বৈষম্যবিরোধী কোটা সংস্কার ছাত্রআন্দোলন অত্যন্ত যৌক্তিক এবং গুটিকতক সুবিধাভোগী ছাড়া আপামর জনসাধারণের নিরঙ্কুশ সমর্থন ছিল। কারণ সরকারি চাকরিতে অযৌক্তিক কোটা পদ্ধতি যত্রতত্র ব্যবহারের ফলে মেধার সমতা অক্ষুণ্ণ না থাকার কুফল এবং শিক্ষিত বেকারত্বের সংখ্যা দিনকে দিন বৃদ্ধি পাওয়ায় এই প্রথাটির যথাযথ সংস্কার যুক্তিসঙ্গতভাবেই প্রয়োজন ছিল। তাই বেশ কিছুকাল ধরেই কোটা সংস্কারের এই ধারণাটি মানুষের মাঝে ভাবান্তর যোগায়।
যুগ এবং সময়ের চাহিদা অনুযায়ী বেশ কয়েকবারই এই কোটা পদ্ধতির বিরুদ্ধে ছাত্রসমাজ রুখে দাঁড়িয়েছে এবং জনমনে অসন্তোষের বীজ দানা বেঁধেছিল অনেক আগে থেকেই। অতীতেও এই বিষয় নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে এবং এই বিষয় নিয়ে কঠোর আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে। কিন্তু যৌক্তিকভাবে কোটা পদ্ধতির সংস্কার কোনোকালেই ফলপ্রসূ হয়নি। যার খেসারত দিতে হলো স্বাধীনতা যুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তিকে খুব ন্যাক্কারজনকভাবে।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে বাঙালির মুক্তির জন্য যাঁরা জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করেছিলেন তাঁদের অবদান অক্ষুণ্ণ রেখে এই অযৌক্তিক কোটা প্রথাকে সময় এবং কার্যকারণ সম্পর্কের সাথে সামঞ্জস্য রেখে অনেক আগেই এর মুণ্ডুপাত করা যেত। ২০১৮ সালে যখন এই বিষয় নিয়ে ছাত্র আন্দোলন হয় এবং এই বিষয়ে সমাধানে উপনীত হয় তখনই যুগোপযোগী সংশোধন নিশ্চিত করাই ছিল অধিকাংশ মানুষের কাম্য।তবে কোটা প্রথাকে একেবারে বিলুপ্ত করে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর অদূরদর্শী বক্তব্য এবং হঠকারী সিদ্ধান্ত অত্যন্ত প্রশ্নবিদ্ধ ছিল।
কারণ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে যে দেশ স্বাধীন হয়েছে সেখানে স্বাধীনতা ও মুক্তিযোদ্ধাদের মান অক্ষুণ্ণ রাখা বড্ড প্রয়োজন ছিল।তাছাড়া একটা উন্নয়নশীল দেশের পুরুষতান্ত্রিক সমাজে কর্মক্ষেত্রে নারী-পুরুষের মধ্যে সমন্বয় সাধন করতে, অনগ্রসর গোষ্ঠীকে উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় সামিল হতে সরকারি চাকরিতে কিছু সংখ্যক কোটা প্রথা টিকিয়ে রেখে সংস্কার জরুরি ছিল।
কিন্তু তৎকালীন সরকার এবং তার অঙ্গসংগঠন ও চালিকাশক্তিগুলো কোনো এক অজানা কারণে সবকিছুকেই দমিয়ে রাখতে চেয়েছে বারবার। এটা নিয়ে বিতর্কের অবকাশ রেখে সিদ্ধান্তে পৌঁছানোতে আদালতের শরণাপন্ন হওয়ার প্রতি ইঙ্গিত, উস্কানিমূলক স্লোগান এবং আন্দোলনে উসকে দিয়ে ছাত্রদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করেছে; আর এরূপ সংঘাতের মধ্য দিয়ে সবকিছু ফয়সালা করার যে চেষ্টা ও অভিপ্রায়, সেই সংস্কৃতি যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। এর ফলাফলই বর্তমান পরিণতির সূত্রপাত ঘটিয়েছে। কথায় আছে- ‘শত্রুর শেষ রাখতে নেই’, ঠিক একইভাবে জনরোষ সৃষ্টি করে এমন কিছু ঘটনার সুরাহা কখনো যেনতেন প্রকারে করা উচিত না। তার প্রতিফল আমরা প্রত্যক্ষ করলাম সরকার উৎখাত, ভয়ংকর সহিংসতা ও জানমালের ক্ষতিসাধনের মধ্য দিয়ে।
