চলতি বছরের ৯ মাসে দেশে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে পাঁচ হাজার ৪৮৫টি। এসব দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন পাঁচ হাজার ৫৯৮ জন এবং আহত হয়েছেন ৯ হাজার ৬০১ জন। নিহতের মধ্যে নারী ৬৭৭ জন ও শিশু ৭২৯ জন। রবিবার (২০ অক্টোবর) সংবাদমাধ্যমে পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে এ তথ্য জানান রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান।
বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, এ বছর দুই হাজার ৪১টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন এক হাজার ৯২৪ জন, যা মোট নিহতের ৩৪.৩৬ শতাংশ। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার হার ৩৭.২১ শতাংশ। দুর্ঘটনায় এক হাজার ১২১ জন পথচারী নিহত হয়েছেন, যা মোট নিহতের ২০ শতাংশ। যানবাহনের চালক ও সহকারী নিহত হয়েছেন ৬৮৮ জন, অর্থাৎ ১২.২৯ শতাংশ।
এই সময়ে ৮৩টি নৌ দুর্ঘটনায় ১২৪ জন নিহত, ১২৫ জন আহত এবং ১৯ জন নিখোঁজ রয়েছেন। ২৪৩টি রেলপথ দুর্ঘটনায় ২২৭ জন নিহত এবং ২২৩ জন আহত হয়েছেন।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশন ৯টি জাতীয় দৈনিক, ৭টি অনলাইন নিউজ পোর্টাল, ইলেকট্রনিক গণমাধ্যম এবং সংস্থার নিজস্ব তথ্যের ভিত্তিতে এ প্রতিবেদন তৈরি করেছে।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে জানা যায়, নিহতদের মধ্যে পুলিশ সদস্য ২৩ জন, সেনা সদস্য ২ জন, বিজিবি ৬ জন, আনসার সদস্য ৮ জন, গ্রাম পুলিশ ৩ জন, স্কুল-কলেজ-মাদরাসা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ৮৭ জন, প্রকৌশলী ১৭ জন, চিকিৎসক ১১ জন, আইনজীবী ১৩ জন, সাংবাদিক ২৪ জন, কৃষি কর্মকর্তা ২ জন, ভূমি কর্মকর্তা ১ জন, গ্যাসফিল্ড কর্মকর্তা ১ জন, শ্রম ও কর্মসংস্থান ব্যুরোর সহকারী পরিচালক ১ জন, ব্যাংক কর্মকর্তা-কর্মচারী ৬১ জন, এনজিও কর্মকর্তা-কর্মচারী ৯৬ জন, ওষুধ ও বিভিন্ন পণ্যসামগ্রী বিক্রয় প্রতিনিধি ১৩২ জন, স্থানীয় পর্যায়ের বিভিন্ন ব্যবসায়ী ১৮৪ জন, উপজেলা চেয়ারম্যান ১ জন, ইউপি চেয়ারম্যান ও সদস্য ৩ জনসহ স্থানীয় পর্যায়ের রাজনৈতিক নেতা ১১৩ জন, হাফেজ ও ইমাম ১৯ জন, বাউল শিল্পী ২ জন, বিদ্যুতের কর্মচারী ২ জন, রূপপুর পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রের শ্রমিক ৪ জন, পরিবহন শ্রমিক নেতা ৫ জন, পোশাক শ্রমিক ৪১ জন, বন প্রহরী ৪ জন, নির্মাণ শ্রমিক ৪৬ জন, দিনমজুর ১৫ জন, বালু শ্রমিক ১৩ জন, ধান কাটা শ্রমিক ৯ জন, চালকল শ্রমিক ৪ জন, সিএনজি মিস্ত্রি ২ জন, হকার ৬ জন, রাজমিস্ত্রি ১৭ জন, কাঠমিস্ত্রি ৯ জন, নিরাপত্তারক্ষী ১১ জন, সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতাকর্মী ৪ জন, মানসিক ও শারীরিক প্রতিবন্ধী ১৮ জন এবং দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ৬৮৭ জন শিক্ষার্থী নিহত হয়েছেন।
দুর্ঘটনা পর্যালোচনায় সংস্থাটি বলছে, দেশে বর্তমানে জাতীয় ও আঞ্চলিক সড়কের দৈর্ঘ ২২ হাজার ৪৭৬.২৮ কিলোমিটার। গ্রামীণ সড়ক প্রায় ২ লাখ ৭০ হাজার কিলোমিটার। দেশব্যাপী এসব সড়কে নানা প্রকার যানবাহন যেমন বেড়েছে, তেমনি যানবাহনের গতিও বেড়েছে। কিন্তু গতি নিয়ন্ত্রণ ও মনিটরিংয়ের জন্য যথেষ্ট মাত্রায় প্রযুক্তির ব্যবহার হচ্ছে না। ফলে গতির প্রতিযোগিতা হচ্ছে এবং দুর্ঘটনা ঘটছে।
৮৫ শতাংশ দুর্ঘটনার প্রধান কারণ যানবাহনের অতিরিক্ত গতি। যানবাহনের গতি ঘণ্টায় ৬০ কিলোমিটারের ওপরে প্রতি ৫ কিলোমিটার বৃদ্ধিতে দুর্ঘটনার ঝুঁকি ২ থেকে ৪ গুণ বৃদ্ধি পায়।
সড়ক দুর্ঘটনার ১১টি কারণ উল্লেখ করেছে সংস্থাটি। এগুলো হল- ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন; বেপরোয়া গতি; চালকদের অদক্ষতা ও শারীরিক-মানসিক অসুস্থতা; চালকদের বেতন-কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট না থাকা; মহাসড়কে স্বল্পগতির যানবাহন চলাচল; তরুণ-যুবাদের বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালানো; জনসাধারণের মধ্যে ট্রাফিক আইন না-জানা ও না-মানার প্রবণতা; সড়ক এবং সড়ক পরিবহন নারী, শিশু ও প্রতিবন্ধীবান্ধব না হওয়া; দুর্বল ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা; বিআরটিএর সক্ষমতার ঘাটতি; এবং গণপরিবহন খাতে চাঁদাবাজি।
সড়ক দুর্ঘটনা রোধে ১২টি সুপারিশ দিয়েছে রোড সেফটি ফাউন্ডেশন। সেগুলো হলো- দক্ষ চালক তৈরির উদ্যোগ বৃদ্ধি করতে হবে; চালকদের বেতন-কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট করতে হবে; বিআরটিএর সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে; পরিবহন মালিক-শ্রমিক, যাত্রী ও পথচারীদের প্রতি ট্রাফিক আইনের প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে; মহাসড়কে স্বল্পগতির যানবাহন বন্ধ করে এগুলোর জন্য আলাদা রাস্তা (সার্ভিস লেন) তৈরি করতে হবে; পর্যায়ক্রমে সব মহাসড়কে রোড ডিভাইডার নির্মাণ করতে হবে; সড়ক এবং সড়ক পরিবহন নারী, শিশু ও প্রতিবন্ধীবান্ধব করা; গণপরিবহনে চাঁদাবাজি বন্ধ করা; রেল ও নৌপথ সংস্কার করে সড়কপথের ওপর চাপ কমানো; টেকসই পরিবহন কৌশল প্রণয়ন করা; সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮ বাধাহীনভাবে বাস্তবায়ন করা; এবং সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে গণমাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সড়ক নিরাপত্তা বিষয়ে জীবনমুখী সচেতনতামূলক প্রচারণা চালানো।