বিভিন্ন মামলায় সাজাপ্রাপ্ত এসব বন্দি ও আসামির মধ্যে ১ হাজার ৩৩২ জনকে গত শনিবার পর্যন্ত কারাগারে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। এখনো পলাতক আছেন ৯০৯ জন।
কারাগার সূত্র বলছে, পলাতক বন্দিদের বিরুদ্ধে ডাকাতি, হত্যা, অস্ত্র, মাদক, ধর্ষণ, নারী নির্যাতনসহ বিভিন্ন অভিযোগে ও সন্ত্রাসবিরোধী আইনে মামলা রয়েছে। বিশ্লেষকেরা বলেন, এই বন্দিদের মধ্যে দুর্ধর্ষ ব্যক্তিরা আবার নানা ধরনের অপরাধ সংঘটিত করতে পারেন, যা আইনশৃঙ্খলার অবনতির কারণ হতে পারে।
গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটার আগে–পরে দেশের কয়েকটি কারাগারে বিশৃঙ্খলা–বিদ্রোহ করেন বন্দিরা। নরসিংদী কারাগারসহ কোনো কোনোটিতে চালানো হয় বাইরে থেকে হামলা–ভাঙচুর। এ পরিস্থিতিতে পাঁচটি কারাগার থেকে ২ হাজার ২৪১ বন্দি পালিয়ে যান। তাঁদের মধ্যে মৃত্যুদণ্ড, যাবজ্জীবন, বিভিন্ন মেয়াদে সাজা পাওয়া বন্দীসহ বিচারাধীন মামলার আসামিরা আছেন।
এসব বিষয়ে শনিবার যোগাযোগ করা হলে কারা মহাপরিদর্শক (আইজি প্রিজন) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ মো. মোতাহের হোসেন বলেন, যাঁরা বিশৃঙ্খলা করে পালিয়েছিল, এরই মধ্যে তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। ফলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাঁদের অনেককে শনাক্ত করে আইনের আওতায় নিয়ে এসেছে। আবার অনেকে আত্মসমর্পণ করেছেন।
যাঁরা বিশৃঙ্খলা করে পালিয়েছিল, এরই মধ্যে তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। ফলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অনেককে শনাক্ত করে আইনের আওতায় নিয়ে এসেছে। আবার অনেকে আত্মসমর্পণ করেছেন। পাঁচ শতাধিক বন্দীকে এখন কারাগারে ফেরাতে বা আইনের আওতায় আনতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে কারা কর্তৃপক্ষ নিয়মিত যোগাযোগ রাখছে।
মো. মোতাহের হোসেন আরও বলেন, পালিয়ে যাওয়া পাঁচ শতাধিক বন্দিকে এখন কারাগারে ফেরাতে বা আইনের আওতায় আনতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে কারা কর্তৃপক্ষ নিয়মিত যোগাযোগ রাখছে। ধীরে ধীরে সবাইকে আইনের আওতায় নিয়ে আসা যাবে বলে মনে করেন এই কর্মকর্তা।
কারা অধিদপ্তর ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কয়েকজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বলেন, পালিয়ে যাওয়া বন্দিরা যাতে দেশ ছেড়ে পালাতে না পারেন, সে জন্য দেশের প্রতিটি ইমিগ্রেশনে তাঁদের বিষয়ে তথ্য দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে চলমান যৌথ অভিযানেও তাঁদের গ্রেপ্তার করার চেষ্টা চলছে।
কারাগার সূত্রগুলো জানায়, ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের আগে–পরে পাঁচটি কারাগার থেকে পালিয়েছেন বন্দিরা। এর মধ্যে চারটিতেই বন্দিরা ভেতর থেকে বিশৃঙ্খলা–বিদ্রোহ করেন।
এ পাঁচ কারাগারের একটি নরসিংদী জেলা কারাগার। সেখানে ১৯ জুলাই কয়েকশ লোক বাইরে থেকে কারা ফটক ভেঙে ভেতরে ঢুকে সেলগুলো খুলে দেন। ধরিয়ে দেন আগুন। এতে ৯ জঙ্গিসহ ৮২৬ বন্দী পালিয়ে যান। তাঁদের মধ্যে শনিবার পর্যন্ত ৬১৯ জনের মতো আত্মসমর্পণ করেছেন। এ ছাড়া, তিন জঙ্গি গ্রেপ্তার হয়েছেন এবং এখনো ২০৪ জন পলাতক আছেন বলে জানিয়েছেন নরসিংদী জেলা কারাগারের তত্ত্বাবধায়ক মো. শামীম ইকবাল।
পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে একটি পক্ষ সুযোগ নিয়ে এই পলাতক বন্দিদের দিয়ে দেশে অরাজকতা ও গোলমাল সৃষ্টি করবে। দাগি বন্দীরা অপরাধে যুক্ত হলে দেশের জন্য খুব ক্ষতি হবে। তাঁরা নিরাপত্তার জন্য হুমকি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে তাঁদের বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। বন্দীদের গতিবিধির ওপর নজরদারি বাড়িয়ে আইনের আওতায় আনতে হবে তাঁদের।
শেখ হাসিনার সরকারের পতনের খবর দেশের কারাগারগুলোয়ও ছড়িয়ে পড়লে যে কয়টিতে বন্দীরা মুক্তির দাবিতে বিক্ষোভ–বিদ্রোহ করেন, সেগুলোর একটি গাজীপুরে অবস্থিত কাশিমপুর হাইসিকিউরিটি কারাগার। ৬ আগস্ট বিদ্রোহ শুরু করেন তাঁরা। একপর্যায়ে ২০৩ বন্দী পালিয়ে যান। তাঁদের মধ্যে ৮৪ জন মৃত্যুদণ্ড ও যাবজ্জীবন সাজা পাওয়া ব্যক্তি। শনিবার পর্যন্ত এ কারাগারের ২০০ বন্দী ফেরত আসেননি।
কাশিমপুর হাইসিকিউরিটি কারাগারের কারা তত্ত্বাবধায়ক আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, পালিয়ে যাওয়া বন্দীদের তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে তাঁরা জেনেছেন। প্রক্রিয়া শেষে দুজনকে কারাগারে ফেরত আনা হয়েছে। ওই ঘটনায় তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে।
৫ আগস্ট সন্ধ্যায় কয়েক শ লোক সাতক্ষীরা কারাগারের সীমানাপ্রাচীর টপকে ভেতরে ঢুকে পড়েন। তাঁরা প্রধান ফটকসহ কারাগারের সব সেলের তালা ভেঙে ৫৯৬ বন্দীকে বের করে নিয়ে যান। কারাগারটির তত্ত্বাবধায়ক মোহাম্মদ এনায়েতউল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, ৫২৯ বন্দি আত্মসমর্পণ ও গ্রেপ্তার হয়েছেন। এখন ২ নারীসহ ৬৭ বন্দী পলাতক আছেন।
একই দিন বিকেলে শেরপুর জেলা কারাগারের প্রধান ফটক ভেঙে ভেতরে ঢুকে ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করেন দুর্বৃত্তরা। এ সুযোগে ৫১৮ বন্দি পালিয়ে যান। শনিবার কারাগারের তত্ত্বাবধায়ক মো. হুমায়ুন কবির বলেন, এখন পর্যন্ত ৯১ বন্দী আত্মসমর্পণ করেছেন। গ্রেপ্তার করা হয়েছে ১৫ বন্দিকে। এখনো পলাতক ৪১২ বন্দি।
এদিকে, ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানের দুই দিন পর ৭ আগস্ট দুপুরে কুষ্টিয়া জেলা কারাগারে বন্দীরা বিদ্রোহ করেন। একপর্যায়ে কারারক্ষীদের ওপর হামলা চালিয়ে ৯৮ বন্দি পালিয়ে যান। শনিবার কারা তত্ত্বাবধায়ক আ. বারিক বলেন, এ পর্যন্ত ৭২ বন্দি গ্রেপ্তার হয়েছেন বা আত্মসমর্পণ করেছেন। ২৬ বন্দি পলাতক আছেন।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে কারা অধিদপ্তরের সাবেক উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি-প্রিজন) মেজর (অব.) শামসুল হায়দার ছিদ্দিকী বলেন, কিছু বন্দি ফিরে এসেছেন। যেসব বন্দীর সাজা কম ও অর্ধেক সাজা খেটেছেন তাঁরা কারাগারে ফেরত এসেছেন। যাঁরা জঙ্গি, মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত, দাগি আসামি, তাঁরা ফেরত আসেননি। তাঁরা বিভিন্ন জায়গায় আত্মগোপন করে আছেন। এটা সবার জন্য ক্ষতিকর।
শামসুল হায়দার ছিদ্দিকী আরও বলেন, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে একটি পক্ষ সুযোগ নিয়ে এই পলাতক বন্দিদের দিয়ে দেশে অরাজকতা ও গোলমাল সৃষ্টি করবে। দাগি বন্দিরা অপরাধে যুক্ত হলে দেশের জন্য খুব ক্ষতি হবে। তাঁরা নিরাপত্তার জন্য হুমকি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে তাঁদের বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। বন্দিদের গতিবিধির ওপর নজরদারি বাড়িয়ে আইনের আওতায় আনতে হবে তাঁদের।
সূত্র : প্রথম আলো (রিপোর্টার : নজরুল ইসলাম)