‘আহ! এসবতো পুরনো দিনের ঘটনা মাত্র!’ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতির এক নতুন কৌশল- তা বলাই যায়!, অথচ বাস্তবতা হল, বাংলাদেশের ইতিহাসের একটি সর্বাপেক্ষা গৌরবময় অধ্যায় হল ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ। এই সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতি কেবলমাত্র ভৌগোলিক স্বাধীনতা অর্জন করেনি। বরং এটি ছিল আত্মপরিচয়ের জন্য, রাজনৈতিক অধিকার, সাংস্কৃতিক ও ভাষাগত স্বাতন্ত্র্য রক্ষার জন্য একটি যুদ্ধ। কিন্তু বর্তমান সময়ে কিছু সুবিধাবাদী এবং ক্ষমতাসীন গোষ্ঠী এই মুক্তিযুদ্ধের গুরুত্বকে অস্বীকার বা খাটো করে দেখানোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। তারা মুক্তিযুদ্ধকে ‘পুরনো দিনের ঘটনা’ বলে অভিহিত করছে, যেন এই মহাকাব্যিক ঘটনাটি ইতিহাসের একটি সংক্ষিপ্ত অংশমাত্র, যার বর্তমানের সঙ্গে তেমন কোনো সম্পর্ক নেই।
ইতিহাসের বিকৃতি নতুন কোনো ঘটনা নয়। পৃথিবীর নানা জাতির ইতিহাসেই ক্ষমতাসীন গোষ্ঠী তাদের সুবিধার্থে ইতিহাসকে পুনর্লিখন বা পরিবর্তন করেছে। কিন্তু বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের মতো একটি আবেগময় ও বীরত্বপূর্ণ অধ্যায়কে বিকৃত করার প্রচেষ্টা অত্যন্ত সংকটময়। এই প্রচেষ্টার মূল লক্ষ্য হচ্ছে, দেশের তরুণ প্রজন্মের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মূল্যবোধের গুরুত্বকে কমিয়ে আনা। স্বাধীনতার ৫৩ বছরেরও বেশি সময় পর, কিছু মানুষ বা গোষ্ঠী মুক্তিযুদ্ধকে একটি ‘পুরনো’ ঘটনা হিসেবে উপস্থাপন করার মাধ্যমে সেই ঐতিহাসিক ঘটনাকে প্রাসঙ্গিকতাহীন করে তুলতে চায়। এই প্রচেষ্টা শুধুমাত্র একটি রাজনৈতিক বা সামাজিক ষড়যন্ত্র নয়, বরং এটি একটি সাংস্কৃতিক এবং নৈতিক অপরাধ।
একটি প্রভাবশালী কৌশল হচ্ছে গণমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাগুলোকে খণ্ডিতভাবে বা ভুলভাবে উপস্থাপন করা। কোনো কোনো ক্ষেত্রে, মুক্তিযুদ্ধের নেতাদের ভূমিকা ক্ষুদ্র করা হচ্ছে, এবং তাদের ত্যাগকে উপেক্ষা করা হচ্ছে। এটি একটি সুপরিকল্পিত প্রচেষ্টা, যার মাধ্যমে জাতির সম্মিলিত স্মৃতিকে দুর্বল করার প্রয়াস চালানো হচ্ছে। তারা ১৯৭১-এর স্মৃতিকে ‘২৪ দিয়ে ৭১ মুছে ফেলার’ মাধ্যমে বাস্তবিক অর্থে জাতিকে তার শেকড় থেকে বিচ্ছিন্ন করতে চায়।
অন্য একটি কৌশল হলো, মুক্তিযুদ্ধের বিপরীতে দখলদার শক্তি কিংবা তাদের সহযোগীদের বীরত্ব বা মানবিক দিকগুলোকে অস্বাভাবিকভাবে তুলে ধরা। ইতিহাসের এই বিকৃতি কেবলমাত্র অজ্ঞতাবশত নয়। এটি একটি সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্র, যার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে জাতির মস্তিষ্কধোলাই এবং মুক্তিযুদ্ধের আদর্শকে ধ্বংস করা।
মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি কেবল একটি প্রজন্মের সম্পদ নয়; এটি আমাদের সকলের, বিশেষ করে বর্তমান প্রজন্মের জন্য একটি মহান দায়িত্ব। যখন দখলদার ও তাদের সহযোগীরা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে মুছে ফেলার চেষ্টা করছে, তখন আমাদের করণীয় হচ্ছে সেই ইতিহাসকে আরও গভীরভাবে চর্চা করা এবং নতুন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত চেতনার সঙ্গে পরিচিত করা।
বর্তমানের তরুণ প্রজন্মের একটি বড় অংশ হয়তো মুক্তিযুদ্ধের সময়ের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা নেই। তাই তাদের সামনে সঠিক ইতিহাস তুলে ধরতে হবে। স্বাধীনতা সংগ্রামের বীরত্বগাথা, ত্যাগ ও সাহসিকতার গল্পগুলোকে যত্নসহকারে সংরক্ষণ করা এবং তা বিভিন্ন গণমাধ্যম ও শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে প্রজন্মান্তরে পৌঁছে দেওয়া অত্যন্ত জরুরী।
শিক্ষাব্যবস্থা ও গণমাধ্যম একটি সমাজের মানসিকতা গঠনের অন্যতম প্রধান শক্তি। এই দুটি ক্ষেত্র মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে রোপণ করতে পারে। কিন্তু বর্তমানে আমরা দেখি, অনেকক্ষেত্রে এসব মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের গুরুত্ব সঠিকভাবে প্রতিফলিত হয় না। এর ফলে তরুণরা ঐতিহাসিক সত্য ও মূল্যবোধের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে। তাই, শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস ও এর গুরুত্ব অন্তর্ভুক্ত করা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। পাশাপাশি, গণমাধ্যমগুলোকেও তাদের দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে।
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতির বিরুদ্ধে জাতীয় প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য আমাদের সচেতনভাবে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। এই প্রতিরোধ শুধু রাজনৈতিক বা সামাজিক ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ নয়; এটি একটি সাংস্কৃতিক আন্দোলন। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ এবং আত্মত্যাগের চেতনা যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মধ্যে সমানভাবে প্রোথিত থাকে, তার জন্য আমাদের সাংস্কৃতিক সংগঠন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, এবং সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে।
মুক্তিযুদ্ধকে ‘পুরনো দিনের ঘটনা’ হিসেবে উপস্থাপন করার অপচেষ্টা শুধু ইতিহাসের প্রতি অবমাননা নয়, বরং একটি জাতির আত্মপরিচয়কে মুছে ফেলার ষড়যন্ত্র। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ আমাদের জাতীয় সত্তার কেন্দ্রবিন্দু। এর গুরুত্বকে খাটো করে দেখানোর কোনো চেষ্টা সফল হতে পারে না, যদি আমরা সক্রিয়ভাবে এর বিরুদ্ধে লড়াই করি। ২৪ দিয়ে একাত্তর মুছে ফেলার কৌশল ব্যর্থ করতে আমাদের ঐতিহাসিক চেতনা এবং প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে, যাতে মুক্তিযুদ্ধের সত্যিকারের আদর্শ প্রজন্মান্তরে টিকে থাকে।
লেখক : টেক্সাস, যুক্তরাষ্ট্র থেকে