দেশবরেণ্য ভাস্কর হাবীবা আখতার পাপিয়া ১৯৭৭ সালের ১০ অক্টোবর কিশোরগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ থেকে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করে মাস্টার্স সম্পন্ন করেন। ভাস্কর পাপিয়া একাধিক একক ও দেশে-বিদেশে অনেকগুলো দলীয় প্রদর্শনিতে অংশগ্রহণ করেছেন। নেপাল, মালয়েশিয়া, ভুটান, জার্মানিসহ একাধিক দেশে দলীয় প্রদর্শনিতে তার শিল্পকর্ম আলাদাভাবে মনোযোগ কেড়েছে। স্মৃতি, নারীমুক্তি, স্পেস ও ফর্ম তার ভাস্কর্য নির্মাণের অন্যতম বিষয়। ২০০৮ সালে তার প্রথম একক প্রদর্শনির শিরোনাম ছিলো রিজুভনেশন অব ওম্যানহুড। সেই প্রদর্শনী শিল্পানুরাগীদের কাছে তুমুল প্রশংসা লাভ করে। দ্বিতীয় একক প্রদর্শনি ও সিম্পোজিয়াম সোনাটা অব ওম্যানহুডও একটি ভিন্নধারার আয়োজন হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। ব্রোঞ্জ ও কাঠ মাধ্যমে করা তার কাজগুলো অব্যক্ত কথামালার শৈল্পিক তর্জমা হিসেবে দর্শকের কাছে ধরা দেয়। ছন্দ ও গতিময়তা তার সাম্প্রতিক কাজের অন্যতম বৈশিষ্ট।
বাংলাদেশের ভাস্কর্য চর্চার ইতিহাস অনেক পুরনো হলেও আধুনিক ভাস্কর্য চর্চার শুরু ১৯৪৭ এর দেশভাগের পর। ঠিক একই সময়ে, যখন শিল্পাচার্যের সুচারু দিকনির্দেশনায় শুরু হয়েছিলো চিত্রশিল্পের এক অবিস্মরণীয় যাত্রা। ভাস্কর আব্দুর রাজ্জাক এবং নভেরা আহমেদ প্রায় সমসাময়িক হলেও প্রথম প্রদর্শনিটি করার সুবাদে ১৯৫৯ সালে নভেরা আহমেদই বাংলাদেশে আধুনিক ভাস্কর্যের পথিকৃৎ। তবে এটি দুঃখজনক যে এই মুহূর্তে তার কাজ সেরকম ভাবে আমাদের চোখে পড়ছে না। ঢাকা গবেষক মুনতাসির মামুনের ভাষায় ‘অপরাজেয় বাংলা’ এবং ‘রাজু স্মৃতি ভাস্কর্য’ বাদ দিলে ঢাকা শহরে উল্লেখযোগ্য আর কোনো ভাস্কর্য নেই।
ভাস্কর নভেরা আহমেদের পর বাংলাদেশের নারী ভাস্করদের মধ্যে হাবীবা আখতার পাপিয়া একটি উল্লেখযোগ্য নাম। প্রথম প্রদর্শনী ‘নারীর জয়যাত্রা’ দিয়ে তার আত্মপ্রকাশ। ২০০৮-এর ফেব্রুয়ারি মাসের সেই প্রদর্শনীতে তার ব্রোঞ্জ এবং কাঠের কাজগুলো সমালোচকদের দৃষ্টি কেড়েছিলো। প্রয়াত কবি সমুদ্র গুপ্তের ভাষায়Ñ ‘রমণীয় শরীরের মোচড়গুলো ফ্ল্যামেঙ্গোর বিশাল ডানায় চড়ে ঊর্ধ্বগামী হচ্ছে।‘ তার ‘নারী’ বিষয়টি নির্মিত হয়েছে বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে। নারীর কর্মপ্রবাহ, উৎপাদনশীলতা এবং সৃষ্টিমুখরতা এক গীতিমতায় ভরপুর। ইট ভাঙার নারী শ্রমিক, গৃহকর্মী, ফুটপাতের কিশোরী, বস্তিবাসী নারীর শ্রমক্লিষ্ট মুখ ইত্যাদি। অর্থাৎ সাহিত্য-সংগীতে উপেক্ষিত নারীর সর্বৈব কর্মমুখর যন্ত্রণাকে তিনি ব্রোঞ্জ এবং কাঠ মাধ্যমে স্থায়ী কাঠামোয় উপস্থাপন করেছেন।
তার উপস্থাপনায় অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন অমর ভাস্কর আলবার্তো জিয়াকোমিত্তি এবং জারমেইন রিখিয়ার। ভাস্কর হিসেবে প্রথম দিককার কাজগুলো করার সময় এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি যখন সিডর দুর্গতদের যন্ত্রণা ভাস্কর্যে উপস্থাপন করি তখন নিজেকে সিডরগ্রস্ত মনে হয়।‘ আরেক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘সমাজে নারীর বঞ্চনার মাত্রার কোনো সীমা-পরিসীমা নেই।‘ তিনি সে সময় এক কর্মশালায় বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সামনে কর্মক্ষেত্রে নারীর বঞ্চনার তুলে ধরেছিলেন । একই সঙ্গে আরেক কর্মশালায় ১৯৭১-এর বঞ্চিত নারীদের কথাও বলেছিলেন। তার এই সাহসী ভূমিকাগুলো অত্যন্ত প্রশংসিত হয়েছিল। শিল্পীর সামাজিক দায়িত্ব সম্পর্কে এই ভাস্কর পুরোপুরি সচেতন।
ভাস্কর পাপিয়ার সেসময়ের কয়েকটি বিখ্যাত কাজ ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, বাংলাদেশ হেরিটেজ ফাউন্ডেশন, ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি, শেলটেক এসব প্রতিষ্ঠান সংগ্রহ করেছিল। বিশিষ্ট শিল্প সংগ্রাহক এবং সাবেক পররাষ্ট্র সচিব ওয়ালিউর রহমান এক মন্তব্যে বলেছিলেন, ‘ভাস্কর পাপিয়া খুব তাড়াতাড়ি বক্তব্যকে অনুধাবন করতে পারেন। ত্রিমাত্রিক অবয়বকে তিনি গভীর বক্তব্যধর্মী উপস্থাপনার মাধ্যমে দর্শকদের সামনে তুলে ধরতে সক্ষম। এ কারণেই তিনি সমকালের একজন গুরুত্বপূর্ণ ভাস্কর।’ এক যুগ আগের বিখ্যাত মন্তব্যটি এখন শতভাগ সফল।
জন্মদিনের শুভক্ষণে এক শুভেচ্ছা বার্তায় ভাস্কর হাবীবা আখতার পাপিয়া সকলের কাছে দোয়া প্রার্থনা করেছেন। সামনে আরো একটি বৃহৎ কলেবরের প্রদর্শনি করার ইচ্ছে প্রকাশ করেছেন। বর্তমানে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে তিনি কর্মরত আছেন। শিল্পকলায় পেয়েছেন সরকারি ও বেসরকারি সম্মাননা ও পুরস্কার।
লেখক : সাহিত্যিক ও সংস্কৃতিকর্মী