চট্টগ্রামে হাজেরা-তজু বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের সাবেক উপাধ্যক্ষ অধ্যাপক এস এম আইয়ুবের (৫৯) মৃত্যুকে কেন্দ্র করে চলছে নানা আলোচনা-সমালোচনা। স্বজনদের দাবি, উপাধ্যক্ষ পদ থেকে পদত্যাগের জন্য জোর করে পদত্যাগপত্রে একদল শিক্ষার্থী সই নেওয়ার পর থেকে তিনি মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। এ অপমান সহ্য করতে না পেরে তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। পদত্যাগপত্রে জোর করে অন্যায়ভাবে সই নেওয়ার সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবিও জানিয়েছেন কলেজটির সাবেক কয়েকজন শিক্ষার্থী এবং সহকর্মীরা।
মাত্র দশ মাস পর আগামী বছর আগস্ট মাসে তার শিক্ষকতা পেশা থেকে অবসরে যাওয়ার কথা ছিল। নগরের পুরাতন চান্দগাঁও থানা এলাকায় ১৯৯১ সালে কলেজটি প্রতিষ্ঠা করেন তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী নুরুল ইসলাম বিএসসি।
হাজেরা-তজু কলেজের প্রতিষ্ঠাকালীন শিক্ষক এস এম আইয়ুব রসায়নবিদ্যা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান, উপাধ্যক্ষ এবং প্রাক্তন ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ ছিলেন। শনিবার স্ট্রোকে তার মৃত্যু হয়। শনিবার বিকালে চান্দগাঁও থানাধীন মৌলভীপুকুর পাড় মসজিদ প্রাঙ্গণে তার প্রথম নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। রবিবার বাদজোহর তার গ্রামের বাড়ি বাঁশখালী উপজেলার কাথারিয়া ইউনিয়নে নিজের প্রতিষ্ঠিত মাস্টার আবু আহমদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে দ্বিতীয় নামাজে জানাজা শেষে তাকে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়। তার স্ত্রী এবং তিন ছেলে সন্তান রয়েছে।
এদিকে, উপাধ্যক্ষ এস এম আইয়ুবের এই মৃত্যু মেনে নিতে পারছেন না কেউ। তার পরিবারের সদস্যরাও বলছেন, এটি এক ধরনের হত্যাকাণ্ড। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও এই মৃত্যুর ঘটনায় ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে। বলা হচ্ছে, তাকে লাঞ্ছিত করে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। জড়িতদের চিহ্নিত করে শাস্তির আওতায় আনার দাবি উঠেছে।
এস এস আইয়ুবের ছেলে শেফায়েত খান বলেন, ‘জোর করে উপাধ্যক্ষ পদ থেকে পদত্যাগ পত্রে সই নেওয়ার পর থেকে আমার বাবা মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিলেন। ঘটনার দিন তিনি কলেজে স্ট্রোক করেন। সেই যে অসুস্থ হন, এরপর তিনি বাসা আর হাসপাতালের মধ্যে দিয়ে এতদিন ছিলেন।’
এ ঘটনায় শহীদুল্লাহ নামে এক শিক্ষক তার ফেসবুক ওয়ালে লেখেন, আমি শোকাহত, আমি লজ্জিত! ক্ষমা করবেন আইয়ুব স্যার।’ এই পোস্টের সঙ্গে তিনি কফিনে মোড়া উপাধ্যক্ষ আইয়ুবের একটি ছবিও শেয়ার করেন।
