তোমাদের ১৫ মিনিট সময় দেওয়া হলো। ১৫ মিনিটের মধ্যে তোমাদের পরিবারকে ‘খোদা হাফেজ’ বল। তোমাদের মৃত্যুবরণ করতে হবে- কোটা আন্দোলন ঘিরে সংঘাত-সহিংসতার সময় বিটিভি ভবনের সামনে দায়িত্বরত বিজিবি দলকে এভাবে হুমকি দিয়েছিল হামলাকারীরা। গতকাল বৃহস্পতিবার ঢাকায় বিদেশি কূটনীতিকদের ব্রিফিংয়ের পর সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেন সেদিনের পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করেন। প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব নাঈমুল ইসলাম খান এ সময় পররাষ্ট্রসচিবের সঙ্গে ছিলেন।
নিরাপত্তাবাহিনীর গুলি করা নিয়ে বিভিন্ন দেশের উদ্বেগ বিষয়ে প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্রসচিব উদাহরণ হিসেবে বিটিভিতে হামলার কথা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, বিটিভিতে হাজার হাজার লোক ঢুকেছিল। এর মধ্যে যদি ক্লিপগুলো দেখেন, আপনাদেরও আমরা দিতে পারি।
সেখানে দেখা গেছে, বেশির ভাগই ছাত্র নয়। তারা সেখানে তাণ্ডবলীলা চালিয়েছে। সেখানে যখন বিজিবির প্রথম একটি দল গিয়েছিল, তখন সেই দলকে তারা হামলা করতে গিয়েছিল। সে সময় দ্বিতীয় দলটি গিয়েছিল।
পররাষ্ট্রসচিব বলেন, সেই দ্বিতীয় দলটির যে ভিডিও আমরা দেখেছি, আজ তাদের দলনেতাও আমাদের কাছে ব্যাখ্যা করে গেছেন। ছবিগুলো দেখলে দেখা যাবে, তারাও কিন্তু প্রথম অবস্থায় আলাপ-আলোচনা করছে। হামলাকারীরা কিন্তু খুব কাছাকাছি চলে এসেছে।
মাসুদ বিন মোমেন বলেন, অস্ত্রধারী নিরাপত্তা বাহিনীর কাছাকাছি বিশাল একটি গোষ্ঠী চলে আসায় ঝুঁকি তৈরি হয়েছিল। তারা বিজিবির এপিসি ও গাড়ি দখল করে নিয়েছে বা পুড়িয়ে দিয়েছে।
পররাষ্ট্রসচিব বলেন, বিটিভি গুরুত্বপূর্ণ এলাকা। সেটি রক্ষার চেষ্টা করা হচ্ছিল। কিন্তু সেখানে নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে যে ভাষা তারা প্রয়োগ করছিল, তা খুবই অশ্রাব্য, শোনার মতো না। তারা তাদের নানাভাবে চাপ দিচ্ছিল, ধাক্কা দিচ্ছিল। গালাগাল করছিল।
পররাষ্ট্রসচিব বলেন, তখন এক পর্যায়ে সেখানে উপস্থিত ম্যাজিস্ট্রেটের অনুমতি নিয়ে ফাঁকা গুলি করে। ফাঁকা গুলির পর চারদিক থেকে তারা তাদের (নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের) দিকে এগিয়ে আসছিল। তারা বলছিল, তোমাদের ১৫ মিনিট সময় দেওয়া হলো। ১৫ মিনিটের মধ্যে তোমাদের পরিবারকে খোদা হাফেজ বলো। তোমাদের মৃত্যুবরণ করতে হবে।
মাসুদ বিন মোমেন বলেন, পরিস্থিতির এমন পর্যায়ে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা গুলি করার জন্য প্রস্তুত ছিলেন, কিন্তু তাঁদের অধিনায়ক কাউকে গুলি করতে দেননি। তিনি নিজে কয়েকজনের পা লক্ষ্য করে গুলি করেন। এতে কয়েকজন আহত হয়। সে সময় পরিস্থিতি সামাল দিতে না পারলে পুরো বিটিভি ভবন ধ্বংস হত।
পররাষ্ট্রসচিব বলেন, গুলি ছোড়ার ঘটনা খুবই কম আছে। যা হয়েছে আত্মরক্ষার্থে, প্রতিষ্ঠানকে বাঁচানোর জন্য।
পররাষ্ট্র সচিব আরো বলেন, কিছু কিছু গুজব আছে। যেমন হেলিকপ্টার থেকে গুলি করা হয়েছে। যে ভিডিওটি দেখিয়ে প্রচারণা চালানো হচ্ছে তা বিদেশি কূটনীতিকদের দেখিয়ে ব্যাখ্যা করা হয়েছে।
মাসুদ বিন মোমেন বলেন, চার বছরের যে শিশুটির র্যাবের হেলিকপ্টার থেকে ছোঁড়া গুলিতে মৃত্যু হয়েছে বলা হচ্ছে সেটি হিসাবে মিলছে না। যে অ্যাঙ্গেলে গুলি এসে লেগেছে তার সঙ্গে মিলেনা। কারণ গুলি আঁকা বাঁকা পথে চলে না। অন্য কোনো জায়গা থেকে এসেছে।
পররাষ্ট্র সচিব বলেন, আরেকটি ভিডিওতে দেখা যায় পুলিশ অনেক দূরে চলে গেছে। হঠাৎ একজন পড়ে গেল। গুলিগুলো কে করেছে শেষ পর্যন্ত তদন্তের মাধ্যমেই জানা যাবে।