একটা আদর্শ পরিবার যেমন নিঃসন্দেহে তাদের সন্তানসন্তুতিকে মানুষের মতো মানুষ করার লড়াইয়ে সর্বোচ্চ সতর্কতা ও যত্নের প্রয়োগ ঘটায়। তেমনি কোনো দেশ ও জাতিরও প্রধান কাজ হচ্ছে যুবসমাজকে নিয়ন্ত্রণ করা এবং শিক্ষার্থীদের জীবনমানের উন্নয়নের নিমিত্তে সর্বময় সুষ্ঠু সহাবস্থান নিশ্চিত করা। কারণ তারাই দেশের কেন্দ্রবিন্দু এবং তাদেরকে বেষ্টনী করেই রাষ্ট্রীয় গতি ধাবমান থাকে।
তাই সময় ও কাল ভেদে তাদের চাহিদা, দাবি-দাওয়া, যৌক্তিকতা ও অযৌক্তিকতার আলোকে মূল্যায়ন করতে পারা পরিবার, দেশ,জাতি, সমাজ ও রাষ্ট্রের কর্তব্য। এর দরুন বিগত সরকার কোটা সংস্কার আন্দোলনকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে আদালতের রায়ের উপর নির্ভর করতে ছাত্রসমাজকে বারবার উদ্বুদ্ধ করেছিল। কিন্তু আদালত ও বিচারের প্রতি অনাস্থা আমাদের মজ্জাগত। যার ফলশ্রুতিতে আদালতের রায়ের উপর ভরসা হারিয়ে প্রতিহিংসামূলক ষড়যন্ত্রের নীল নকশা তৈরি হতে থাকে দেশে এবং বিদেশে বসে।
কোটা সংস্কার আন্দোলনকে নিবৃত্ত করতে সরকারের ঊর্ধ্বতন মহল অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্তে উপনীত হয় এবং কর্তাব্যক্তিদের উস্কানীমূলক বক্তব্য ও ভাষণ আরও বেশি এই আন্দোলনকে বেগবান করে তোলে।
সরকারের বালখিল্যতার অবসরে তৃতীয় শক্তি সুযোগ পেয়ে যায় এবং তারা ছাত্রদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে ধুম্রজালে তাদের আবদ্ধ করে ফেলে। তবে মনে রাখা ভালো, এই আন্দোলনটি প্রথম থেকেই কোটা সংস্কার আন্দোলন ছিল না। এই বিষয়টি বুঝতে সাধারণ জনগণ নারাজ ছিল।
ফলে জীবনহানি ঘটতে থাকে; আর লাশ ফেলানোই তৃতীয় শক্তির মূল পূঁজি এবং এই লাশের মিছিল ছাত্রজনতাকে আরও বেশি আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ করে তোলে এবং মরণপণ লড়াইয়ে তারা একের পর এক দফা ও কর্মসূচি পেশ করতে থাকে। এই ছাতজনতার সঙ্গে সম্পৃক্ত হয় নানা শ্রেণি, পেশাজীবীর মানুষ। তাদের মনে একটাই ক্ষোভ খুনির যথাযোগ্য শাস্তি নিশ্চিত করা। কিন্তু সরকারি দল এখানেও ভুল করে বসে। রংপুরের ছাত্র আবু সাঈদের হত্যা ও হত্যাকারী সনাক্তে কালবিলম্ব করা জনরোষ সৃষ্টিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে এবং আবু সাঈদের মৃত্যুর মঞ্চ যে আগে থেকেই তৈরি ছিল এইটুকু অনুধাবন করতেও ব্যর্থ হয় প্রশাসন। মূলত জনসম্মুখে আবু সাঈদের আত্মহননের ট্রাজিক পরিণতির চরম মাশুল গুনতে হলো বিগত সরকার ও তার সাঙ্গপাঙ্গরাদের।
