আলবদর বাহিনীর লোকেরা অশিক্ষিত ছিল না। অশিক্ষিত লোক হলে তারা নিরীহ বুদ্ধিজীবীদের ঠাণ্ডা মাথায় হত্যা করতে পারত না, হয়তো তাদের হাত নড়ে উঠত, বুক কাঁপত, হয়তোবা চোখে আসত পানি। রাজাকারদের মধ্যে অশিক্ষিত সাধারণ মানুষ ছিল। অনেকেই রাজাকার হয়েছে জীবিকার তাড়নায়, কেউ কেউ প্রাণের দায়ে, অনেক ক্ষেত্রে রাজাকাররা অস্ত্রশস্ত্র ফেলে পালিয়েছে, কোথাওবা যোগ দিয়েছে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে। রাজাকাররা বুদ্ধিজীবীদের চিনত না। অধ্যাপক, সাংবাদিক, ডাক্তার- এদের বিষয়ে বিশেষ কোনো মাথাব্যথা ছিল না তাদের। তা ছাড়া অল্প কিছু মানুষই রাজাকার হয়েছিল, দেশের অধিকাংশ গরিব-দুঃখী মানুষ বাংলাদেশকে ভালোবাসত, যে-বাংলাদেশকে তারা চিনত তাদের ভালোবাসার মধ্য দিয়ে, চিনত রক্তের মধ্যে, হৃৎস্পন্দনের ভেতরে।
আলবদরদের পরিচয়, তারা খুনি। খুনির কাজ ঘৃণিত কাজ। সাধারণ মানুষ যখন খুনি হয় তখন তার পেছনে একটা উত্তেজনা থাকে, থাকে কোনো প্রবল ও প্রত্যক্ষ স্বার্থের ব্যক্তিগত প্ররোচনা। আলবদরদের খুন শীতল, নৃশংস এবং ব্যক্তিগত স্বার্থের অজুহাত-বিরহিত। তাই এই খুন অনেক বেশি ঘৃণার্হ। শুধু তাই নয়, খুনি যখন খুন করে তার মধ্যে একটা অপরাধবোধ থাকে, সে জানে সে অন্যায় করেছে, কিন্তু এই খুনিদের মধ্যে অন্যায়ের সেই বোধ তো ছিল না-ই, বরং সম্পূর্ণ বিপরীত ভাব ছিল, উল্লাস ছিল, ছিল মহৎ কর্তব্য সম্পাদনের অত্যন্ত প্রফুল্ল সন্তোষ। আলবদরেরা খুন করেছে কাকে? খুন করেনি একজন দু’জন দশজন একশজন মানুষকে, তারা খুন করবে ঠিক করেছিল একটি জাতির সত্তাকে, একটি জাতির বুঝবার শক্তিকে, দেখবার দৃষ্টিকে, অনুভব করবার ক্ষমতাকে, একটি জাতির বিবেককে। তাদের খুনের আহাজারি একটি দুটি দশটি একশটি পরিবারে ওঠেনি, উঠেছে বাংলাদেশজুড়ে। বদরবাহিনীর লোকেরা ঘৃণ্য অপরাধী নয়, তারা নিকৃষ্টতম পাপী।
পাঞ্জাবিরা বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করতে চাইবে এটি বুঝতে কোনো কষ্ট হয় না। সকলকে নয়, তবে অধিকাংশকেই। বুদ্ধিজীবী অনেকের কাজই যে তাদের কম-বেশি সহায়তা করছিল এটি অত্যন্ত সত্য, কিন্তু সেই চরম মুহূর্তে ক্রোধে ও অবিশ্বাসে তাদের নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গি এমন হয়ে উঠেছিল যে, ইতরবিশেষ করার উদার ও সংশয়বাদী নীতি পরিত্যাগ করেছিল তারা। বাঙালির প্রতি প্রচ্ছন্ন-অপ্রচ্ছন্ন সকল প্রকার ঘৃণা, স্বার্থের হানিতে ও বশীভূত-বলে-গৃহীতের বিদ্রোহে ভীষণ উষ্মা অত্যন্ত জীবন্ত ও প্রকাশ্য হয়ে উঠেছিল মনে, এবং নিতান্ত বশংবদ ও দাস হিসেবে পরীক্ষিতদের ভিন্ন অন্য সকল বুদ্ধিজীবীকেই ধ্বংস করা আবশ্যক মনে হয়েছিল তাদের কাছে। যারা টিকে থাকলে অপ্রীতিকর হট্টগোল সৃষ্টি করে বাংলাদেশকে শোষণ করার কাজে বিঘ্ন ঘটাবে সেই শত্রুকে নির্মূল করতে তারা চাইবে এটি স্বাভাবিক। কিন্তু শিক্ষিত বাঙালি তরুণ কেন হত্যা করবে ঠিক করেছিল বাংলাদেশের লেখক, শিক্ষক ও সাংবাদিকদের–যাদের তারা চিনত, যাদের তারা ছাত্র ছিল, ছিল যাদের দ্বারা এমনকি অনুগৃহীত?