এদিকে ঢাকায় কর্মরত কূটনীতিকদের জন্য আয়োজিত ব্রিফিংয়ে বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে বিভিন্ন বিষয়ে সরকারের ব্যাখ্যা জানতে চেয়েছেন বিদেশিরা। গতকাল রাষ্ট্রীয় অতিথিভবন পদ্মায় পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয় আয়োজিত ওই ব্রিফিংয়ে গণগ্রেপ্তার, বলপ্রয়োগ, বাকস্বাধীনতা, র্যাবের হেলিকপ্টার থেকে গুলি ছোঁড়ার মতো বিষয়ে জানতে আগ্রহী ছিলেন বিদেশি কূটনীতিকরা। পরিস্থিতি সম্পর্কে সরকারের অবস্থান ব্যাখ্যা করেন পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন ও প্রধানমন্ত্রী প্রেস সচিব নাঈমুল ইসলাম খান। তারা বিভিন্ন তথ্য প্রমানের মাধ্যমে অনলাইন ও অফলাইনের প্রচারিত গুজবের বিষয়গুলোর কূটনীতিকদের বুঝিয়ে দেন।
যুক্তরাজ্য, চীন, সুইডেন, কাতার, ডেনমার্ক, সুইজারল্যান্ড, ভারত, রাশিয়া, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, ফ্রান্স, ভারত, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ কয়েকটি দেশ ও উন্নয়ন সহযোগিদের রাষ্ট্রদূত, হাইকমিশনার ও প্রতিনিধিরা ব্রিফিংয়ে উপস্থিত ছিলেন।
ব্রিফিং শেষে পররাষ্ট্র সচিব মাসুম বিন মোমেন সাংবাদিকদের বলেন, সামপ্রতিক ঘটনা নিয়ে দেশে এবং বিদেশে নানা গুজব ছড়াচ্ছে সেগুলো স্পষ্ট করতে বিদেশি মিশনগুলোর সঙ্গে সম্পৃক্ততা অব্যাহত রাখবে সরকার। চলমান ঘটনা নিয়ে সরকারের ব্যাখ্যা জানতে অনেক দেশ আগ্রহী ছিল। গ্রেপ্তারের সংখ্যা, অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ হচ্ছে কি না, বাকস্বাধীনতা আছে কি না—এসব বিষয়ে প্রশ্ন রয়েছে কয়েকটি দেশের।
মাসুদ বিন মোমেন বলেন, কোটা সংস্কার আন্দোলন নিয়ে বিদেশি কূটনীতিকদের আমরা হালনাগাদ তথ্য ও ভিডিও দেখিয়েছি। আমরা জানিয়েছি, হেলিকপ্টার থেকে র্যাব গুলি করেনি। এছাড়া আন্দোলনের সময় বিজিবি ও পুলিশের ভূমিকা কী ছিল, সেটাও তুলে ধরেছি। আমরা তাদের কাছে ভিডিও সরবরাহ করেছি। তিনি বলেন, আন্দোলন নিয়ে দেশে বিদেশে গুজব প্রচারণা চলছে। তাই তাদের সঠিক তথ্য দিয়েছি।
পররাষ্ট্র সচিব জানান, কূটনীতিকদের সামনে আমরা আমাদের অবস্থান তুলে ধরেছি। আমরা জানিয়েছি, আন্দোলনে মৃত্যুর ঘটনায় বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন কাজ শুরু করেছে। কমিশন সুষ্ঠুভাবে প্রতিটি ঘটনা তদন্ত করবে।
তিনি বলেন, কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে চলা সহিংসতায় হতাহতের ঘটনায় বাংলাদেশে গঠিত তদন্ত কমিটিকে জাতিসংঘ কারিগরি সহায়তা করতে চাইলে আপত্তি নেই সরকারের। তবে আলাদা কোনো তদন্ত কমিটিতে এখনই উৎসাহ নেই।
এক প্রশ্নের উত্তরে পররাষ্ট্রসচিব জানান, বিদেশিদের এখানে বিনিয়োগ আছে। ইন্টারনেট বন্ধ ছিল। এসব নিয়ে তাদের উদ্বেগ রয়েছে। আমরা বিদেশিদের জানিয়েছি, শান্তিপূর্ণভাবে সমাবেশে কোনো বাধা দেওয়া হচ্ছে না।
পররাষ্ট্র সচিব জানান, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী কোটা সংস্কার আন্দোলনে এখন পর্যন্ত প্রায় ১৫০ জন মারা গেছেন। এর মধ্যে শিক্ষার্থী ২৫ জন।
আন্দোলনকারীদের কর্মসূচিতে বাধার বিষয়ে পররাষ্ট্র সচিব বলেন, যেসব জায়গায় শান্তিপূর্ণ সমাবেশ করছে সেখানে বাধা দেওয়া হচ্ছে না।
অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব নাঈমুল ইসলাম খান বলেন, সরকারের প্রতি বিদেশিদের কোনো অনাস্থা নেই। আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্কে কোনো সমস্যা নেই। সবাই সরকারের সঙ্গে আছে।