় যখন সে থাকে শক্তি সংরক্ষণের নীতিতে।

ভিআইপি নিয়েও একটি নতুন কথা শুনলাম। ভিআইপি বলতে আমরা সাধারণত বুঝি বিশেষ একটি শ্রেণির লোকদের যারা বিশেষ কিছু জায়গায় বিশেষ কিছু সুবিধা লাভ করে যেটা আমজনতা পায় না। কিন্তু নতুন এ ভিভাইপি হল ভ্যালুজ, ইন্টেগ্রিটি ও পারপোজ। এ তিনটি জিনিস আধিত করতে পারলে আমরা জীবনে প্রকৃতই মানুষ হতে পারব। আমরা যদি প্রকৃতই কোনো ভ্যালুজ বা নীতিবোধকে ধারণ করতে না পারি, তবে জীবন এলোমেলো ও অর্থহীন হয়ে যাবে। ইন্টেগ্রিটি হল নিজের বিবেকের কাছে প্রশ্ন করে দেখা আমি যা ভাবছি বা করছি সেটা আসলেই কল্যাণকর কিনা। আর মহান একটা পারপোজ আমাদেরকে খুঁজে বের করতেই হবে যার জন্য এ বাঁচা। সবাই ভাল থাকুন, সবার জীবনের উপর দিয়ে বয়ে যাক একগুচ্ছ রজনীগন্ধার মিষ্টি সৌরভ।

  • চিন্তা
  • চেতনা
  • জ্ঞান
  • বিজ্ঞান
  • মানুষ
  • সভ্যতা
  • #