ফলে ওঁৎ পেতে থাকা দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রকারীরা ডিজিটাল প্লাটফর্ম ব্যবহারের মাধ্যমে সমস্ত জনশক্তিকে গুজবের জালে বেধে ফেলল এবং এই গুজব সৃষ্টিকারী মহল এই আন্দোলনকে বেগবান করতে ও জনগণকে প্রাণপণ লড়াইয়ের রসদ সংগ্রহ করতে সবচেয়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। তাছাড়া সরকারি গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর ব্যর্থতা চোখে পড়ার মতো; বিপুল সংখ্যক মানুষকে একত্রিত হওয়ার পথে কোনো বাঁধা না থাকা এবং গোয়েন্দা বিভাগের যথোপযুক্ত তথ্য আদান-প্রদান না থাকায় এই আন্দোলনে জনগণ ও সুযোগসন্ধানীদের যোগ দেেওয়া সহজসাধ্য হয়ে ওঠে। ছাত্রলীগকে প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করিয়ে ছাত্রদের প্রতিহত করার যে নির্মম অপশাসন তা ভয়াবহ পরিণতি ডেকে এনেছে।
বৈষম্যবিরোধী কোটা সংস্কার আন্দোলন সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীর ব্যানারে অনুষ্ঠিত হয়েছে এবং নারীদের দশ শতাংশ কোটা বরাদ্দ রাখা সত্ত্বেও তারাও এই আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছে। তারা এই ক্ষেত্রে জোরগলায় দাবি করেছে যে,আমাদের কোনো কোটা চায় না। এখানেই এই আন্দোলনের মিথ্যাচার ধরা পড়েছে। তারপর একের পর এক দাবি পেশ করা ও সরকার সেগুলো মেনে নেওয়ার পরেও কর্মসূচী বাতিল না করা এবং আবার নতুন দফা ও কর্মসূচী পেশ করা, পুলিশ হেফাজতে আন্দোলন না করার শর্ত দিয়েও আবার আন্দোলনে ঝাপিয়ে পড়া, নানারকম সহিংস কর্মকাণ্ড দেখে সহজেই অনুমেয় যে, এটা শুধু বৈষম্যবিরোধী কোটা সংস্কার আন্দোলন না।এর আড়ালে খেলে চলেছিল একাত্তরের পরাজিত শক্তি,,দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে থাকা রাজনৈতিক দল, দেশি-বিদেশি আততায়ীরা।তারা সাধারণ ছাত্রদের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে সরকারের পতন ঘটিয়ে তাদের উদ্দেশ্য হাসিল করতে মরিয়া হয়ে ওঠে। বর্তমানে রাষ্ট্রের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টামণ্ডলীর কুশীলবদের কর্মকাণ্ড ও রাষ্ট্র ভাবনা দেখে তা সহজেই অনুমান করা যাচ্ছে।
মোট কথা, এই আন্দোলনে পরাজিত শক্তির ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ, অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্ত নেওয়া , নিজেদের শক্তিমত্তার প্রতি অতিরিক্ত বিশ্বাস, সময়মতো পদক্ষেপ গ্রহণ করতে ব্যর্থ হওয়া, আনাড়ি এবং অযোগ্য ব্যক্তির চিন্তাকে আন্দোলন থামাতে প্রয়োগ করা ও তাদের সাহচর্য সরকার পতন ঘটাতে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে।
আর মিথ্যাচার, শঠতা, গুজবের জাল বিছিয়ে জনগণের সহানুভূতি লাভের মধ্য দিয়ে তথাকথিত গণ-অভ্যুত্থান ছাত্র আন্দোলনকে বিজয় ছিনিয়ে আনতে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। পরিশেষে বলতে পারি, অপরিণত বয়সের মিথ্যে অহংবোধে জড়িয়ে যে বিজয়ের মধ্য দিয়ে দেশটি পথ হারালো, বাঙালি জাতিকে অন্ধকারের পরাকাষ্ঠে নিক্ষেপ করল তা হয়তো অচিরেই বুঝতে পারবে জনগণ। কিন্তু ততোদিনে দেশের বিপুল পরিমাণ ক্ষতিসাধন ও মানবজীবন অকল্যাণের ছত্রছায়ায় নিপতিত হয়ে পড়বে।
লেখক : কবি ও প্রাবন্ধিক