পলল মাটিতে অঙ্কুরিত হয়ে যে নেতৃত্ব মহীরুহে পরিণত হয়, মাটি ও মানুষের প্রতি সহজাত ভালোবাসায় যে নেতৃত্বের অঙ্কুরোদগম হয়, হৃদয়ের বিশালতা দিয়ে যে কালজয়ী সত্তা নিপীড়িত মানুষের দীর্ঘশ্বাস উপলব্ধি করে, নান্দনিক রাজনীতির দীক্ষা ও দর্শনের সমন্বয়ে রাজনীতির নান্দনিকতা অনুধাবন করে গণমানুষের শৃঙ্খল মুক্তির এক অমোঘ ও ঐক্যবদ্ধ চেতনাকাঠামো বিনির্মাণ করে, ফাঁসির রশি ও গণমানুষের মুক্তি- এ দ্বৈরথে স্বীয় জীবনকে বিপন্ন করে মুক্তিকামী মানুষের স্পন্দন হয়ে তাদেরকে মুক্তির আদর্শে বিশ্বাসী করে তোলেন তিনি বাঙালির ত্রাতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
তাঁর পারিবারিক আবহ পর্যালোচনা করলে, স্কুলজীবনের ঘটনাবহুল দিক বিশ্লেষণ করলে আমার সাদামাটা চোখে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের সহজাত দিক উন্মোচিত হয়। বঙ্গবন্ধুর আত্মমর্যাদাবোধ ছিল তীব্র এবং ব্যক্তিত্বে ছিল প্রচণ্ড সাহসিকতার ছাপ। তাছাড়া তাঁর পারিবারিক ঐতিহ্যে নেতৃত্বের মুন্সিয়ানা ছিল, ছোটবেলা থেকেই এ বলয়ের মধ্যে তিনি কালযাপন করেছেন। বঙ্গবন্ধু তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে উল্লেখ করেছেন ‘আমাদের বাড়িতে কি করে আসবে- থানার দারোগা সাহেবদের একটু লজ্জা করছিল! প্রায় দশটার সময় টাউন হল মাঠের ভিতর দাঁড়িয়ে দারোগা আলাপ করছে, তার উদ্দেশ্য হল আমি যেন সরে যাই। টাউন হলের মাঠের পাশেই আমার বাড়ি। আমার ফুফাতো ভাই, মাদারীপুর বাড়ি। আব্বার কাছে থেকেই লেখাপড়া করত, সে আমাকে বলে, ‘মিয়াভাই, পাশের বাসায় একটু সরে যাও না। বললাম, যাব না, আমি পালাব না। লোকে বলবে, আমি ভয় পেয়েছি।’
আবহমান বাংলার সমাজ কাঠামোতে অসাম্প্রদায়িকতার মূলনীতি ছিল মানুষের মূল্যবোধে ও বিশ্বাসে। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শনে যে অসাম্প্রদায়িকতার নীতি তা তিনি বাঙালির অন্তর্নিহিত শক্তির উৎস থেকে আহরণ করে রাজনীতির মূল পরিকাঠামোতে যুক্ত করেছেন, সার্বভৌমের পরিচালনার মূলমন্ত্রে প্রোথিত করেছেন। বঙ্গবন্ধুর অনবদ্য সৃষ্টি ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে উল্লেখ করেন ‘আমার কাছে তখন হিন্দু মুসলমান বলে কোনো জিনিস ছিল না। হিন্দু ছেলেদের সাথে আমার খুব বন্ধুত্ব ছিল। একসাথে গান বাজনা, খেলাধুলা, বেড়ান- সবই চলত।’
কলজয়ী নেতৃত্বে সাহসিকতা, সততা ও অসাম্প্রদায়িকতা, মানবিকতা ও পরোপকারিতার সুস্পষ্ট ছাপ থাকে। এ মানবিক গুণাবলী ছোটবেলা থেকেই অবিসংবাদিত নেতৃত্বের চারিত্রিক দৃঢ়তা বিনির্মাণের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের তেজস্বীয়তা ও দৃঢ়তা আবহমান বাংলার স্রোতধারায় নির্মিত। নেতৃত্বের সুপ্ত প্রতিভার সমুজ্জ্বল স্ফুলিঙ্গ ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে তিনি পরিষ্কারভাবে তুলে ধরেছেন ‘আগেই বলেছি আমার বয়স একটু বেশি, তাই স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী করার ভার পড়ল আমার উপর। আমি স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী করলাম দলমত নির্বিশেষে সবাইকে নিয়ে।’