করেছিল এই জন্য যে, এই তরুণরা সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ ছিল না, এরা ছিল অসুস্থ, বিকারগ্রস্ত, জ্ঞানপাপী। এই রোগ কোনো নতুন রোগ নয়। বাংলাদেশের শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির এবং বোধ-অনুভব-উপলব্ধির বিস্তৃত এলাকাজুড়ে খুনি আলবদরদের গোপন তৎপরতা আজকের ব্যাপার নয়, গুপ্তহত্যার কাজ তারা হঠাৎ শুরু করেনি, অনেক দিন ধরেই করছিল। তারা মানুষ হত্যা করেনি হয়তো, কিন্তু হত্যা করতে চেয়েছে মানুষের মুখের ভাষাকে, সাহিত্যকে, সংগীতকে, অগ্রগতির ইচ্ছাকে, প্রগতিশীলতায় আস্থাকে। তাদের সেই গোপন তৎপরতারই নগ্নতম ও নৃশংসতম প্রকাশ ঘটেছে তাদের অন্তিম মুহূর্তে। হানাদার সামরিক বাহিনী ত্রিশ লাখ মানুষ হত্যা করেছে, আলবদরেরা হত্যা করেছে কয়েকশ বুদ্ধিজীবী। উদ্দেশ্য একই, বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনকে পর্যুদস্ত করে দেওয়া। তফাত এই যে, হানাদাররা জানত বাঙালিরা স্বাধীনতার জন্যই লড়ছে, আলবদরেরা কল্পনা করত যে-স্বাধীনতা বুদ্ধিজীবীরা চাইছে সেই স্বাধীনতার প্রকৃত অর্থ হচ্ছে পরাধীনতা। কার কাছে পরাধীনতা? ইসলামবিরোধী শক্তির কাছে।
আলবদরেরা হঠাৎ করে আকাশ থেকে নামেনি। এই দেশের মাটিতেই দিনের পর দিন মাসের পর মাস বছরের পর বছর ধরে এই অসুস্থ বিকারগ্রস্ত ঘাতকেরা তৈরি হয়েছে, তাদের ছুরি শানিয়েছে, গুপ্তহত্যার জন্য হাতকে দক্ষ করে তুলেছে। দেশের শহীদ বুদ্ধিজীবীদের কথা যখন আমরা স্মরণ করব তখন আলবদরের কথাও আমাদের স্মরণ করতে হবে, চিনে নিতে হবে তার লক্ষণ ও বীজাণুগুলোকে, নইলে হয়তো আবার তারা আমাদের ক্ষতি করবে; যেমন করেছে হানাদারদের পলায়নের শেষ মুহূর্তে।
এটা জানা গেছে যে, আলবদরের অনেকেই ছিল মাদ্রাসার ছাত্র। মাদ্রাসা শিক্ষা যে অর্থহীন এ-কথা অনেকেই স্বীকার করেন, কিন্তু কেবল অর্থহীন নয়, এ শিক্ষা যে ক্ষতিকর হতে পারে এই সত্যটা নাটকীয়ভাবে উন্মোচিত হয়েছে বদরবাহিনীর কীর্তির মধ্য দিয়ে। কিন্তু মাদ্রাসার কিছু ছাত্রের একার পক্ষে এই কাজ কখনও সম্ভবপর হতো না। আলবদরদের একমাত্র জোর ছিল সামরিক বাহিনীর জোর, সেই জোর না থাকলে কোনো সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধার প্রয়োজন হতো না, নিরস্ত্র সাধারণ মানুষই এদের মোকাবিলা করত, যথোপযুক্ত রূপে। কিন্তু হানাদার সামরিক বাহিনী তো ছিল রাজাকারদের পেছনেও, তবু রাজাকাররা তো আলবদরের মতো কাজ করতে পারেনি কোথাও।
