চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি) মোহাম্মদ কামরুল হাসানের স্ত্রী সায়মা বেগমের নামে আছে পাঁচটি জাহাজ (বার্জ)। যেগুলো নৌপথে মালামাল পরিবহনে ব্যবহৃত হয়। কোনও ধরনের বৈধ আয়ের উৎস ছাড়াই সায়মা বেগমের কয়েক কোটি টাকা দামের পাঁচটি জাহাজের মালিক বনে যাওয়াকে অবিশ্বাস্য বলছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। তবে এসব জাহাজ এডিসি কামরুল হাসান অবৈধভাবে অর্জিত অর্থেই স্ত্রীর নামে কিনেছেন বলে দুদকের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে।
দুদকের অনুসন্ধান প্রতিবেদন সূত্র জানিয়েছে, সায়মা বেগমের নামে থাকা পাঁচ জাহাজের মধ্যে আছে– এমভি প্যাসিফিক রাইডার, এমভি পানামা ফরেস্ট-১, এমভি রাইসা তারাননুম, বার্জ আল বাইয়েত। পাঁচটি জাহাজের এক-তৃতীয়াংশের মালিক সায়মা বেগম। এসব জাহাজে কাগজে-কলমে বিনিয়োগ দেখানো হয়েছে এক কোটি ৫১ লাখ ৩১ হাজার ৩৮০ টাকা। অথচ বাস্তবে এ বিনিয়োগ তিন থেকে চার গুণ বেশি হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এসব জাহাজ পরিচালনা করছে ‘সওদাগর নেভিগেশন’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান। ওই প্রতিষ্ঠানের মালিক সায়মা।
আদালতে জমা দেওয়া এ পুলিশ দম্পতির সম্পদের মধ্যে সায়মা বেগমের স্থাবর সম্পদের মধ্যে আছে, নগরীর পাহাড়তলী থানাধীন উত্তর হালিশহর মৌজায় ৪০ শতক জমি। যার মূল্য দেখানো হয়েছে এক কোটি ২৫ হাজার টাকা। সায়মার নামে অস্থাবর সম্পত্তির মধ্যে আছে বাংলাদেশ ব্যাংকে পাঁচ বছর মেয়াদি ৪৫ লাখ টাকার পরিবার সঞ্চয়পত্র।
দুদকের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, সায়মা বেগমের নামে এক কোটি ২৫ লাখ টাকার স্থাবর সম্পদ এবং এক কোটি ৯৯ লাখ ২৮ হাজার ২৪০ টাকার অস্থাবর সম্পদসহ মোট ২ কোটি ৫৩ লাখ ২৪০ টাকার সম্পদ অর্জনের তথ্য পাওয়া যায়। তার পারিবারিক ও অন্যান্য ব্যয়সহ মোট অর্জিত সম্পদের পরিমাণ ২ কোটি ২ লাখ ৯৯ হাজার ৬২১ টাকা। এই সম্পদ অর্জনের বিপরীতে তার বৈধ ও গ্রহণযোগ্য আয়ের উৎস পাওয়া যায় ৪০ লাখ ১৪ হাজার ৪৩৩ টাকা। এ ক্ষেত্রে তার অর্জিত সম্পদের চেয়ে এক কোটি ৬২ লাখ ৮৫ হাজার ১৮৮ টাকার বৈধ কোনও উৎস পায়নি দুদক।
অপরদিকে, এডিসি কামরুল হাসানের নামে ১২ কোটি ৭২ লাখ ৯২ হাজার ৬৯৫ টাকার স্থাবর সম্পদ এবং এক কোটি ২৩ লাখ ৩৯ হাজার ২১৬ টাকার অস্থাবর সম্পদসহ মোট ১৩ কোটি ৯৬ লাখ ৩১ হাজার ৯১১ টাকার সম্পদ অর্জনের তথ্য পাওয়া পায় দুদকের অনুসন্ধানে। পারিবারিক ও অন্যান্য ব্যয়সহ তার মোট অর্জিত সম্পদের পরিমাণ ১৪ কোটি ৬৬ লাখ ৬০ হাজার ১৫২ টাকা। তার অর্জিত সম্পদের চেয়ে ৯ কোটি ৮৬ লাখ ২৮ হাজার ৬৫ টাকার বৈধ আয়ের উৎস পায়নি দুদক।
