সাম্রাজ্যবাদের চোখ, ভূ-রাজনীতির অন্য পৃষ্ঠা

: স্বপ্নীল ফিরোজ
প্রকাশ: ৬ মাস আগে

তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে পশ্চিমা দেশগুলোর বহুমুখী কৌশল বেশ পুরনো। এই কৌশলের মূল লক্ষ্য হচ্ছে তৃতীয় বিশ্বের সম্পদ ও রাজনৈতিক ক্ষমতা এমনভাবে নিয়ন্ত্রণ করা, যাতে তারা নিজেদের প্রভাব বজায় রাখতে পারে এবং সেই দেশগুলোর মানুষ কখনও পশ্চিমাদের প্রকৃত অভিসন্ধি বুঝতে না পারে। এর জন্য তারা বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে, যেগুলো সাদা চোখে ধরা পড়ে না।

পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদ যুগের পর থেকেই দেখা যায়, তারা বিভিন্ন উন্নয়নশীল দেশকে প্রথমে দুর্বল অর্থনৈতিক কাঠামোর দিকে ঠেলে দেয়, তারপর সেই দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের প্রভাব বাড়ায়। পরবর্তীতে উন্নয়ন, মানবাধিকার এবং গণতন্ত্রের নাম করে সেই দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করে। এই হস্তক্ষেপের উদ্দেশ্য সবসময় মানবতার স্বার্থ নয়, বরং পশ্চিমাদের নিজেদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও ভূরাজনৈতিক আধিপত্যকে দীর্ঘমেয়াদে ধরে রাখা।

একটি দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তারের ক্ষেত্রে তারা একজন বা একাধিক ব্যক্তিকে কেন্দ্র করে দাবার গুটি হিসেবে ব্যবহার করে। এই ব্যক্তিরা প্রাথমিকভাবে হয়তো সেই দেশের মানুষের দৃষ্টিতে এক ধরনের আদর্শ বা মুক্তির প্রতীক হিসেবে উদ্ভাসিত হন, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তারা হয় পশ্চিমাদের পরিকল্পনার একেকটি অংশ। এই প্রক্রিয়ায়, একজন ব্যক্তি হয়ে ওঠে দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে পশ্চিমাদের প্রভাব বাড়ানোর হাতিয়ার।

(বাংলাদেশে ড. ইউনুসের ভূমিকা নিয়ে একই ধরনের আলোচনা করা যায়। নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর থেকেই তিনি দেশের মানুষের কাছে উচ্চ মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হয়েছেন। তার ক্ষুদ্রঋণ উদ্যোগ বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত হয়েছে, তবে এটির প্রভাব নিয়ে মতপার্থক্য রয়েছে। অনেকেই মনে করেন, ক্ষুদ্রঋণ প্রকৃতপক্ষে দরিদ্র মানুষের আর্থিক মুক্তি নয়, বরং তাদের ঋণের ফাঁদে ফেলে রেখে আর্থিক শোষণকে টিকিয়ে রাখার এক কৌশল।পশ্চিমারা এ ধরনের ব্যক্তিদের ব্যবহার করে সেই দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ রাজনীতি এবং অর্থনৈতিক কাঠামোতে হস্তক্ষেপ করে।)