সাহসিকতার দুরন্তপনা দেখিয়েছেন ছোটবেলা থেকেই, তাঁর নিজের জবানবন্দিতে উল্লেখ আছে- ‘এর মধ্যে রমাপদরা থানায় খবর দিয়েছে। তিনজন পুলিশ এসে হাজির হয়ে গিয়েছে। আমি বললাম, ওকে ছেড়ে দিতে হবে, না হলে কেড়ে নেব। কোর্ট দারোগার রুমের পাশেই কোর্ট হাজত। আমাকে দেখে বলেন, মজিবর খুব ভয়ানক ছেলে। ছোরা মেরেছিল রমাপদকে। কিছুতেই জামিন দেওয়া যেতে পারে না। আমি বললাম, বাজে কথা বলবেন না, ভাল হবে না। যারা দারোগা সাহেবের সামনে বসেছিলেন, তাদের বললেন, দেখ ছেলের সাহস! (অসমাপ্ত আত্মজীবনী)। বঙ্গবন্ধু সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সর্বদাই সোচ্চার ছিলেন। তাঁর উদ্ধৃতিতে এমনই আপসহীন উচ্চারণ বারবার প্রতিফলিত হয়েছে, ‘রাজনীতিতে যারা সাম্প্রদায়িকতা সৃষ্টি করে, যারা সাম্প্রদায়িক তারা হীন, নীচ, তাদের অন্তর ছোট। যে মানুষকে ভালোবাসে, সে কোনোদিন সাম্প্রদায়িক হতে পারে না।’
দুই.
যাপিত জীবনের অধিকাংশ সময় নিপীড়িত বাঙালি জাতিকে শৃঙ্খলমুক্ত করার লক্ষ্যে জেল খেটেছেন, কিন্তু কোনো আপোষ করেননি বঙ্গবন্ধু। সত্তরের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর অবিসংবাদিত নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয় হলেও পাকিস্তানি সামরিক অসুর ইয়াহিয়া খান বাঙালির নেতৃত্বের কাছে ক্ষমতা ছাড়বে না। ক্ষমতালিপ্সু ইয়াহিয়ার দাম্ভিক মন্তব্য We won’t allow these black bastards to rule over us. ৭ মার্চের পর থেকে পূর্ববাংলা বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে পরিচালিত হয়, ধানমন্ডির বত্রিশ নম্বর বাড়ি ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটে পরিণত হয়। জীবন-মৃত্যুর দ্বৈরথে দাঁড়িয়ে মুক্তিকামী বাঙালিদের মুক্তিযুদ্ধের জন্য ঐক্যবদ্ধ করেছেন, সাহসী সহচরদের মুক্তিযুদ্ধের রূপরেখা দিয়েছেন, সর্বোপরি পাকিস্তানি নরঘাতকদের গণহত্যা সংঘটিত করার আগেই মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ঘোষণা দিলেন This may be my last message. From now Bangladesh is independent. এটাই হয়তোবা আমার শেষ বার্তা। এখন থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। ‘শেষ বার্তা’ দ্বারা বঙ্গবন্ধু জীবন-মৃত্যুর মাঝে যে এক অনিশ্চিত সত্তা ছিলেন তা পরিষ্কারভাবে উল্লেখ করেছেন, অপরদিকে ঘোষণা দিলেন ‘আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন’। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বঙ্গবন্ধু বাড়িতে সসস্ত্র হামলা করে। বঙ্গবন্ধু চিৎকার করে বললেন ‘গুলি থামাও। কেন তোমরা গুলি করছো? আমাকে যদি মারতে চাও আমি তো এখানেই রয়েছি। কেন তোমরা আমার লোকজনকে মারছো?’ পাকিস্তানি সৈন্যরা এরপরও গুলি চালালো, মেজর বিলালের সংকেতে হানাদাররা গুলি করা থামায় এবং বঙ্গবন্ধুকে জানায় যে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। এরপর তিনি পরিবারের কাছ থেকে বিদায় নেন। বিদায়ের সময় বঙ্গবন্ধু আবারো মৃত্যু ও বাঙালির মুক্তির প্রসঙ্গ তুলে বলেন ‘আমাকে হয়তো ওরা মেরে ফেলবে। ফিরে আসতে পারবো কিনা জানি না। কিন্তু কোনো একদিন আমাদের দেশের মানুষ মুক্ত হবে। তখন আমার আত্মা তা দেখে খুশি হবে।’ একথা বলে তিনি সিঁড়ির দিকে এগিয়ে যান।
সিডনি শনবার্গ যিনি মুক্তিযুদ্ধকালীন বঙ্গবন্ধুর বন্দিজীবন নিয়ে সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘গ্রেপ্তার করে বঙ্গবন্ধুকে রাখা হয়েছিল আদমজী ক্যান্টনমেন্ট স্কুলের একটি নোংরা অন্ধকার ঘরে। পরের দিন তাকে সরিয়ে নেওয়া হয় ক্যান্টনমেন্টের ফ্ল্যাগ স্টাফ হাউজে।’ সিডনি শনবার্গের সাক্ষাৎকার থেকে জানা যায় পরে বঙ্গবন্ধুকে একটি বিমানযোগে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয় ১ এপ্রিল। বিমানটি করাচিতে নামার পর সেখান থেকে আরেকটি বিমানে তাকে সরিয়ে নেওয়া হয় রাওয়ালপিন্ডিতে। শেষ পর্যন্ত তার জায়গা হয় উত্তর পাঞ্জাবের শহর মিয়াওয়ালির কারাগারের এক প্রকোষ্ঠে, এ ধরনের প্রকোষ্ঠে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের রাখা হয়। বঙ্গবন্ধুর মনোবল ভেঙে মুক্তিযুদ্ধকে নস্যাৎ করার লক্ষ্যে ইয়াহিয়া এমন দূরভিসন্ধি করেছে, তবুও বঙ্গবন্ধু বাঙালির মুক্তির প্রশ্নে অনড় ছিলেন। পাকিস্তানের বিশেষ সামরিক আদালতে বঙ্গবন্ধুর বিচার শুরু হয়। তাঁর বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি অভিযোগ আনা হয়েছে। তার মধ্যে একটি হচ্ছে ‘পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা’। বিচারটি পরিচালিত অতিসাবধানতা ও গোপনীয়তা রক্ষা করে। পাক সামরিক সরকার তার বিরুদ্ধে মোট ১২টি অভিযোগ দায়ের করে। এর মধ্যে ছয়টি অভিযোগের সর্বোচ্চ শাস্তি ছিল মৃত্যুদণ্ড। মার্কিন অ্যাম্বাসেডর ফারল্যান্ড বেশ সতর্কতার সাথে ইয়াহিয়া খানকে বঙ্গবন্ধুর গোপন বিচার নিয়ে প্রশ্ন করছেন। এ বিচার প্রক্রিয়ায় বিশ্বের বেশিরভাগ দেশ দিকে আগ্রহভরে নজর রাখছে। এর সম্ভাব্য রায় সম্পর্কে বিশ্ববাসী উদ্বিগ্ন। ফারল্যান্ড বলেন, ‘ইয়াহিয়া আমাকে জানালেন, রায় যদি মৃত্যুদণ্ড হয়, তাহলে রাষ্ট্রপতির পক্ষ থেকে শেখ মুজিবের ক্ষমা ভিক্ষা করা হবে এবং তিনি সেটা গ্রহণ করবেন।’