আসলে আলবদরেরা প্রস্তুত হয়েছিল এই বাংলাদেশেই; প্রস্তুত হয়ে ছিল, সামরিক বাহিনী ইশারা করা মাত্র তারা ঝাঁপিয়ে পড়েছে অস্ত্র নিয়ে, বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ মানুষগুলোর মধ্যে যাঁকেই হাতের কাছে পেয়েছে তাঁকেই ধরে নিয়ে গিয়ে হত্যা করেছে। তাদের ট্রেনিং ১৯৭১ সালের মে কিংবা জুন মাসে শুরু হয়নি। অতিপ্রকাশ্যে এবং মহোৎসাহে ট্রেনিং শুরু হয় পাকিস্তান প্রতিষ্ঠারও আগে। ট্রেনিং পাঞ্জাবিরা দেয়নি, এই দেশের লোকেরাই দিয়েছে, শিক্ষিত লোকেরা, সমাজের শীর্ষে অধিষ্ঠিত লোকেরা।
জামায়াতে ইসলামীর আধুনিকতা ও ধর্মান্ধতার মধ্যে কোনো বিরোধ নেই। তারা একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। সেই মুদ্রাটি হচ্ছে বাংলাদেশের জীবন থেকে বিচ্ছিন্নতা। সন্দেহ নেই এদের পূর্বপুরুষই একদিন বড়াই করত আরব দেশ থেকে এসেছে বলে, বলত বাংলা নয়, উর্দু হচ্ছে তাদের মাতৃভাষা। পরে এরা ইংরেজি শিখেছে। সেও ওই একই কারণে, নিজেদের আভিজাত্যকে কায়েমি করে রাখবার অভিপ্রায়ে। পাকিস্তান আমলে এরা উর্দুভাষীদের সঙ্গে দহরম-মহরম করেছে। তাতে একদিকে নগদ অর্থলাভ ঘটেছে, অন্যদিকে ক্ষমতাবানদের গৌরব থেকে কিছুটা আভা ছিটকে এসে লেগেছে নিজেদের গায়ে। এবং উভয় দিক থেকেই সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে সাধারণ মানুষ থেকে তাদের দূরত্ব, অর্থাৎ আভিজাত্য।
এরা সুপ্রতিষ্ঠিত ছিল সমাজের শীর্ষে। সেই শীর্ষদেশ থেকে নিজেদের এরা জাহির করেছে সমগ্র দেশের পক্ষে অনুকরণীয় আদর্শ বলে– করেছে একাধিক কারণে। একটা কারণ এই যে, এরা শিক্ষিত ছিল আলবদরের শিক্ষায়, এদের জীবনে আধুনিকতা যেটুকু তা বাইরের ব্যাপার, ব্যাপার কাপড়জামার, আসবাবের, বড়জোর বই থেকে মুখস্থ বলবার ক্ষমতা। ভেতরে এরা অশিক্ষিতদের চাইতেও অন্ধকারাচ্ছন্ন। দ্বিতীয় কারণ হলো ভয়। নতুন যুগ যে এসেছে সেটা এরা জানত, কিন্তু নতুন যুগকে জায়গা করে দিতে এদের ভীষণ ভয়, কেননা নতুন যুগ এদের প্রতিষ্ঠা কেড়ে নেবে, আভিজাত্যকে দেবে ভূলুণ্ঠিত করে। আর ভয় এই যে, নতুন যুগের শিক্ষা হয়তো তাদের অতীন্দ্রিয় আজন্মলালিত ধ্যান-ধারণা