দুদক কর্মকর্তার প্রাথমিক অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, মোহাম্মদ কামরুল হাসান ও তার স্ত্রী সায়মা বেগমের জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদের পরিমাণ ১১ কোটি ৪ লাখ ৩৫ হাজার ৯১৯ টাকা। এসব টাকা কামরুল হাসান পুলিশের দায়িত্ব পালনকালে ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জন করেছেন। জ্ঞাত আয়বহির্ভূত অর্জিত এসব সম্পদ ক্রোকের আদেশ দিয়েছেন চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ বেগম জেবুন্নেছা। সোমবার (৮ জুলাই) দুদকের সমন্বিত জেলা কার্যালয় চট্টগ্রাম-১-এর সহকারী পরিচালক মো. এমরান হোসেনের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত এ আদেশ দেন।
কামরুল হাসান বর্তমানে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের পাবলিক অর্ডার ম্যানেজমেন্ট (ডিওএম) বিভাগে অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি) হিসেবে কর্মরত আছেন। এর আগে তিনি মেট্রো কোর্টে সিএমপির এডিসি (প্রসিকিউশন) এবং এডিসি (ক্রাইম) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
মোহাম্মদ কামরুল হাসান ১৯৮৯ সালে উপপরিদর্শক (এসআই) পদে বাংলাদেশ পুলিশে যোগদান করেন। তিনি নোয়াখালী জেলার বেগমগঞ্জ থানাধীন মীরওয়ারিশপুর এলাকার মৃত মোহাম্মদ গোলাম কবিরের ছেলে। থাকেন চট্টগ্রাম নগরীর পশ্চিম নাসিরাবাদ এলাকায়। ১৯৯২ সালে পারিবারিকভাবে সায়মাকে পারিবারিকভাবে বিয়ে করেন কামরুল। তাদের একমাত্র ছেলে মুহাম্মদ ইয়াসিন হাসান অস্ট্রেলিয়ায় লেখাপড়া করছেন।
দুদকের পিপি কাজী ছানোয়ার আহমেদ লাভলু বলেন, চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) অতিরিক্ত উপ-কমিশনার মোহাম্মদ কামরুল হাসান ও তার স্ত্রী সায়মা বেগমের নামে দুদক প্রাথমিক অনুসন্ধানে জ্ঞাত আয়ের বাইরে ১১ কোটি ৪ লাখ ৩৫ হাজার ৯১৯ টাকার সম্পদ অর্জনের তথ্য পেয়েছে। এসব সম্পদ ক্রোক ও জব্দ করা না গেলে তা হস্তান্তর হয়ে যেতে পারে। পরে রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত করা সম্ভব হবে না। দুদক কর্মকর্তার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত তাদের নামে থাকা বিভিন্ন সম্পত্তির দলিল, ফ্ল্যাট ও কোম্পানির আংশিক শেয়ারসহ স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি ক্রোক এবং অবরোধের নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। এখন থেকে এসব সম্পত্তি দুদক দেখভাল করবে। পরবর্তীতে এসব সম্পত্তি তদারকির জন্য রিসিভার নিয়োগের আবেদন করা হবে।
আদালতে দুদক কর্মকর্তার জমা দেওয়া তালিকায় এডিসি মোহাম্মদ কামরুল হাসানের নামে রয়েছে নগরীর পাহাড়তলী থানাধীন উত্তর হালিশহর মৌজায় ৪০ শতক জমি। যার মূল্য এক কোটি ২০ লাখ টাকা। পাহাড়তলী থানাধীন উত্তর হালিশহর মৌজায় ৪০ শতক জমি। যার মূল্য এক কোটি ২০ লাখ টাকা। পাহাড়তলী থানাধীন পশ্চিম নাছিরাবাদ মৌজায় ৩.৩৩ শতক জমি। যার মূল্য ৩ লাখ টাকা। পাহাড়তলী থানাধীন পশ্চিম নাছিরাবাদ মৌজায় জমি, যার মূল্য ৮০ হাজার টাকা। পাহাড়তলী থানাধীন পশ্চিম নাছিরাবাদ মৌজায় জমি, যার মূল্য ৮৫ হাজার টাকা। ঢাকা জেলার সাভার থানা ও পৌরসভার অধীন মৌজা জালেশ্বর ও টাট্টী এলাকার ১০৭ শতাংশ জমির মধ্যে ২৬.৭৫ শতাংশ তার। অর্থাৎ চার জনে মিলে জমিটি কেনেন; যার মূল্য ধরা হয়েছে ৭ লাখ ১২ হাজার ৫০০ টাকা। ঢাকায় ‘সাভার সিটি সেন্টার অ্যান্ড সাভার সিটি সেন্টার টাওয়ার’ নামে ১২ তলা ভবনে রয়েছে তার অংশীদারত্ব। কামরুল হাসানসহ চার জন অংশীদার মিলে এই ভবন নির্মাণ করেন। যার মূল্য ৫ কোটি ২ লাখ ৬২ হাজার ২২৯ টাকা।