পাকিস্তানে নির্জন কারাবাসের মধ্যে বঙ্গবন্ধুকে কয়েকবার এক জেল থেকে অন্য জেলে সরিয়ে নেয়া হয়। মিয়াওয়ালি, ফয়সালাবাদ, সাহিওয়াল ছাড়াও রাওয়ালপিন্ডি থেকে প্রায় ১৫০ মাইল দূরে উত্তর পাঞ্জাবের বস্ত্রশিল্পের শহর লায়ালপুর। সেখানে এক নবনির্মিত একতলা জেলখানায় কঠোর গোপনীয়তার মধ্যে ঐ বিচার চলে। পাকিস্তান গোয়েন্দা পুলিশের সাবেক কর্মকর্তা রাজা আনার খানের দায়িত্ব ছিল বঙ্গবন্ধুর ওপর নজরদারির করা। এজন্য তাকে কারাগারের একই সেলে রাখা হয়েছিল। সেই ঘটনার বিবরণ দিয়ে আনার খান জানান, যে গাড়িতে শেখ মুজিবকে মিয়াওয়ালি নেওয়া হয়েছিল সেটির ভেতর লেপ-তোষক দিয়ে এমনভাবে ঢেকে দেওয়া হয়েছিল যাতে তিনি যেন বাইরের দৃশ্য দেখতে না পারেন। আর তাকেও যেন বাইরে থেকে দেখা না যায়। এমনকি গাড়ির কাঁচও কাদা দিয়ে লেপে দেয়া হয়েছিল। মিয়াওয়ালি ছিল পাকিস্তান জেনারেলর আমির আব্দুল্লাহ খান নিয়াজির জেলা। মিয়াওয়ালি কারাগারের বেশিরভাগ কর্মকর্তা আর বন্দি ঐ জেলার লোক। এখানেই কৌশলে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ষড়যন্ত্র করে। ১৫ ডিসেম্বর কয়েদিদের মধ্যে গুজব ছড়ানো হয় যে পূর্ব পাকিস্তানের লড়াইয়ে জেনারেল নিয়াজি নিহত হয়েছে। এসব ঘটেছে সেই শেখ মুজিব জন্য। এজন্য তাকে মিয়াওয়ালির ক্যাম্পেই আটক রাখা হয়েছে। যাতে কয়েদিরা গুজবে উত্তেজিত হয়ে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে।
১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী পরাজিত হয় এবং বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। অপরদিকে ১৯ ডিসেম্বর ভুট্টো পাকিস্তানের শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন। ভুট্টো বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ৪ জানুয়ারি সাক্ষাৎ করেন। পাকিস্তানের দুই প্রদেশের মধ্যে কোনও রকম একটা সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার জন্য জোরাজুরি করেন ভুট্টো । বঙ্গবন্ধু ভুট্টোকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আমি কি মুক্ত না এখনও বন্দি? আমি যদি মুক্ত হই তাহলে আমাকে যেতে দিন। আর যদি বন্দি হই তাহলে কোনও কথা বলতে প্রস্তুত নই।’ একপর্যায়ে ভুট্টো দাবি করেন, পাকিস্তানের দুই অংশ আইনের চোখে একই রাষ্ট্রের অন্তর্গত। জবাবে বঙ্গবন্ধু তাঁকে মনে করিয়ে দেন, ‘বিগত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়ী হয়েছিল। পাকিস্তান যদি এখনও অবিভক্ত দেশ হয় তাহলে আপনি দেশের প্রেসিডেন্ট নন, আমি।’ ৭ জানুয়ারি শেষবারের মতো বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করেন ভুট্টো। শেষ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুকে লন্ডনে পাঠাতে সম্মত হন ভুট্টো। পাকিস্তান ত্যাগের আগে ফিয়োদর দস্তয়ভস্কির উপন্যাস ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্টের একটি কপিতে সই করে রাজা আনার খানকে উপহার দিয়েছিলেন। সেখানে লেখা ছিল In the long war between the falsehood and the truth, falsehood wins the first battle and truth the last.
৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু বিমানযোগে লন্ডনে আসছেন। উড়োজাহাজটি লন্ডনের হিথরো বিমানবন্দরে অবতরণ করে। অবতরণের পরপরই রাষ্ট্রীয় অতিথির মর্যাদা দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে স্বাগত জানান হয়। ব্রিটিশ সরকারের সম্মানিত অতিথি হিসেবে লন্ডনের ক্ল্যারিজেস হোটেলে নিয়ে আসা হয় তাঁকে। বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতির কথা জেনে হাজার হাজার বাঙালি ‘জয় বাঙলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগানে লন্ডনের শহরকে মুখরিত করে তোলে। বঙ্গবন্ধু যখন লন্ডনে পৌঁছলে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী অ্যাডওয়ার্ড হিথ তাঁর পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচি বাতিল করে ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটে ছুটে এসে বঙ্গবন্ধুকে নজিরবিহীন সম্মান দেখান। ৮ জানুয়ারি রাতে ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথের সঙ্গে ঘণ্টাব্যাপী বৈঠকে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশকে স্বীকৃতির বিষয়টি উত্থাপন করেন।
৯ জানুয়ারি সকালে লন্ডনে বসেই টেলিফোনে ইন্দিরা গান্ধী-বঙ্গবন্ধুর মধ্যে আধাঘণ্টা আলোচনা হয়। বঙ্গবন্ধুকে অভিনন্দন জানান ইন্দিরা গান্ধী। ঢাকার পথে তিনি দিল্লিতে যাত্রাবিরতি করার অনুরোধ করলে বঙ্গবন্ধু অনুরোধ রক্ষা করলেন এবং দিল্লির উদ্দেশে রওনা দেন। দিল্লিতে প্রেসিডেন্ট ভি. ভি. গিরি বঙ্গবন্ধুকে আলিঙ্গন করলেন। পাশে দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী স্বাগত জানাচ্ছিলেন।
১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু ঢাকা ফিরে আসেন বেলা ১টা ৪১ মিনিটে। বিমানবন্দর ও রাস্তার দুপাশে তখন অপেক্ষমাণ লাখো জনতা। সংগ্রামী জনতার কণ্ঠে মুক্তিযুদ্ধের রণধ্বনি ‘জয় বাঙলা, জয় বঙ্গবন্ধু।’ মাটিতে পা রেখেই আবেগে কেঁদে ফেলেন বঙ্গবন্ধু। বিমানবন্দরে অস্থায়ী সরকারের সহযোদ্ধা , মুক্তিযোদ্ধাসহ মুক্তিকামী বাঙালি অশ্রুসজল নয়নে বরণ করেন ইতিহাসের মহানায়ককে। সেখান থেকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গিয়ে দেশবাসীর সামনে প্রায় ৩৫ মিনিট দিকনির্দেশনামূলক গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ শেষে বাড়ি ফেরেন জাতির জনক।
তিন.
বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে পশ্চিম পাকিস্তানের নিয়ে যাওয়া এবং তাঁর এ অনিশ্চিত পথের যাত্রা বাঙালির মুক্তির নেশাকে আরো তীব্রতর করেছে। কারণ বঙ্গবন্ধুর বাঁচা-মরার অনিশ্চয়তা মুক্তিযুদ্ধের সংগ্রামকে আরো বেগবান করেছে। আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রামের রণধ্বনি ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ প্রতিটি মুক্তিকামী বাঙালি এ স্লোগান বুকে ধারণ করে যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েছেন। কাজেই এ রণধ্বনির মাধ্যমেই রণাঙ্গনে বঙ্গবন্ধুর সরব উপস্থিতি মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে অদম্য স্পৃহা তৈরি করে।
অস্থায়ী সরকারের রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু, যে সরকারের নেতৃত্বে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। বঙ্গবন্ধু মুক্তিকামী মানুষের অবিসংবাদিত নেতা বলেই তাঁকে রাষ্ট্রপতি করা হয়, তাঁর অনিশ্চিত জীবনের কথা জেনেও। অস্থায়ী সরকারের রাষ্ট্রপতি হিসেবে বঙ্গবন্ধু মুক্তিযুদ্ধে সরব থেকেছেন সরকারের সর্বোচ্চ পদটি অলঙ্কৃত করার মাধ্যমে, তাঁর অনিশ্চিত জীবন মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনে আরো শক্তিশালী প্রতিরোধ তৈরিতে সাহস যুগিয়েছে। ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ এ মহামন্ত্রটি প্রতিটি মুক্তিকামী বাঙালিকে সাহসী যোদ্ধায় পরিণত করে, বাঙালিকে ঐক্যবদ্ধ করে সংগ্রামী জাতিতে প্রস্তুত করে।
এ মাটিতে রয়েছে আমাদের পূর্বপুরুষের দেহাবশেষ, সবচেয়ে যে বৃহৎ দেহাবশেষটি স্বধীন ভূখণ্ডের বুকে শায়িত আছে সেটি জাতির পিতার অবিনশ্বর দেহাবশেষ। এ মাটির উপরে প্রজন্ম মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে, পরবর্তী প্রজন্মও জাতির পিতার এ অবিনশ্বর চেতনা বুকে ধারণ করে দুর্বিনীত মস্তকে অগ্রসর হবে এটাই হোক আমাদের দৃঢ় প্রত্যয়।