ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। পরে ৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়। এমন রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর গত সেপ্টেম্বরে দেশে গণপিটুনির ৩৬ ঘটনায় অন্তত ২৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছে আরও ১৪ জনকে। একই মাসে রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনায় সারা দেশে নিহত হয়েছেন অন্তত ১৬ জন, আহত হয়েছেন অন্তত ৭০৬ জন। সেপ্টেম্বর মাসের মানবাধিকার পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে এসব তথ্য তুলে ধরে মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটি (এইচআরএসএস)।
সংগঠনটির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে মানবাধিকার পরিস্থিতির কিছু বিষয়ে উন্নতি ঘটলেও সার্বিক মানবাধিকার পরিস্থিতির আশাব্যঞ্জক অগ্রগতি পরিলক্ষিত হয়নি। বরং কিছু ক্ষেত্রে অবনতি ঘটেছে।
বৃহস্পতিবার (৩ অক্টোবর) সেপ্টেম্বর মাসের মাসিক মানবাধিকার পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে এইচআরএসএস। এতে তারা বলেছে, সেপ্টেম্বরে মানবাধিকার পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, আধিপত্য বিস্তারকেন্দ্রিক রাজনৈতিক সহিংসতা, গণপিটুনিতে মানুষ হত্যা, রাজনৈতিক মামলা ও গ্রেপ্তার, সাংবাদিকদের ওপর আক্রমণ, শ্রমিক হত্যা, বিচারবহির্ভূত হত্যা, কারা হেফাজতে মৃত্যু, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা, সীমান্তে নিরীহ বাংলাদেশি নির্যাতন ও হত্যা এবং নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা অব্যাহত আছে।
দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ এবং নিজেদের সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতে তৈরি করা এইচআরএসএসের এই প্রতিবেদনে বলা হয়, সেপ্টেম্বর মাসে কমপক্ষে ৮৩টি রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনায় নিহত হয়েছেন অন্তত ১৬ জন এবং আহত হয়েছেন কমপক্ষে ৭০৬ জন। সহিংসতার ৮৩টি ঘটনার মধ্যে ৪৫টি ঘটনা ঘটেছে বিএনপির অন্তঃকোন্দলের কারণে, ২৩টি বিএনপি ও আওয়ামী লীগের মধ্যে, ৫টি আওয়ামী লীগের অন্তঃকোন্দলে ও ১০টি ঘটনা ঘটেছে বিভিন্ন দলের মধ্যে। নিহত ১৬ জনের মধ্যে অন্তঃকোন্দলে আওয়ামী লীগের ১ জন ও বিএনপির ৮ জন নিহত হয়েছেন। বাকি ৭ জন নিহত হয়েছেন বিরোধী পক্ষের হামলায়। ১৬ জন নিহতের মধ্যে ১১ জন বিএনপির আর ৫ জন আওয়ামী লীগের কর্মী-সমর্থক। সেপ্টেম্বরে ১১০ জন নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে ধর্ষণের শিকার ৪৪ জনের মধ্যে ১৫ জন ১৮ বছরের কম বয়সী শিশু।
সেপ্টেম্বরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে বা হেফাজতে ৯ জন নিহত হয়েছেন বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। এতে বলা হয়, সারা দেশে আধিপত্য বিস্তার ও দুর্বৃত্তদের হামলায় আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জামায়াতের আরো অন্তত ৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। এসব সহিংসতায় কমপক্ষে ২৫০টি ঘরবাড়ি, যানবাহন ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে। খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটিতে বাঙালি-পাহাড়িদের সংঘর্ষ ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় ৬ জন নিহত ও শতাধিক আহত হওয়ার ঘটনায় পার্বত্য অঞ্চলের মানুষের মধ্যে ভীতিকর পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। খাগড়াছড়িতে সেনাবাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে ২ জন পাহাড়ি নাগরিক নিহত হন। আশুলিয়া, সাভার, গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জে শ্রমিক অসন্তোষের ঘটনায় ১ জন শ্রমিক পুলিশের গুলিতে নিহত ও অনেকে আহত হয়েছেন।
এ ছাড়া অন্তত ১৮টি ঘটনায় ৯০ জন সাংবাদিক সেপ্টেম্বর মাসে নির্যাতন ও হয়রানির শিকার হয়েছেন এবং অন্তত ২১ জন আহত, ২ জন লাঞ্ছিত, ৩ জন হুমকির শিকার ও ২ জন গ্রেপ্তার হয়েছেন। এই সময়ে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর কমপক্ষে ২টি হামলার ঘটনায় ১টি মন্দির ও ৪টি প্রতিমা ভাঙচুর করা হয়েছে। এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন জেলায় মাজারে হামলা, ভাঙচুর, লুটতরাজ ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় আহত হয়েছেন কমপক্ষে ৯০ জন। সেপ্টেম্বর মাসে ৩৪টি শ্রমিক নির্যাতনের ঘটনায় নিহত হয়েছেন ১৬ জন এবং আহত হয়েছেন কমপক্ষে ১৭৬ জন। সীমান্তে বিএসএফের ৩টি হামলার ঘটনায় ২ জন বাংলাদেশি নিহত ও ৪ জন আহত হয়েছেন এই সময়ে।
প্রতিবেদনের শেষে বলা হয়, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে জনগণের মৌলিক ও সাংবিধানিক অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। আর এসব বিষয় বাস্তবায়ন করতে না পারলে দেশের সার্বিক মানবাধিকার পরিস্থিতি আরো অবনতির দিকে যাবে।