চট্টগ্রামের খুলশী থানাধীন খুলশী মৌজায় চিটাগং কো-অপারেটিভ হাউজিং সোসাইটি লিমিটেড লে-আউট প্ল্যানের প্লট নং-১/সি-তে নির্মিত ‘ফয়জুন ভিস্তা’ নামে অ্যাপার্টমেন্ট ভবনে .৭৪ শতক ভিটাজমি। ওই অ্যাপার্টমেন্ট ভবনের অষ্টম তলার (সি-৭) পশ্চিমাংশে সি-টাইপ অ্যাপার্টমেন্টের পরিমাণ ২ হাজার ৫৭০ বর্গফুট এবং নিচতলার আছে ১৩৬ বর্গফুট স্পেসের গাড়ি পার্কিং; যার মূল্য ধরা হয় ১২ লাখ ১০ হাজার টাকা। পাহাড়তলী থানাধীন পশ্চিম নাছিরাবাদ মৌজার জমির মূল্য ধরা হয় ৪০ লাখ টাকা। পাহাড়তলী থানাধীন পশ্চিম নাছিরাবাদ মৌজায় ১২.৭৫ শতাংশ জমি; মূল্য ধরা হয়েছে ৪৮ লাখ ৪০ হাজার টাকা। পাহাড়তলী থানাধীন পশ্চিম নাছিরাবাদ মৌজায় ৬.৫৯ শতাংশ জমি; মূল্য ধরা হয়েছে ২৮ লাখ ৬০ হাজার টাকা। পাহাড়তলী থানাধীন পশ্চিম নাছিরাবাদ মৌজায় চারতলা ভবনসহ সাত শতক জমি, মূল্য ধরা হয়েছে এক কোটি ৭৮ লাখ ৫৮ হাজার টাকা।
ঢাকার সাভার থানাধীন আনন্দপুর মৌজায় রয়েছে ৫.২০ শতাংশ জমি; যার মূল্য ধরা হয়েছে ১৭ লাখ ৪৬ হাজার ২৫০ টাকা। সাভারের ‘সাভার সিটি টাওয়ার’ নামে ১০ তলা ভবনটি করা হয় ২৬ শতক জমির ওপর। কামরুল হাসানসহ তিন জনের মালিকানাধীন এ ভবন। যার মূল্য ৬৯ লাখ ৫৪ হাজার ৪৪০ টাকা। চট্টগ্রামের চান্দগাঁও থানাধীন চান্দগাঁও মৌজায় চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের বাস্তবায়নাধীন অনন্যা আবাসিক এলাকায় ৩ হাজার ৫৯৮.৫৬ বর্গফুট আয়তনের এ-২৫৯নং প্লট; যার মূল্য দেখানো হয় ৩১ লাখ ৬২ হাজার ৫০০ টাকা।
অস্থাবর সম্পদের মধ্যে কামরুল হাসানের সোনালী ব্যাংক লিমিটেড চট্টগ্রাম ওয়েজ আর্নার্স করপোরেট শাখায় আছে তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক ১৫ লাখ টাকা করে মোট ৩০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র।
দুদক কর্মকর্তা মো. এমরান হোসেনের আদালতে করা আবেদনে বলা হয়, প্রাথমিক অনুসন্ধান প্রতিবেদন দাখিলের পর থেকে অভিযোগ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা তাদের নামে অসাধু উপায়ে অর্জিত অপরাধলব্ধ সম্পদ হস্তান্তর/বিক্রি করার চেষ্টা করছেন বলে নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা যায়। অপরাধলব্ধ আয়ের মাধ্যমে অর্জিত সম্পদ/সম্পত্তির বিষয়ে দ্রুত কোনও ব্যবস্থা গ্রহণ না করা হলে তা বেহাত হয়ে রাষ্ট্র ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এ জন্য দুর্নীতি দমন কমিশন এসব স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি ক্রোক/অবরুদ্ধ করা একান্ত প্রয়োজন।