হাজেরা-তজু কলেজের প্রাক্তন ছাত্র মো. নাজিম উদ্দিন বলেন, অত্যন্ত ভালো শিক্ষক ছিলেন এস এম আইয়ুব স্যার। হয়তো তিনি আওয়ামী লীগের রাজনীতিকে সমর্থন করতেন। এ কারণে একজন শিক্ষককে ভয় দেখিয়ে উপাধ্যক্ষ পদ থেকে পদত্যাগপত্রে সই নেওয়ার ঘটনা অত্যন্ত দুঃখজনক। তিনি অত্যন্ত মানবিক মানুষও ছিলেন। যেসব ছাত্র তার কাছে গিয়ে বলতেন, আমার টাকা নেই পরীক্ষার ফি দিতে পারছি না, বই কিনতে পারছি না। তখন তিনি নিজের পকেটের টাকা দিয়ে শিক্ষার্থীদের সাহায্য করতেন। তিনি নিজ এলাকা বাঁশখালীতে বেশ কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়েছেন।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ রসায়ন সমিতির কার্যনির্বাহী কমিটির কেন্দ্রীয় সদস্য অধ্যাপক ইদ্রিস আলী বলেন, এস এম আইয়ুবকে উপাধ্যক্ষ পদ থেকে পদত্যাগ করানোর জন্য চাপ সৃষ্টি করানো হয়েছে। তাকে নিগৃহীত করে কলেজ থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে বলে শুনেছি। এমন হয়ে থাকলে এটা কখনও কাম্য নয়। এ বিষয়ের তদন্ত হওয়া উচিত। কেউ এ ধরনের ঘটনা ঘটিয়ে থাকলে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। যাতে এ ধরনের ঘটনার ভবিষ্যতে পুনরাবৃত্তি না ঘটে।
হাজেরা তজু বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের অধ্যক্ষ (ভারপ্রাপ্ত) চয়ন দাশ বলেন, হাজেরা-তজু বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে তিনি (এস এম আইয়ুব) এ কলেজে শিক্ষকতার পেশায় আছেন। তিনি রসায়নবিদ্যা বিভাগের একজন ভালো শিক্ষক। তিনি শ্রেণিকক্ষে যাওয়ার সময় বইও নিয়ে যেতেন না। তার পুরো বই মুখস্থ ছিল। এমন একজন শিক্ষকের ওপর এ আচরণ সহ্য করতে না পেরে তিনি স্ট্রোক করে মারা গেছেন।
তিনি আরও বলেন, ‘গত ২৪ সেপ্টেম্বর কলেজের একদল শিক্ষার্থী এবং বহিরাগতরা মিলে উপাধ্যক্ষ পদ থেকে পদত্যাগপত্র লিখে জোর করে তার (এস এম আইয়ুব) কাছ থেকে সই নেওয়ার চেষ্টা করে। এমন কাণ্ডে ওইদিন ঘটনাস্থলেই তিনি অপমানে স্ট্রোক করেন। তিনি মাটিতে পড়ে গেলে তার বৃদ্ধাঙ্গুলের ছাপ নেওয়া হয় পদত্যাগ পত্রে। তবে ওই পদত্যাগপত্র এখনও গ্রহণ হয়নি। এরপর থেকে তিনি আর কলেজে আসেননি। এর মধ্যে গত ১৮ নভেম্বর তিনি ডাকযোগে কলেজ পরিচালনা কমিটির সভাপতি বরাবর পদত্যাগপত্র পাঠিয়েছেন।’
কলেজের সাবেক উপাধ্যক্ষ এসএম আইয়ুব শনিবার (২৩ নভেম্বর) সকাল সাড়ে ১১টার দিকে নগরের একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। এর আগে তিনি সকালে নিজ বাসায় স্ট্রোক করেন।
কলেজ সূত্র জানিয়েছে, শিক্ষার্থীদের বেতন কমানো, আইডি কার্ড প্রদান করাসহ চার দফা দাবিতে গত ২৩ ও ২৪ সেপ্টেম্বর বিক্ষোভ করেন কলেজের একদল শিক্ষার্থী। ২৪ সেপ্টেম্বর উপাধ্যক্ষ পদে পদত্যাগপত্র লিখে জোর করে তার কাছ থেকে সই করানো হয়। শিক্ষার্থীদের এ অপমান সহ্য করতে না পেরে সে সময় এস এম আইয়ুব মাটিতে লুঠিয়ে পড়েন। পরিবারের সদস্যরা বলছেন ওই সময় অধ্যাপক এস এম আইয়ুব স্ট্রোক করেন।
অধ্যাপনার পাশাপাশি এস এম আইয়ুব বিভিন্ন পত্রিকায় লেখালেখি করতেন। তার প্রকাশিত কলাম, প্রবন্ধ কবিতার সংখ্যা শতাধিক। প্রকাশিত হয়েছে তার কাব্যগ্রন্থ ‘আর কত রাত’।
অধ্যাপক এস এম আইয়ুব নিজ এলাকায় দক্ষিণ বাগমারা মাস্টার আবু আহমদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি, সৈয়দ আলফা মিয়াজি ফোরকানিয়া মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা, উত্তর বাগমারা মাদ্রাসার ভূমি প্রদান করে তিনি প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর প্রাথমিক শিক্ষা অর্জনে ভূমিকা রেখেছিলেন।