ও শিক্ষাকে দেবে একেবারে মিথ্যা প্রমাণ করে। সেই জন্য নতুন যুগের প্রবেশপথে এরা পিঠ দিয়ে দাঁড়িয়েছে এবং নিজেদের অভিলাষের মধ্যে, আশার মধ্যে এই ধারণা গভীর আগ্রহে গড়ে তুলেছে যে, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ তথা সমাজতান্ত্রিক চেতনা নিয়ে প্রগতিশীলতার যে নতুন যুগ আসছে সেই যুগ কিছুতেই জিতবে না। কেননা জিতলে তাদের নিজেদের সমূহ সর্বনাশ।
পাকিস্তানি সামরিক শাসকেরা সক্রিয় সমর্থন দিয়েছে, উৎসাহ দিয়েছে, পুরস্কার দিয়েছে আলবদর বাহিনীকে, হত্যা সংঘটনে। ফলে আলবদরেরা আরও পুষ্ট হয়ে উঠেছে দিনকে দিন। সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা না পেলে আলবদরেরা প্রকাশ্যে মানুষ খুনের কাজে লিপ্ত হতে পারত না কিছুতেই। এমনকি গোপনেও নয়। শাসকের সমর্থনকে বাদ দিয়ে, সাম্রাজ্যবাদের পৃষ্ঠপোষকতার বাইরে আলবদরকে ভাবা যায় না একেবারেই। আলবদর অবশ্যই দালাল, সে জানুক অথবা না-ই জানুক।
এরা এখন পালিয়েছে–আপাতত। কিন্তু আলবদর এত সহজে শেষ হবে মনে করলে আমরা মস্ত বড় ভুল করব। ওদের অবস্থান শক্তপোক্ত, তদুপরি তার বিনাশ করা যায়নি। কাজেই তাকে মৃত মনে হলেও সে আসলে মরেনি, লুকিয়ে আছে, যদি সুযোগ পায় আবার সে আক্রমণ করবে বাংলাদেশের বিবেককে, তার বুঝবার শক্তিকে, দেখবার দৃষ্টিকে, অনুভব করবার ক্ষমতাকে।
ওই হীনমতাদর্শকে যদি আমরা নির্মূল না করি, যদি ধ্বংস না করে দিই এর বীজাণু এবং ব্যবস্থা না নিই যাতে এরা না জন্মে আর কখনও, তবে শুধু যে ব্যর্থ হয়ে যাবে লাখ লাখ মানুষের মৃত্যু তাই নয়, মৃত্যু আমাদের সঙ্গ ছাড়বে না, ভবিষ্যতে হয়তো আবার রক্তের নদী বইবে, আবার ব্যাপক ধ্বংস আসবে জীবনে।
শুধু ধর্মান্ধতা নয়, নির্ভেজাল রক্ষণশীলতাও নয়, আদর্শগতভাবে প্রতিক্রিয়াশীল। আলবদরদের প্রকৃত শত্রুতা বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে নয়, ছিল জনসাধারণের সঙ্গে, জনসাধারণের ওপর ক্রুদ্ধ হয়েই তারা বুদ্ধিজীবী সমাজের সেই অংশের ওপর আক্রমণ করেছিল, যে-অংশ, তাদের মতে, যুক্ত ছিল জনসাধারণের আন্দোলনের সঙ্গে। তারা হয়তো নিজেরাও জানত না তাদের মতাদর্শকে, যেমন ওই মতাবলম্বী আজও জানে না-দেখা যায় বাস্তব জীবনে।
লেখক : শিক্ষাবিদ ও ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়