নোবেল শান্তি পুরস্কার বিশ্বের অন্যতম সম্মানজনক পুরস্কার। যদিও এর পেছনে বিশুদ্ধতা এবং মানবিকতার ইতিহাস রয়েছে, তবু এটি কখনো কখনো পশ্চিমাদের দূরদর্শী কৌশলের অংশ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এই পুরস্কারের মাধ্যমে একজন ব্যক্তিকে আর্ন্তজাতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ করা হয় এবং তৃতীয় বিশ্বের সাধারণ মানুষের কাছে একে উত্তম প্রতীকের মতো উপস্থাপন করা হয়। ফলে, জনগণের মনোবল ও দৃষ্টিভঙ্গি সেই ব্যক্তির দিকে অপ্রত্যাশিতভাবে আকৃষ্ট হয়ে যায়। এই কৌশল বিশেষভাবে ব্যবহৃত হয়েছে মিয়ানমারের আং সান সু চি’র ক্ষেত্রে। পশ্চিমারা তাকে এক সময় গণতন্ত্রের প্রতীক হিসেবে উপস্থাপন করেছিল। নোবেল শান্তি পুরস্কার দিয়ে তাকে আর্ন্তজাতিক মহলে প্রতিষ্ঠিত করা হয়, এবং মিয়ানমারের মানুষ তাকে তাদের দেশের উন্নয়নের প্রতীক মনে করে তাকে নিয়ে উৎসাহিত হয়ে ওঠে। কিন্তু পরবর্তীতে দেখা গেছে, তার নেতৃত্বে দেশটি সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে তীব্র সংকটে পড়েছে। রোহিঙ্গাদের ওপর নিপীড়ন এবং গণহত্যার জন্য সুচির নীরব ভূমিকা আর্ন্তজাতিক মহলে বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে এসেছে।

বাংলাদেশে ড. ইউনুসের ভূমিকা নিয়ে একই ধরনের আলোচনা করা যায়। নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর থেকেই তিনি দেশের মানুষের কাছে উচ্চ মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হয়েছেন। তার ক্ষুদ্রঋণ উদ্যোগ বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত হয়েছে, তবে এটির প্রভাব নিয়ে মতপার্থক্য রয়েছে। অনেকেই মনে করেন, ক্ষুদ্রঋণ প্রকৃতপক্ষে দরিদ্র মানুষের আর্থিক মুক্তি নয়, বরং তাদের ঋণের ফাঁদে ফেলে রেখে আর্থিক শোষণকে টিকিয়ে রাখার এক কৌশল।পশ্চিমারা এ ধরনের ব্যক্তিদের ব্যবহার করে সেই দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ রাজনীতি এবং অর্থনৈতিক কাঠামোতে হস্তক্ষেপ করে।

এই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ড. ইউনুসকে নোবেল শান্তি পুরস্কার দেওয়া হয়েছে, যাতে বাংলাদেশের জনগণ তাকে তাদের দেশের উন্নয়নের প্রতীক মনে করে এবং তার নীতি ও আদর্শকে মেনে নেয়। তবে এটা বোঝা দরকার যে, তিনি পশ্চিমাদের হাতে একটি গুটি, যার মাধ্যমে দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কাঠামোকে নিজেদের অনুকূলে আনার চেষ্টা করা হচ্ছে। মালালা ইউসুফজাইয়ের ক্ষেত্রেও একই কৌশল দেখা যায়। তাকে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছে নারীর শিক্ষা ও অধিকারের জন্য তার অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ। যদিও তিনি নারীর অধিকারের পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন, কিন্তু তার এই অবস্থান এবং পরিচিতি পশ্চিমাদের পরিকল্পনার অংশ বলেই অনেকে মনে করেন। মালালাকে পশ্চিমাদের দ্বারা তৈরিকৃত এক নতুন গুটি হিসেবে দেখা যায়, যা তারা ভবিষ্যতে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে কাজে লাগাতে পারে।

তৃতীয় বিশ্বের রাজনীতিতে পশ্চিমা দেশগুলোর প্রভাব বিস্তারের কৌশল অত্যন্ত সূক্ষ্ম এবং সুদূরপ্রসারী। স্থানীয় নেতৃবৃন্দ ও ব্যক্তিত্বদের তারা তাদের এজেন্ট হিসেবে ব্যবহার করে নিজেদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেয়। আং সান সুচি, ড. ইউনুস, এবং মালালা ইউসুফজাই প্রমাণ করে যে, নোবেল পুরস্কারও কখনো কখনো পশ্চিমাদের রাজনৈতিক পরিকল্পনার অংশ হতে পারে। এসব কৌশল সাধারণ মানুষের চোখে ধরা পড়ে না, কিন্তু এর প্রভাব তৃতীয় বিশ্বের রাজনীতি ও সামাজিক কাঠামোকে দীর্ঘমেয়াদে প্রভাবিত করে।

লেখক : টেক্সাস, যুক্তরাষ্ট্র

  • সাম্রাজ্যবাদ
  • #